ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা, নাকি ইউক্রেন টুকরা করার ফন্দি
Published: 16th, February 2025 GMT
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ইউক্রেন ‘শান্তি পরিকল্পনা’ ঘোষণা করার পর মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ যখন বলেন, ‘সব সমাধান আলোচনার টেবিলে আছে’, তখন শুনতে বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট পুতিন কি আলোচনা চাইছেন নাকি পুরো টেবিলটাই নিজের ভাগে রেখে দিতে চান?
মনে হচ্ছে, হেগসেথ গোটা টেবিলটাই বিনা দ্বিধায় পুতিনকে দিয়ে দিতে রাজি। আর সেই টেবিল সম্ভবত সৌদি কারিগরদের দিয়ে তৈরি করা হবে। অবশ্য এটি কোনো হাড় কাটার টেবিল নয় (এই বাক্য ২০১8 সালে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার ঘটনায় সৌদি সরকারের ভূমিকার প্রতি একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত, যেখানে হত্যার জন্য হাড় কাটার সরঞ্জাম ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছিল)। কারণ ট্রাম্প বলছেন, এই কথিত শান্তি আলোচনা সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের মধ্যস্থতায় হতে পারে।
এই মুহূর্তে বিশ্বকে আপাতত এটিই দেখতে হলো যে হেগসেথ ব্রাসেলসে ন্যাটোর প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকে হাজির হয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কাউকে “আঙ্কেল স্যাম”কে “আঙ্কেল সাকার” বানাতে দেবেন না।’ এখানে আঙ্কেল স্যাম (যুক্তরাষ্ট্রের প্রতীক) এবং ‘আঙ্কেল সাকার’ (যার অর্থ ‘দুর্বল বা বোকা যুক্তরাষ্ট্র’)। (এর মানে হলো, ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রকে দুর্বল হতে দেবে না)
এই সপ্তাহে সবাই দেখল কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের বক্তব্যকে ডিজনির কার্টুনের মতো সরল ও অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হলো। আর কথাগুলো বললেন একজন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, যাঁর গায়ে ক্রুসেডের ট্যাটু আঁকা আছে। যা–ই হোক, যা হচ্ছে, তা শান্তির পরিকল্পনা বটে! আমি মনে করি, এই পরিকল্পনার পাঠটি ট্রাম্পের লেখা বিখ্যাত দ্য আর্ট অব দ্য ডিল বইয়ে আছে। সেখানে উল্লেখ করা দর-কষাকষির নিয়ম হলো, যদি আপনি প্রথমে একটি সংখ্যা বলেন, তাহলে আপনি সেই সংখ্যা থেকে কমে আসতে বাধ্য হবেন। আর যদি অন্য পক্ষ প্রথমে একটি সংখ্যা বলে, তাহলে আপনি সেই সংখ্যা থেকে বাড়িয়ে আলোচনা করতে পারবেন।
ইউক্রেনবিষয়ক আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প এবং তাঁর প্রশাসন আলোচনায় বসার আগেই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজ থেকে ছাড় দিয়ে বসে আছে।
হেগসেথের কথায় প্রকাশ পেয়েছে, রাশিয়া ২০১৪ সাল থেকে যেসব অঞ্চল দখল করেছে, সেগুলো ফেরত দেওয়া, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের সম্ভাবনা এবং ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বের প্রশ্নে আপস করতে তাঁরা রাজি হয়ে বসে আছেন। ফলে আমি মনে করি, পুতিন সহজেই ট্রাম্পের সব শর্ত মেনে নেবেন।
হেগসেথ পোল্যান্ডে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘যতটা যুক্তরাজ্যের চাহিদা এবং অহংকার, তা তাদের ক্ষমতার সঙ্গে মেলে না।’ তাঁর এমন মন্তব্য থেকে একটি ধারণা তৈরি হচ্ছে যে যুক্তরাজ্য বাড়াবাড়ি রকমের অহংকার প্রকাশ করলেও বিশ্বরাজনীতিতে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে না।হেগসেথ মিউনিখ প্রতিরক্ষা সম্মেলনের আগে বলেছিলেন, ট্রাম্প হবেন ‘আলোচনার টেবিলের পাশে সেরা চুক্তি করার লোক’। আসলে ট্রাম্প টেবিলটিও হারিয়ে ফেলবেন। কিন্তু তাঁর তা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। তিনি জানেন, যে দেশে তিনি জিতেছেন বলে দাবি করেছেন (যদিও প্রকৃত অর্থে তিনি পরাজিত হয়েছেন), সে দেশে মানুষকে এটি বিশ্বাস করানো তাঁর জন্য খুব সহজ হবে যে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো শান্তিচুক্তি করেছেন। এটা আসলে তাঁর ‘চুক্তির শিল্প’। তার ওপর তাঁর হাড়ে কিছু সমস্যা আছে, যা তাঁর শরীরে স্পার্ট তৈরি করেছে। (এখানে ট্রাম্পের পুরোনো দাবি বা অজুহাতকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। ট্রাম্প ১৯৬০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগ না দেওয়ার কারণ হিসেবে বলেছিলেন, তাঁর পায়ের হাড়ে ‘স্পারস’ বা একধরনের হাড়ের বৃদ্ধি বা সমস্যা ছিল, যার কারণে তিনি চিকিৎসাগত ছাড় পেয়েছিলেন। তবে অনেকেই মনে করেন, এটি আসলে একটি বাহানা ছিল, যা তাঁকে যুদ্ধে যাওয়া থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল)।
কথা হচ্ছে, ট্রাম্প তো বহুদিন ধরেই বলে আসছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে প্রথম দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করবেন। তাহলে ইউরোপীয়রা এত অবাক হলেন কেন? এটি তো আগে থেকেই অনুমান করা যাচ্ছিল। ট্রাম্প আরও বলছেন, হেগসেথের অবস্থান বোঝা কঠিন কিছু নয়। কারণ, তাঁর শরীরেই তাঁর চিন্তাধারা প্রকাশিত—তাঁর হাতে মার্কিন পতাকা ও অস্ত্রের ট্যাটু রয়েছে। তাঁর কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য তাঁর হাতে লেখা বিভিন্ন বার্তা পড়লেই চলে।
ইউক্রেন নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে, তখন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এখন ইউরোপের উচিত নিজেদের শান্তির জন্য কোনটি গুরুত্বপূর্ণ, তা স্পষ্ট করা। তবে তাঁর এই বক্তব্য অনেক দেরিতে এল। কারণ, ট্রাম্প অনেক আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তিনি ইউক্রেনে মার্কিন সমর্থন কমিয়ে দেবেন বা পুরোপুরি প্রত্যাহার করবেন। কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলো এত দিন শুধু সময় নষ্ট করেছে এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়নি। এখন ইউরোপ বাস্তবতার মুখোমুখি হতে বাধ্য হচ্ছে।
পুতিন যখন তিন বছর আগে ইউক্রেন আক্রমণ করলেন, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা ফ্রান্সের ঐতিহাসিক ভার্সাই প্রাসাদে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। ভার্সাই চুক্তির (১৯১৯) স্মৃতি যেখানে ইউরোপকে বিভক্ত করেছিল, সেখানে ওই বৈঠক ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ এনে দিতে পারত। কিন্তু বাস্তবে, সেই বৈঠকের ফলাফল ছিল একদমই হতাশাজনক। কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার বদলে ইউরোপীয় নেতারা আবারও কূটনৈতিক কথাবার্তা ও দীর্ঘমেয়াদি আলোচনার চক্রে আটকে যান। কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে তাঁরা নিজেদের নিরাপদ রেখে বিবৃতি দেওয়া আর পরামর্শ সভা চালিয়ে যাওয়ার পথকেই বেছে নেন। এটি প্রমাণ করে, ইউরোপ তখনো যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত ছিল না।
আমরা সবাই এখনো সেখানে আটকে আছি। মার্কিন প্রশাসন ও পুতিন তাঁদের আরামদায়ক অবস্থানে আছেন; অন্যদিকে ইউক্রেন সবচেয়ে দুঃখজনক অবস্থায় পড়েছে। ইউক্রেন তার ভবিষ্যতের ব্যাপারে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করার সমকক্ষ অংশীদার হবে কি না, জানতে চাওয়া হলে ট্রাম্প উত্তর দিয়েছিলেন, ‘হুম, এটি একটি আগ্রহজনক প্রশ্ন বটে।’ অর্থাৎ ইউক্রেন মূলত এই আলোচনা থেকে অনেকটাই বাইরে আছে। হয়তো তাঁকে গাড়ির ভেতরে না থেকে গাড়ির পেছন পেছন দৌড়াতে হতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে গাড়ির নিচে চাপা পড়তে হতে পারে।
যুক্তরাজ্য এই পরিস্থিতিতে নিজেদের অবস্থান নিয়ে অনেকটাই অনিশ্চিত। তারা ন্যাটো সদস্যপদ নিয়ে ইউক্রেনকে আশ্বস্ত করলেও ইউক্রেনকে সদস্য বানানোর ব্যাপারে তাদের প্রভাব খুব সীমিত। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ইউক্রেনকে আশ্বস্ত করলেও বাস্তবে তাদের ক্ষমতা সীমিত। হেগসেথ পোল্যান্ডে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘যতটা যুক্তরাজ্যের চাহিদা এবং অহংকার, তা তাদের ক্ষমতার সঙ্গে মেলে না।’ তাঁর এমন মন্তব্য থেকে একটি ধারণা তৈরি হচ্ছে যে যুক্তরাজ্য বাড়াবাড়ি রকমের অহংকার প্রকাশ করলেও বিশ্বরাজনীতিতে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে না।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
মারিনা হাইড দ্য গার্ডিয়ান–এর কলাম লেখক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন ইউর প য় কর ছ ন মন ত র র জন য অবস থ করল ও
এছাড়াও পড়ুন:
কার্টুন, মিমে অভ্যুত্থানের ভিন্ন ধারার দৃশ্যায়ন
টাকার বস্তার ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে আছেন শুভ্র কেশ, সফেদ দাড়ি, চশমা পরিহিত এক লোক। তাঁর ছবি দেখে তো বটেই, এই বর্ণনা থেকেও তাঁকে চিনবেন দেশবাসী। বর্তমানে কারাগারের বাসিন্দা পতিত স্বৈরশাসকের এই উপদেষ্টা বলছেন, ‘টাকার ওপর আমার বিশ্বাস উঠে গেছে।’ এই ছবির পাশেই এক কাটআউট। সেখানে ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ বলতে বলতে দৌড়ে পালাচ্ছেন ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার মসনদ থেকে উৎপাটিত শেখ হাসিনা।
এমন মজার মজার কার্টুন, মিম, গ্রাফিতি, ভিডিও স্থাপনাকর্মসহ বৈচিত্র্যময় সৃজনসম্ভার নিয়ে শুরু হয়েছে ‘বিদ্রূপে বিদ্রোহ’ নামের ব্যতিক্রমী এক প্রদর্শনী। আয়োজন করেছে অনলাইনভিত্তিক স্যাটায়ার সাময়িকী ‘ইয়ারকি’। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দিনের এ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। চলবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। সবার জন্য প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা।
গত বছর ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল ছিল জুলাই। একটি বৈষম্যহীন, উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য পথে নেমেছিলেন অগণিত মানুষ। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারকে উৎখাত করতে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের অনেকে। আহত হয়েছেন বেশুমার। রক্তরঞ্জিত রাজপথ বেয়ে এসেছে জনতার বিজয়।
প্রদর্শনীতে প্রবেশপথটির দুই পাশে লাল রঙের পটভূমিতে বড় বড় ডিজিটাল পোস্টার। সেখানে ২ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিনের বিভিন্ন ঘটনার আলোকচিত্র, সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল, টেলিভিশনের রিপোর্ট, ছবি, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট—এসব তুলে আনা হয়েছে এ পোস্টারগুলোতে। প্রবেশপথটিও লাল রঙের। ‘জুলাই করিডর’ নামে এই রক্তিম পথটি বেয়ে দর্শনার্থীরা প্রদর্শনীতে প্রবেশের সময় অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোর উত্তাপ ফিরে পাবেন।