ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ইউক্রেন ‘শান্তি পরিকল্পনা’ ঘোষণা করার পর মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ যখন বলেন, ‘সব সমাধান আলোচনার টেবিলে আছে’, তখন শুনতে বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট পুতিন কি আলোচনা চাইছেন নাকি পুরো টেবিলটাই নিজের ভাগে রেখে দিতে চান?

মনে হচ্ছে, হেগসেথ গোটা টেবিলটাই বিনা দ্বিধায় পুতিনকে দিয়ে দিতে রাজি। আর সেই টেবিল সম্ভবত সৌদি কারিগরদের দিয়ে তৈরি করা হবে। অবশ্য এটি কোনো হাড় কাটার টেবিল নয় (এই বাক্য ২০১8 সালে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার ঘটনায় সৌদি সরকারের ভূমিকার প্রতি একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত, যেখানে হত্যার জন্য হাড় কাটার সরঞ্জাম ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছিল)। কারণ ট্রাম্প বলছেন, এই কথিত শান্তি আলোচনা সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের মধ্যস্থতায় হতে পারে।

এই মুহূর্তে বিশ্বকে আপাতত এটিই দেখতে হলো যে হেগসেথ ব্রাসেলসে ন্যাটোর প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকে হাজির হয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কাউকে “আঙ্কেল স্যাম”কে “আঙ্কেল সাকার” বানাতে দেবেন না।’ এখানে আঙ্কেল স্যাম (যুক্তরাষ্ট্রের প্রতীক) এবং ‘আঙ্কেল সাকার’ (যার অর্থ ‘দুর্বল বা বোকা যুক্তরাষ্ট্র’)। (এর মানে হলো, ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রকে দুর্বল হতে দেবে না)

এই সপ্তাহে সবাই দেখল কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের বক্তব্যকে ডিজনির কার্টুনের মতো সরল ও অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হলো। আর কথাগুলো বললেন একজন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, যাঁর গায়ে ক্রুসেডের ট্যাটু আঁকা আছে। যা–ই হোক, যা হচ্ছে, তা শান্তির পরিকল্পনা বটে! আমি মনে করি, এই পরিকল্পনার পাঠটি ট্রাম্পের লেখা বিখ্যাত দ্য আর্ট অব দ্য ডিল বইয়ে আছে। সেখানে উল্লেখ করা দর-কষাকষির নিয়ম হলো, যদি আপনি প্রথমে একটি সংখ্যা বলেন, তাহলে আপনি সেই সংখ্যা থেকে কমে আসতে বাধ্য হবেন। আর যদি অন্য পক্ষ প্রথমে একটি সংখ্যা বলে, তাহলে আপনি সেই সংখ্যা থেকে বাড়িয়ে আলোচনা করতে পারবেন।

ইউক্রেনবিষয়ক আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প এবং তাঁর প্রশাসন আলোচনায় বসার আগেই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজ থেকে ছাড় দিয়ে বসে আছে।

হেগসেথের কথায় প্রকাশ পেয়েছে, রাশিয়া ২০১৪ সাল থেকে যেসব অঞ্চল দখল করেছে, সেগুলো ফেরত দেওয়া, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের সম্ভাবনা এবং ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বের প্রশ্নে আপস করতে তাঁরা রাজি হয়ে বসে আছেন। ফলে আমি মনে করি, পুতিন সহজেই ট্রাম্পের সব শর্ত মেনে নেবেন।

হেগসেথ পোল্যান্ডে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘যতটা যুক্তরাজ্যের চাহিদা এবং অহংকার, তা তাদের ক্ষমতার সঙ্গে মেলে না।’ তাঁর এমন মন্তব্য থেকে একটি ধারণা তৈরি হচ্ছে যে যুক্তরাজ্য বাড়াবাড়ি রকমের অহংকার প্রকাশ করলেও বিশ্বরাজনীতিতে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে না।

হেগসেথ মিউনিখ প্রতিরক্ষা সম্মেলনের আগে বলেছিলেন, ট্রাম্প হবেন ‘আলোচনার টেবিলের পাশে সেরা চুক্তি করার লোক’। আসলে ট্রাম্প টেবিলটিও হারিয়ে ফেলবেন। কিন্তু তাঁর তা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। তিনি জানেন, যে দেশে তিনি জিতেছেন বলে দাবি করেছেন (যদিও প্রকৃত অর্থে তিনি পরাজিত হয়েছেন), সে দেশে মানুষকে এটি বিশ্বাস করানো তাঁর জন্য খুব সহজ হবে যে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো শান্তিচুক্তি করেছেন। এটা আসলে তাঁর ‘চুক্তির শিল্প’। তার ওপর তাঁর হাড়ে কিছু সমস্যা আছে, যা তাঁর শরীরে স্পার্ট তৈরি করেছে। (এখানে ট্রাম্পের পুরোনো দাবি বা অজুহাতকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। ট্রাম্প ১৯৬০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগ না দেওয়ার কারণ হিসেবে বলেছিলেন, তাঁর পায়ের হাড়ে ‘স্পারস’ বা একধরনের হাড়ের বৃদ্ধি বা সমস্যা ছিল, যার কারণে তিনি চিকিৎসাগত ছাড় পেয়েছিলেন। তবে অনেকেই মনে করেন, এটি আসলে একটি বাহানা ছিল, যা তাঁকে যুদ্ধে যাওয়া থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল)।

কথা হচ্ছে, ট্রাম্প তো বহুদিন ধরেই বলে আসছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে প্রথম দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করবেন। তাহলে ইউরোপীয়রা এত অবাক হলেন কেন? এটি তো আগে থেকেই অনুমান করা যাচ্ছিল। ট্রাম্প আরও বলছেন, হেগসেথের অবস্থান বোঝা কঠিন কিছু নয়। কারণ, তাঁর শরীরেই তাঁর চিন্তাধারা প্রকাশিত—তাঁর হাতে মার্কিন পতাকা ও অস্ত্রের ট্যাটু রয়েছে। তাঁর কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য তাঁর হাতে লেখা বিভিন্ন বার্তা পড়লেই চলে।

ইউক্রেন নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে, তখন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এখন ইউরোপের উচিত নিজেদের শান্তির জন্য কোনটি গুরুত্বপূর্ণ, তা স্পষ্ট করা। তবে তাঁর এই বক্তব্য অনেক দেরিতে এল। কারণ, ট্রাম্প অনেক আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তিনি ইউক্রেনে মার্কিন সমর্থন কমিয়ে দেবেন বা পুরোপুরি প্রত্যাহার করবেন। কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলো এত দিন শুধু সময় নষ্ট করেছে এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়নি। এখন ইউরোপ বাস্তবতার মুখোমুখি হতে বাধ্য হচ্ছে।

পুতিন যখন তিন বছর আগে ইউক্রেন আক্রমণ করলেন, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা ফ্রান্সের ঐতিহাসিক ভার্সাই প্রাসাদে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। ভার্সাই চুক্তির (১৯১৯) স্মৃতি যেখানে ইউরোপকে বিভক্ত করেছিল, সেখানে ওই বৈঠক ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ এনে দিতে পারত। কিন্তু বাস্তবে, সেই বৈঠকের ফলাফল ছিল একদমই হতাশাজনক। কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার বদলে ইউরোপীয় নেতারা আবারও কূটনৈতিক কথাবার্তা ও দীর্ঘমেয়াদি আলোচনার চক্রে আটকে যান। কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে তাঁরা নিজেদের নিরাপদ রেখে বিবৃতি দেওয়া আর পরামর্শ সভা চালিয়ে যাওয়ার পথকেই বেছে নেন। এটি প্রমাণ করে, ইউরোপ তখনো যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত ছিল না।

আমরা সবাই এখনো সেখানে আটকে আছি। মার্কিন প্রশাসন ও পুতিন তাঁদের আরামদায়ক অবস্থানে আছেন; অন্যদিকে ইউক্রেন সবচেয়ে দুঃখজনক অবস্থায় পড়েছে। ইউক্রেন তার ভবিষ্যতের ব্যাপারে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করার সমকক্ষ অংশীদার হবে কি না, জানতে চাওয়া হলে ট্রাম্প উত্তর দিয়েছিলেন, ‘হুম, এটি একটি আগ্রহজনক প্রশ্ন বটে।’ অর্থাৎ ইউক্রেন মূলত এই আলোচনা থেকে অনেকটাই বাইরে আছে। হয়তো তাঁকে গাড়ির ভেতরে না থেকে গাড়ির পেছন পেছন দৌড়াতে হতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে গাড়ির নিচে চাপা পড়তে হতে পারে।

যুক্তরাজ্য এই পরিস্থিতিতে নিজেদের অবস্থান নিয়ে অনেকটাই অনিশ্চিত। তারা ন্যাটো সদস্যপদ নিয়ে ইউক্রেনকে আশ্বস্ত করলেও ইউক্রেনকে সদস্য বানানোর ব্যাপারে তাদের প্রভাব খুব সীমিত। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ইউক্রেনকে আশ্বস্ত করলেও বাস্তবে তাদের ক্ষমতা সীমিত। হেগসেথ পোল্যান্ডে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘যতটা যুক্তরাজ্যের চাহিদা এবং অহংকার, তা তাদের ক্ষমতার সঙ্গে মেলে না।’ তাঁর এমন মন্তব্য থেকে একটি ধারণা তৈরি হচ্ছে যে যুক্তরাজ্য বাড়াবাড়ি রকমের অহংকার প্রকাশ করলেও বিশ্বরাজনীতিতে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে না।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

মারিনা হাইড দ্য গার্ডিয়ান–এর কলাম লেখক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউক র ন ইউর প য় কর ছ ন মন ত র র জন য অবস থ করল ও

এছাড়াও পড়ুন:

লর্ডসে ফাইনাল, ভেন্যু ও সময় ঘোষণা করল আইসিসি

নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ২০২৬ আসরের দিনক্ষণ ও ভেন্যুর তালিকা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)। আগামী বছরের ১২ জুন থেকে শুরু হবে ১২ দলের এই টুর্নামেন্ট, যার পর্দা নামবে ৫ জুলাই লন্ডনের বিখ্যাত লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ফাইনালের মধ্য দিয়ে।

মোট ৩৩টি ম্যাচ হবে ইংল্যান্ডের সাতটি ভেন্যুতে। এর মধ্যে রয়েছে—লর্ডস, দ্য ওভাল, এজবাস্টন, ওল্ড ট্রাফোর্ড, হেডিংলি, হ্যাম্পশায়ার বোল ও ব্রিস্টলের কাউন্টি গ্রাউন্ড। আইসিসির এক বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়। পুরো সূচি ও ম্যাচের সময়সূচি পরে জানাবে আইসিসি।

আসন্ন বিশ্বকাপের ভেন্যু ও সূচি ঘোষণা করে আইসিসি চেয়ারম্যান জয় শাহ বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের বিত্তশালী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ আয়োজন প্রতিটি দলের জন্য আবেগীয় সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ। এখানে এমন ইভেন্ট অতীতেও স্মরণীয় হয়ে আছে। ২০১৭ আসরে লর্ডস দারুণ নারী ক্রিকেটে দারুণ মাইলফলক তৈরি করেছিল, তাই ফাইনালের জন্য এরচেয়ে উপযুক্ত ভেন্যু হতে পারে না। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মাধ্যমে সমর্থকদের সঙ্গে আমরাও যেমন রোমাঞ্চিত, তেমনি ২০২৮ লস অ্যাঞ্জলস অলিম্পিকে ক্রিকেটের প্রত্যাবর্তনের জন্যও পূর্ব-প্রদর্শনী।’

???? 7 venues. One unmissable tournament ????

The ICC Women’s T20 World Cup 2026 will grace some of England’s most iconic grounds ????

✍️: https://t.co/BqtN44SMEX pic.twitter.com/UmkuBU4HL3

— ICC (@ICC) May 1, 2025

এই প্রথমবারের মতো নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে সর্বোচ্চ ১২টি দল। দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে দলগুলো খেলবে গ্রুপ পর্ব, এরপর নকআউট হয়ে শেষ পর্যন্ত গড়াবে ফাইনালে। আয়োজক ইংল্যান্ডসহ ইতোমধ্যে মূল পর্বে জায়গা করে নিয়েছে আরও সাতটি দল—অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাকি চার দলকে আসতে হবে বাছাইপর্ব পেরিয়ে।

নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল দল অস্ট্রেলিয়া, যারা ছয়বার শিরোপা জিতেছে। ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতেছে একটি করে। সবশেষ ২০২৪ সালের বিশ্বকাপ হয়েছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতে। সেবার ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে নিউজিল্যান্ড।

সম্পর্কিত নিবন্ধ