পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য বলতে শুধু পুরাকীর্তি কিংবা পুরোনো স্থাপনা নয়। পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি, বাণিজ্য, খাবার, ভাষা, জীববৈচিত্র্য, নদ-নদী ও জলাশয়। তাই পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারের পদক্ষেপের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

পুরান ঢাকার অর্থনীতি, ভূগোল ও ঐতিহ্য নিয়ে ‘পুরান ঢাকা থেকে শিক্ষা’ শীর্ষক এক আলোচনায় সভায় এ কথাগুলো উঠে এসেছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকায় তিন দিনব্যাপী কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠান ও আলোচনা হয়।

কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠানে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য: ভবন ও বসবাস, জলবায়ু স্বস্তি ও উদ্ভিদবৈচিত্র৵ এবং অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য ও কাজ—এসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়। দেশ ও দেশের বাইরের নগরবিদ, স্থপতি, গবেষক ও উন্নয়নকর্মীরা এ আলোচনায় অংশ নেন।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী পরিচালক হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, পুরান ঢাকায় কোনো কিছুই হয়তো দ্রুত বদলে যাবে না; কিন্তু এখানে যেসব চিন্তা ও পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, আশা করা যায়, এগুলোর একদিন সূচনা হবে এবং বাস্তবায়িত হবে। পুরান ঢাকাকে রক্ষার যে লক্ষ্য বা ইচ্ছা, সেটার প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হতে হবে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের (বাস্থই) সভাপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ বলেন, গাবতলী-সদরঘাট বেড়িবাঁধে আট লেনের রাস্তা হচ্ছে। তবে এখন পদ্মা সেতু চালুর পর সদরঘাটের বাণিজ্যিক প্রয়োজন কমে গেছে। পরিকল্পনা করে সেখান থেকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম ঢাকার অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া সম্ভব। তাই আট লেনের যে রাস্তা হচ্ছে, সেটা রায়ের বাজারের পর থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে কিংবা নদীর অন্য পাড় দিয়ে করা যেতে পারে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য রক্ষা করতে হলে ওই দিক দিয়ে আট লেনের ব্যস্ত রাস্তা করা যাবে না। পাশাপাশি বাকল্যান্ড বাঁধ রক্ষার মাধ্যমে আহসান মঞ্জিলসহ অন্যান্য ঐতিহ্য রক্ষা করা যাবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, পুরান ঢাকার স্থানীয়দের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার বিষয়ে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে ওই এলাকা ছেড়ে নতুন ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় বসবাস করছেন। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের স্থানীয়দের কাছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের তেমন আবেগ নেই। তাঁদের কাছে পুরান ঢাকা মানে অনেকটাই টাকা উপার্জনের মাধ্যম। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষায় তাঁদের তেমন তাগিদ নেই। তাই সরকারকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্বুদ্ধ করে তাগিদ দিতে হবে।

সভায় পুরান ঢাকার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার সাব্বির আহমেদ। তিনি বলেন, পুরান ঢাকা শুধু ঐতিহ্যবাহী ভবন রক্ষার বিষয় না। এটা একটা জীবন ধরন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, খাবার প্রভৃতি রক্ষারও বিষয়। ঢাকার আশপাশে একাধিক নদী রয়েছে। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু নদী হচ্ছে দূষিত। নতুন বা আধুনিক ঢাকায় যে বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করা হয়, পুরান ঢাকায় ওই একই বিল্ডিং কোড প্রয়োগ করা উচিত নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।

লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, পুরান ঢাকার নদী হারিয়ে গেছে, ১০০টির বেশি পুকুর, ৬০টির বেশি খালের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য—বাঘ ও হরিণ হরিয়ে গেছে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য রক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, বানরগুলোও পুরান ঢাকার বাসিন্দা। ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে পরিবেশ পুনরুদ্ধারের বিকল্প নেই। তাই পুরান ঢাকার গ্রিন এরিয়া (গাছ ও প্রকৃতি) এবং ব্লু এরিয়া (নদী, খাল ও পুকুর) রক্ষা করতে হবে।

নগরবিদ ও প্রকৌশলী ফ্রাঙ্ক বোটে বলেন, পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীকেই যদি আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়, সেটা পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য অনেক উপকার বয়ে নিয়ে আসবে। ওই এলাকার বাসিন্দাদের জীবনযাপনে সজীবতা ও স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিতে পারে বুড়িগঙ্গা নদী।

আলোচনায় অন্যদের মধ্যে স্থপতি মেথিও লুকাস, বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাহাজিবুল হোসেন, বিশ্ব ব্যাংকের আরবান কনসালট্যান্ট আহমেদ বিন পারভেজ প্রমুখ অংশ নেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ম্যারি মাসদুপুই, ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রশাসক মো.

শাহজাহান মিয়া, বিশ্বব্যাংকের অ্যাকটিং অপারেশন ম্যানেজার সৈয়দ আমির আহমেদ প্রমুখ।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আহম দ

এছাড়াও পড়ুন:

১৭ হাজার রেজিস্ট্রেশন নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৪৫ হাজার মিশুক

এখন পুরো শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারি চালিত মিশুক। যেন মানুষের চাইতে এ শহরে মিশুকের সংখ্যা বেশি। রেজিস্ট্রেশনের দোহাই দিয়ে তারা রীতিমত রাজত্ব করে চলেছে এ শহরে। যেখানে বাড়তি যানবাহনের চাপে নগরবাসী কোণঠাসা, সেখানে এ হাজার হাজার মিশুক মানুষকে আরও পাগল করে তুলছে।

এখন প্রশ্ন হলো, কোথা থেকে আসলো এত মিশুক? নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন কি এত হাজার হাজার মিশুকের রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে?

এক জরিপে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন থেকে মাত্র ১৭ হাজার ৩শ ৪২টি মিশুককে রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়েছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মিশুক চলছে কমপক্ষে ৪৫ হাজারেরও বেশি। এবং তারা সবাই বলছে তাদের মিশুক রেজিস্ট্রেশন করা। তাহলে তারা এত মিশুকের রেজিস্ট্রেশন পেল কোথা থেকে?

অনুসন্ধানে জানাগেছে, একটি মিশুকের রেজিস্ট্রেশন দিয়ে প্রায় ১০টিরও বেশি মিশুক চলছে এ শহরে। কিছু অসাধু মিশুক মালিকরা সিটি কর্পোরেশনের চোঁখ ফাঁকি দিয়ে একটি মিশুকের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার নকল করে আরও দশটি মিশুকের পিছনে সাঁটিয়ে পুরো দমে ব্যবসা করে যাচ্ছে।

শুধুমাত্র নাম্বার ভিন্ন ছাড়া রেজিস্ট্রেশন কার্ডগুলো দেখতে প্রায় একই রকম হওয়ায় বুঝার উপায় নেই যে, কোনটা আসল আর কোনটা নকল। আর এ সুযোগটিকেই কাজে লাগিয়ে ওই চক্রটি লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ওই চক্রটির কারণে হাজার হাজার মিশুকের চাপে শহরে সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ যানজট, আর এ যানজটের কারণে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে নগরবাসী।

শুধু তাই নয়, ওই মালিক চক্রটির কারণে প্রকৃত মিশুক মালিকরাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। তারা এ বিষয়ে একাধীকবার সিটি কর্পোরেশন ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগীতা কামনা করেও ব্যর্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন গণমাধ্যকর্মীদের।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সিটি কর্পোরেশনের চরম গাফলতির কারণেই শহরের আজ এ অবস্থা। তাদের নিয়মিত অভিযান থাকলে কোনভাবেই এ শহরে রেজিস্ট্রেশনবিহিন কোন মিশুকই চলতে পারবে না। তারা কি এ শহর দিয়ে চলাচল করে না? নাকি বিমানে চলে?

তারা যদি এ শহর দিয়েই চলাচল করে থাকে, তাহলে তাদের চোঁখে কি পড়েনা এসব অনিয়ম। তারা কেন এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে না? নগরবাসীর এত দুর্ভোগ পোহলেও শহরে শৃঙ্খলা ফেরাতে তারা কেন এতটা উদাসীন। যদি তারা না পারে জনসম্মুখে বলুক, ছেড়ে দিক চেয়ার। সরকার অন্যজনকে বসাক। কিন্তু না।

তারা সেটা করবে না। আপনারা কাজও করবেন না আবার চেয়ারও আকড়ে ধরে রাখবেন, এ দু’টো একসাথে চলতে পারে না। হয় কাজ করুন, জনদুর্ভোগ দূর করুন আর নয়তো সব ছেড়ে দিয়ে চলে যান।

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি রহমান বিশ^াস বলেন, নারায়ণগঞ্জ শহরের যানজট নিরসনের জন্য সিটি কর্পোরেশন আগে যে রিকশার লাইসেন্সগুলো ছিলো, সেগুলোকে কনর্ভাট করে মিশুকের নামে দিয়েছে। কিন্তু পরবির্ততে কিছু দুষ্ট লোক সেই লাইসেন্সগুলোকে রাতারাতি কপি করে ফেলে।

এ কপি করার ফলে শহরে মিশুকের সংখ্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এ ক্ষেত্রে যানজট নিরসনে সিটি কর্পোরেশন যে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলো সেটা অনেকাংশে ব্যর্থ হয়ে যায়। কারণ, একই নাম্বারের গাড়ী যদি ৫টা ছয়টা চলে তাহলে কিভাবে যানজট নিরসন হবে। একই নাম্বারের গাড়ী একটিই থাকতে হবে। তাহলে গাড়ীর সংখ্যাও কম থাকবে আবার যানজটও কমে যাবে।

তিনি বলেন, আমরা হাতে নাতে একটি প্রিন্টিং প্রেসে মিশুকের প্লেট জাল করতে দেখে সিটি কর্পোরেশন এবং থানার ওসিকে কল করেছিলাম। আমরা অনেকক্ষন অপেক্ষা করেছিলাম ভাবছিলাম, হয়তো আইনগত কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে। কিন্তু আমরা প্রায় তিনঘন্টা অপেক্ষা করার পর যখন দেখলাম তাদের কোন সাড়াশব্দ নাই, তখন এক কথায় নিরাশ হয়ে ফিরে যাই।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আমরা যারা প্রকৃত মিশুক মালিক রয়েছি আমরা নিজেরাও এ বিষয়ে খুব চিন্তার মধ্যে থাকি। কারণ, জানিনা ওই দুষ্ট লোকেরা আবার আমাদের গাড়ীর লাইসেন্সের কপি করে ফেলছে কি না! যদি এমন কিছু হয়ে থাকে তাহলে ধরা খেলেতো আমারও সমস্যা হতে পারে।

এমনও হতে পারে কপি করার অপরাধে আমার নিজের লাইসেন্সই বাতিল করে দিতে পারে সিটি কর্পোরেশন। তখন কি তাদেরকে আমি বুঝাতে পারবো যে, আমি এটা করি নি। তাই বলছি, এসব বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

সবশেষ তিনি একটি সুখবর দিয়ে বলেন, সিটি কর্পোরেশন একটা ডিজিটাল প্লেট দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে। যদি সেটা করা হয় তাহলে এ প্লেটটা কোনভাবেই কপি করা সম্ভব নয়। এটা রংপুরেও হয়েছে। আর আমরা এটা যাচাই করেও দেখেছি। ওই প্লেটটা হাতে পেলেই আশাকরছি নকল নাম্বার নিয়ে যে মিশুকগুলো চলছে সেটা বন্ধ হয়ে যাবে।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ১৭ হাজার রেজিস্ট্রেশন নিয়ে শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৪৫ হাজার মিশুক
  • ১৭ হাজার রেজিস্ট্রেশন নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৪৫ হাজার মিশুক