ট্রাম্প কেন হামাসের সঙ্গে চুক্তিতে যাচ্ছেন
Published: 18th, March 2025 GMT
১৯৮৯ সালে তিউনিসিয়ায় নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্টিফেন ডে একটি ফোনকল পান। ফোনটি করেছিলেন তাঁর তিউনিসিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট পেলেট্রো। পেলেট্রো বললেন, ‘আপনার কাছে কি ইয়াসির আরাফাতের ফোন নম্বরটা আছে?’ পেলেট্রোর কথা শুনে স্টিফেন ডে ধাক্কা খেলেন। কারণ, আরাফাত তখন আমেরিকার চোখে সন্ত্রাসী।
ডে ও পেলেট্রোর ওই টেলিকথোপকথন হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন পিএলওর (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন) সঙ্গে প্রকাশ্যে সংলাপে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গাজা থেকে স্থায়ীভাবে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করার কয়েক দিন পরই মার্কিন কর্মকর্তারা দোহায় হামাসের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন। এ ঘটনা ১৯৮৯ সালের সেই ঘটনাকে মনে করিয়ে দিল।
সন্দেহ নেই, এ ঘটনা মার্কিন নীতিতে ঘটে যাওয়া এক বড় পরিবর্তন। কারণ, মার্কিন নীতিতে হামাসের সঙ্গে যেকোনো ধরনের আলোচনা নিষিদ্ধ ছিল।
১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে এবং ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ পরে এ সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে। হামাসের সঙ্গে কথা বলাও ছিল মার্কিন কূটনীতিকদের জন্য ক্যারিয়ার ধ্বংসের শামিল।
যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বলে এসেছে, তারা ‘সন্ত্রাসীদের’ সঙ্গে কোনো আলোচনা করে না। তবে বাস্তবতা হলো, অতীতেও তাদের এ নীতি ভাঙার নজির আছে। যেমন ১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন আয়ারল্যান্ডের রাজনৈতিক দল সিন ফেইনের নেতা জেরি অ্যাডামসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। অথচ অ্যাডামসের দলটি সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন আইআরএর সঙ্গে যুক্ত ছিল।
হামাসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় বসাটা আগের ওই সব ঘটনার চেয়ে অনেক বেশি ধাক্কা দেওয়ার মতো। কারণ, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই আলোচনা করে না।
কিন্তু ট্রাম্প এ নিয়ম বদলে দিয়েছেন। মার্কিন বন্দিমুক্তিবিষয়ক আলোচক অ্যাডাম বোয়েলার দোহায় হামাসের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করেছেন। এ আলোচনা কোনো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে হয়নি, বরং মুখোমুখি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে কেবল বন্দিবিনিময়ের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়নি, সেখানে হামাস ৫ থেকে ১০ বছরের জন্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবও দিয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, ওই আলোচনার পরিধি অনেক বড় ছিল।
হামাস-যুক্তরাষ্ট্রের এ বৈঠক নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই ইসরায়েলি নেতৃত্ব ক্ষুব্ধ হয়েছে। কারণ, তারা আশঙ্কা করছে, যুক্তরাষ্ট্র হামাস নিয়ে আলাদা নীতি গ্রহণ করতে পারে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন এ নিয়ে ইসরায়েলকে কোনো কৈফিয়ত দেয়নি। সিএনএনের সাক্ষাৎকারে যখন বোয়েলারের কাছে এ বিষয়ে ইসরায়েলকে কিছু জানানো হয়েছে কি না বলে জানতে চাওয়া হয়, তখন তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের এজেন্ট নই।’
এ অবস্থায় মনে হচ্ছে, ইসরায়েলের নেতাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন ও আইজাক শামির ব্রিটিশ শাসনের সময়ে সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত ছিলেন। কারণ, তাঁরা প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছিলেন। কিন্তু এটি ব্রিটেনসহ অন্যান্য রাষ্ট্রকে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি।
এ ঘটনার মধ্য দিয়ে নেতানিয়াহুকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও তিনি তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেই। ট্রাম্পের প্রধান লক্ষ্য ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ (সবার আগে আমেরিকার স্বার্থ), বরং আরও স্পষ্টভাবে বললে বলা যায়, ‘ট্রাম্প ফার্স্ট’ (সবার আগে ট্রাম্পের স্বার্থ)। তাঁর কাছে কোনো কিছুই বাইবেলের পবিত্র বাণীর মতো অপরিবর্তনীয় নয়। এমনকি এ নীতি মিরিয়াম অ্যাডেলসনের মতো তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ তহবিল সরবরাহকারীকে ক্ষুব্ধ করলেও তিনি এতে একটুও বিচলিত নন।
জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো হামাসের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ রাখেনি। তারা ‘কোয়ার্টেট নীতিমালা’ মেনে চলে। সে নীতিমালায় বলা আছে, হামাসকে বৈধতা পেতে হলে সহিংসতা ত্যাগ করতে হবে, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং আগের সব শান্তিচুক্তি মেনে চলতে হবে।অনেকেই ট্রাম্পকে বাইডেনের চেয়ে বেশি ইসরায়েলপন্থী নেতা বলে মনে করেন। যদিও ট্রাম্প ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনিদের দমন করার জন্য সবুজসংকেত দিয়ে থাকেন। তবে তিনি মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে বাইডেনের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীন এবং প্রয়োজনে ইসরায়েলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতেও সক্ষম।
ট্রাম্পের এই স্বাধীনচেতা মনোভাব এবং তাঁর ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ ইসরায়েলকে উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে। ট্রাম্প এরপর কী করবেন, তা নিয়ে ইসরায়েলি নেতারা চিন্তিত। তিনি কি ইসরায়েলের অনুমতি ছাড়াই হামাসের সঙ্গে কোনো চুক্তি করবেন? তিনি কি ইসরায়েলের আপত্তি উপেক্ষা করেই তেহরানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবেন? এসব প্রশ্ন ইসরায়েল প্রশাসনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা গোপনে ইরানের সঙ্গে যোগাযোগের একটি চ্যানেল খুলেছিলেন। ট্রাম্প ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করেই এটি প্রকাশ্যে করতে পারেন। ট্রাম্পের অনেক সমালোচনা আছে, তবে তাঁকে কিছুটা কৃতিত্ব দেওয়া উচিত। কারণ, তাঁর কিছু কাজ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগতভাবে বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ। তবে এর সঙ্গে কিছু জটিলতাও রয়েছে।
ট্রাম্প হামাসের সঙ্গে চুক্তি করতে চান, আর সংঘাতরত দুই পক্ষের এক পক্ষকে, অর্থাৎ ইসরায়েলকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে সেই চুক্তি করা সম্ভব নয়।
জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো হামাসের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ রাখেনি। তারা ‘কোয়ার্টেট নীতিমালা’ মেনে চলে। সে নীতিমালায় বলা আছে, হামাসকে বৈধতা পেতে হলে সহিংসতা ত্যাগ করতে হবে, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং আগের সব শান্তিচুক্তি মেনে চলতে হবে।
তবে হামাসকে সবকিছু থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার মাধ্যমে কোনো ইতিবাচক ফল আসেনি। মিসর ও কাতার হামাসের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, অথচ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তাদের তথ্য সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছে।
অনেকে মনে করেন, হামাসের সঙ্গে আলোচনা করা মানে তাদের অযথা বৈধতা দেওয়া। তবে এটি তখনই সত্যি হতে পারে, যদি তাদের হোয়াইট হাউস বা ডাউনিং স্ট্রিটে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু যখন তারা দূরে, গোপনে কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা করছে, তখন এটি তেমন গুরুতর বিষয় নয়।
আরেকটি যুক্তি হলো, সহিংসতার মাধ্যমে হামাস সুবিধা আদায় করতে পারলে, তারা সহিংসতায় আরও উৎসাহিত হতে পারে।
তবে আলোচনা কোনো পুরস্কার নয়। হামাসের সঙ্গে আলোচনা মানেই তাদের সমর্থন করা নয়। বরং এটি বাস্তবতাকে উপলব্ধি করা যে শত্রুপক্ষগুলোর মধ্যেও সংলাপ ফলপ্রসূ হতে পারে এবং নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলতে পারে।
ইতিহাস বলে, অন্তত এ বিষয়ে ট্রাম্প সঠিক পথে আছেন। সাবেক লেবার নেতা হিউ গেইটস্কেল একবার বলেছিলেন, ‘শেষ পর্যন্ত সব সন্ত্রাসীই সরকারের আমন্ত্রণে ডরচেস্টার হোটেলে এসে মদ খায়।’
যদি গেইটস্কেলের এ বক্তব্য ২০২৫ সালের জন্য হালনাগাদ করা হয়, তাহলে ‘মদ খাওয়ার’ সেই জায়গা ডরচেস্টার হোটেলের বদলে হতে পারে ‘ট্রাম্প টাওয়ার’।
ক্রিস ডয়েল কাউন্সিল ফর অ্যারাব-ব্রিটিশ আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে (ক্যাবু) পরিচালক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ইসর য় ল ইসর য় ল র র জন য র র জন
এছাড়াও পড়ুন:
খাদি কাপড়ের জিআই স্বীকৃতিতে আনন্দে ভাসছেন কুমিল্লাবাসী
কুমিল্লার ঐতিহ্যের স্মারক খাদি কাপড় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় আনন্দিত জেলার মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা দাবি জানিয়ে আসছিলেন, অবশেষে পেয়েছেন সেই সুখবর। গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে স্বীকৃতির এই সনদ দেওয়া হয়।
কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় এলাকার রামঘাটলা থেকে শুরু করে রাজগঞ্জ পর্যন্ত অন্তত ৩০০ খাদি পোশাকের দোকান। কান্দিরপাড়ের খাদি বসুন্ধরা দোকানের স্বত্বাধিকারী জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, শৈল্পিক ছোঁয়ায় কুমিল্লার খাদি এখন দেশ-বিদেশে বেশ সমাদৃত। ঐতিহ্যের খাদিতে এখন লেগেছে আধুনিকতা ও নান্দনিকতার ছোঁয়া। শত বছরের বেশি পুরোনো খাদির আরও অনেক আগেই জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল। অবশেষে স্বীকৃতি মিলেছে, এতেই আনন্দিত সবাই।
একই এলাকার খাদি জ্যোৎস্না স্টোরের মালিক তপন পাল বলেন, ‘কুমিল্লার প্রতিটি মানুষ খাদির এমন স্বীকৃতিতে আনন্দিত। শত বছর পার হলেও এখনো দেশ-বিদেশে খাদি কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা।’
কুমিল্লার ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সমগ্র ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের সময় কুমিল্লায় খাদিশিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ওই সময় বিদেশি পণ্য বর্জন করার জন্য আওয়াজ ওঠে। সর্বত্র এক আওয়াজ ‘মোটা কাপড়-মোটা ভাত’। সে সময় ভারতবর্ষের মানুষ দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে খাদি পোশাক ব্যবহার শুরু করেছিলেন। খাদের (গর্তে) চরকায় বসে এ কাপড় তৈরি করা হয় বলে এর নামকরণ হয় ‘খাদি’। শুরুতে মহাত্মা গান্ধী নিজেও কুমিল্লায় এসে খাদের চরকায় বসে খাদি কাপড় তৈরিতে উৎসাহ দেন।
এই গবেষক আরও বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারত পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করে নিলে কুমিল্লার খাদিশিল্প সংকটে পড়ে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হাল ধরেন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, জেলা প্রশাসনের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় গত বছর কুমিল্লার রসমালাই জিআই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কুমিল্লার খাদি ও বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের জিআই স্বীকৃতির জন্য তখন থেকেই কাজ শুরু হয়। কুমিল্লার ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে পরিচিত তিনটি পণ্যের মধ্যে দুটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। যে একটি বাকি আছে, সেটিও দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বীকৃতি পাবে বলে তিনি আশাবাদী।