বিএনপির অবস্থান কি গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাবিরোধী?
Published: 5th, April 2025 GMT
রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কমিশনগুলোর প্রস্তাবাবলি নিয়ে বিএনপির মতামত বিভক্ত। কিছু প্রস্তাবের সঙ্গে তারা পুরোপুরি ঐকমত্য পোষণ করেছে এবং কিছুর সঙ্গে আংশিক। অন্যদিকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দলটি অবস্থান নিয়েছে। ফলে অনেকে মনে করছেন, বিএনপি জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের দাবির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, যা গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বেইমানির নামান্তর বলে গণ্য হচ্ছে।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণের মূল কারণ ছিল শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারকে উৎখাত। এ উদ্দেশ্যে সব দল-মত-গোষ্ঠীর মানুষ একত্রিত হয়েছিল। আগস্টের ৩ তারিখে শহীদ মিনারে আয়োজিত সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা’ বিলোপের কথা তুলে ধরলেও এ জন্য কোনো কর্মপরিকল্পনা ছিল না। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি এখন দাবি করতে পারে– তারা বর্তমান প্রস্তাবিত উপায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ সাধনের একটি উপায় বটে, তবে একমাত্র নয়। তাই কমিশনের কিছু সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপি দ্বিমত প্রকাশ করায় দলটিকে গণঅভ্যুত্থানের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা যায় না।
সব সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জায়গা এটি নয়। সব ধরনের বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ জ্ঞানও লেখকের নেই। আমি এ আলোচনায় শুধু সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রস্তাবিত গণভোট এবং সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত মূলনীতির সংশোধন সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়ে কথা বলব।
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদে সংবিধান সংশোধনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনের পর গণভোট আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। বিএনপি দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের বিরোধিতা করেনি, তবে গণভোটের শর্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে।
অনেকে মনে করেন, বর্তমান পদ্ধতি অনুযায়ী সংবিধান পরিবর্তন সহজ হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ যেনতেনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছে, যা দেশকে গভীর রাজনৈতিক সংকটে ফেলেছে। প্রশ্ন হলো, কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সাধারণ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের অধীনে আয়োজিত গণভোটের নিরপেক্ষতা কে নিশ্চিত করবে? সুতরাং বিএনপির গণভোটের বিরোধিতাকে গণঅভ্যুত্থানের দাবির বিরোধিতা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। এটি বরং বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝে একটি বড় দলের উচিত আচরণ প্রদর্শন।
যারা বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানকে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার রক্ষক মনে করেন, তারা আসলে যে সংবিধানকে তাক করে গুলি ছোড়েন, তা পঞ্চম সংশোধনীর পূর্ববর্তী এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর পরের সংবিধান। পঞ্চম সংশোধনীর পরে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার যে অর্থ দাঁড়ায়, তা বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত মূলনীতিগুলোর সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যায়। ‘জাতীয়তাবাদ’ প্রত্যয়টি এখানে শুধু বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নির্দেশ না করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলার কারণে তা বহুত্ববাদী মূল্যবোধকেও লালন করে। এ ছাড়া ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত স্বাধীনতার চেতনাকে সমর্থন করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত মূলনীতি অনুসরণে বিএনপির অনিচ্ছা মানে এই নয়, তারা জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বেইমানি করছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে সংস্কারের সুপারিশ নিয়ে লিখিতভাবে দলীয় মতামত জমা দিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে প্রস্তাবনায় যে ধরনের পরিবর্তনের প্রস্তাব সংবিধান সংস্কার কমিশন দিয়েছে, তাতে তাদের কাছে মনে হয়েছে, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানকে এক কাতারে নিয়ে আসা হয়েছে। এটি জরুরি বলে দলটি মনে করে না। অন্যদিকে কারও কারও মত, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান সমগোত্রীয় না হলেও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা হিসেবে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানকে দেখা যায়। তারা বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শোষণ-নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে যে লড়াই হয়েছিল, তা ২০২৪ সালে দিল্লির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গে তুলনীয়।
তাদের উদ্দেশে বলা যায়, ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান সংবিধানে যুক্ত করেন– ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ ও জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।’ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্তির পেছনে মূল কারণ ছিল দিল্লির ক্ষমতা বলয় থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনার বিষয়কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। এদিক থেকে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতার বদলে বরং ১৯৭৫-এ জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখা যায়। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা হিসেবে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে উপস্থাপন করার চেষ্টাকে বিএনপি ঐতিহাসিক ভুল বলে মনে করলে সেটাকে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বিরোধী শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা যৌক্তিক হবে না।
সংস্কার সম্পর্কিত আলোচনায় বিএনপিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে আস্থায় নেওয়া আবশ্যক। এই আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে দলটিকে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমাসহ তাদের অন্যান্য সংস্কার প্রস্তাব কেন সংস্কার কমিটির প্রস্তাবের চেয়ে উত্তম বা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপে অধিকতর সহায়ক– তা স্পষ্ট করতে হবে।
বিএনপি এবং অন্যান্য ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলের জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণ এবং আগামীতে আরও অংশ নেওয়ার আশ্বাস আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। এর ফলে একটি ঐক্যবদ্ধ সমঝোতায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা জেগেছে, যা থেকে সবার মালিকানাধীন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার ভিত্তি তৈরি হবে। এই সময়ে বাংলাদেশের জনগণের রাষ্ট্রের মালিকানার অনুভূতি তীব্রভাবে প্রয়োজন, যা তাদের রাষ্ট্র গড়ার কাজে আরও সক্রিয় করবে।
ড.
কাজী এ এস এম নুরুল হুদা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
huda@du.ac.bd
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র গণঅভ য ত থ ন র ধ র ব হ কত প রস ত ব র প রস ত ব ত ব এনপ র ব যবস থ র জন য গণভ ট সরক র আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ