বিপুল ব্যয়ের প্রকল্প, তবু পানি মিলছে না
Published: 4th, May 2025 GMT
ওয়াসার পানি নিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর গ্রাহকদের অভিযোগের শেষ নেই। অনেক স্থানে সরবরাহ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। মান নিয়েও আছে প্রশ্ন। সমস্যার সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি ও চুরি। সিস্টেম লসের নামে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে ৩০ শতাংশ পানি। নানা প্রকল্প নেওয়ার সময় অপচয় রোধে কর্মকর্তারা গালভরা যুক্তি তুলে ধরলেও মিলছে না সুফল।
অপচয় বন্ধে পুরোনো পাইপ সরিয়ে স্থাপন করা হচ্ছে নতুন পাইপ, লাগানো হচ্ছে স্মার্ট মিটার। এভাবে একের পর এক হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও সমস্যার আবর্তেই ঘুরপাক খেতে হয় গ্রাহককে। ওয়াসার কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অসাধু মিটার রিডারদের চক্রের হাতে যেন বন্দি সবাই।
চট্টগ্রাম ওয়াসার উৎপাদনের সক্ষমতা ৫৬ কোটি লিটার। এর মধ্যে মদুনাঘাট পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে আসে ৯ কোটি লিটার, কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প-১ এবং ২ থেকে আসে ১৪ কোটি লিটার করে। এ ছাড়া মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে ৯ কোটি লিটার, গভীর নলকূপ থেকে ৪ কোটি লিটার পানি পাওয়া যায়। ভান্ডালজুড়ি পানি শোধনাগার প্রকল্পের সক্ষমতা হচ্ছে ৬ কোটি লিটার। তবে নানা কারণে প্রকল্পগুলো থেকে সক্ষমতা অনুযায়ী পানি পাওয়া যায় না। এর মধ্যে একটি বড় অংশ অপচয়ের নামে চুরি হয়ে যাচ্ছে।
ওয়াসার হিসাব থেকে জানা যায়, দৈনিক গড়ে সাড়ে ৪৭ কোটি লিটার বা ৪ লাখ ৭৫ হাজার কিউবিক মিটার পানি উৎপাদন ও সরবরাহ করে ওয়াসা। এর মধ্যে ৪৭ হাজার ৫০০ কিউবিক মিটার পানি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ৩৭ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। এ থেকে দৈনিক আয় হওয়ার কথা ১৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৪ কোটি ১৩ লাখ ৫ হাজার টাকা। অবশিষ্ট ৪ লাখ ২৭ হাজার ৫০০ কিউবিক মিটার পানি আবাসিক গ্রাহকের কাছে ১৮ টাকা দরে বিক্রি করে দৈনিক আয় হওয়ার কথা ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৮০ কোটি ৮৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। বাণিজ্যিক ও আবাসিক মিলে পানি বিক্রি থেকে বছরে আয় হওয়ার কথা ৩৪৫ কোটি টাকা। ১০ শতাংশ হারে সিস্টেম লস বাদ দিলেও বার্ষিক আয় হওয়ার কথা ৩১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অথচ মাসে এই খাতে আয় আসছে ১৯ থেকে ২০ কোটি টাকা। গড়ে মাসে সাড়ে ১৯ কোটি টাকা হিসাব করলে বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না প্রায় ৭৭ কোটি টাকার।
বর্তমানে ওয়াসার প্রায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার পাইপলাইন নেটওয়ার্ক রয়েছে। এর মধ্যে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-১-এর অধীনে ৪৫ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও স্যানিটেশন প্রকল্পের অধীনে ১৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন নেটওয়ার্ক প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। এ ছাড়া কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-২-এর অধীনে শহরের মধ্যবর্তী স্থানে ৫৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৭০০ কিলোমিটার পাইপলাইন প্রতিস্থাপন করা হয়। এ হিসাবে ৮৯৫ কিলোমিটার পুরোনো পাইপলাইন সরিয়ে নতুন পাইপ স্থাপন করা হয়েছে। এসব পাইপলাইনের আওতায় ৫০ হাজারেরও বেশি গ্রাহক আছেন। এবার ‘চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকার এই প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে ৩ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা, বাংলাদেশ সরকার ৫৭৮ কোটি এবং চট্টগ্রাম ওয়াসা করবে ৭৪ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের অধীনে নগরে আরও ৩০০ কিলোমিটার নতুন পাইপলাইন প্রতিস্থাপন করা হবে। একই সঙ্গে লাগানো হবে ১ লাখ অটোমেটেড স্মার্ট মিটার। এর আওতায় আসবে ৪০ হাজার গ্রাহক। ওয়াসা বলছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে অপচয় রোধ, নিরবচ্ছিন্ন ও সুষম চাপে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। তাতে বাড়বে রাজস্ব আদায়।
ওয়াসার সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমানে পানির দৈনিক চাহিদা ৫৬ কোটি লিটার। ২০৩২ সালে হবে ৭০ কোটি লিটার। ২০৪০ সালে চাহিদা হবে ১২২ কোটি লিটার। পানির বাড়তি চাহিদা বিবেচনায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সংস্থাটি।
সূত্র জানায়, উৎপাদিত পানির প্রায় ৩০ শতাংশ অপচয় হচ্ছ। অথচ বৈশ্বিক মানদণ্ডে এর স্বাভাবিক হার ৫ শতাংশের কম। রাজস্ব শাখার মিটার পরিদর্শকসহ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে সংস্থাটি বড় অঙ্কের রাজস্ব হারায় বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ। ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি ও দুর্বলতার কারণে সংকট নিরসন করতে পারছে না সংস্থাটি।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো.
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ওয়াসার উৎপাদিত পানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নানাভাবে অপচয় ও নয়ছয় হয়। এটির একটি অংশ পাইপলাইন লিকেজের কারণে হয়, আবার চুরিও হয়। ম্যানুয়েল মিটারের কারণে পানি কমবেশি করা যায়। আবার বিপুলসংখ্যক অবৈধ সংযোগের মাধ্যমেও পানি চুরি হয়ে যাচ্ছে। অটোমেটেড স্মার্ট মিটার লাগানোর পাশাপাশি পুরোনো পাইপলাইন সরিয়ে নতুন পাইপলাইন স্থাপন এবং কঠোর কিছু প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া গেলে পানি অপচয় কিংবা চুরি বন্ধ হয়ে আসবে।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরবর হ প রকল প এই প রকল প প রকল প র ন প রকল প র প রকল প কর মকর ত র আওত য় নত ন প উৎপ দ
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারি লবণের তথ্য পৌঁছেনি বিতরণে কারসাজির অভিযোগ
মাদ্রাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ্ বোর্ডিং কর্তৃপক্ষকে কোরবানির চামড়া সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে বিনামূল্যে লবণ সরবরাহ করা হলেও এ থেকে বঞ্চিত হয়েছে কয়েকটি এতিমখানা ও মাদ্রসা। যার কারণে কোরবানির চামড়া সংরক্ষণে নিরুৎসাহিত হয়ে অপেক্ষাকৃত কম দামে ফড়িয়াদের হাতে পশুর চামড়া তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ।
বিভিন্ন মাদ্রাসার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন, যে পরিমাণ লবণ সরকার সরবরাহ করেছে, তা হয়তো যথেষ্ট নয়। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনের চেয়ে প্রাপ্ত লবণের পরিমাণ কম হতে পারে। এতগুলো মাদ্রাসা লবণের তথ্যই জানল না, এক দানা লবণও কেউ পেল না। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তাদের দাবি, স্বল্পতার জন্য নয়, কারসাজির কারণেই বঞ্চিত হয়েছেন তারা।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের রমজান আলী এতিমখানাটি উপজেলার অন্যতম প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচিত একটি প্রতিষ্ঠান। ওখানে ৫২ জন এতিম শিক্ষার্থীর সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এবার ঈদে ওই এতিমখানাটি ৩৬টি কোরবানির পশুর (গরু) চামড়া পেয়েছিল। সেই চামড়া সস্তার বাজারে আরও কম মূল্যে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।
এতিমখানার পরিচালক সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কাসেম আক্ষেপ করে বলেন, চামড়া সংরক্ষণ করার চেষ্টা করেছিলেন তারা। লবণের দামসহ অন্যান্য খরচের কথা চিন্তা করে পরে নামমাত্র দামে তা বিক্রি করে দেন পাইকারদের কাছে। সরকারিভাবে এসব প্রতিষ্ঠানে চামড়া সংরক্ষণে সহায়তা দিতে বিনামূল্যে লবণ সরবরাহ করা হলেও তারা সেটি পাননি।
একই উপজেলার পৈলনপুর দারুল উলুম সাদিলুল রাশাদ মাদ্রাসার সুপার, উপজেলা কওমি মাদ্রাসা ঐক্য পরিষদের সভাপতি মাওলানা মঈনুদ্দিন বলেন, তাঁর মাদ্রাসায় ২৩২টি গরুর চামড়া এসেছিল। লবণের জন্য সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। এতগুলো চামড়ার জন্য অনেক লবণ দরকার ছিল। সেই খরচ পোষাতে পারতেন না তারা। এই উপজেলার ৭৩টি কওমি মাদ্রাসার কোনোটিতেই সরকারের দেওয়া বিনা মূল্যের লবণ সরবরাহ করা হয়নি।
উপজেলার বাদাঘাট এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী স্বপন মিয়া ঈদের পরদিন জনৈক ব্যক্তিকে ফোনে জানান, ৫০০ টাকা করে দিয়ে লবণ পেয়েছেন ৫০ বস্তা। তাঁর এ কথোপকথনের রেকর্ড আছে।
রোববার বিকেলে স্বপন মিয়ার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে, তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁকে ৫০ বস্তা লবণ বিনামূল্যেই দিয়েছেন। লেবার ও নৌকা খরচসহ ৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে তাঁর।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হাসেম বলেন, ১৫০ বস্তা লবণ তাঁর উপজেলার জন্য দেওয়া হয়েছিল। এই লবণ সব মাদ্রাসায় দেওয়া সম্ভব হয়নি। দোয়ারাবাজার ইউএনও অরূপ রতন সিংহ বলেন, সরকারের বিনামূল্যের লবণ পৌঁছে দিতে ইউনিয়ন পরিষদকে কাজে লাগানো হয়েছে। পরিবহন সুবিধার জন্য ইউনিয়ন পরিষদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। জেলা প্রশাসকের ব্যবসা বাণিজ্য শাখার একজন কর্মচারী জানান, লবণ প্রতিটি উপজেলায় সরবরাহ করা হয়েছে। পরিবহন খরচসহ হিসাব করে মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের সুনামগঞ্জের ডেপুটি ম্যানেজার মো. আফিক্স বলেন, সুনামগঞ্জে ৩০ হাজার ৪৮৯টি চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। এজন্য সরকার বিনামূল্যের ১২০ টন লবণ সরবরাহ করেছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানালেন, এই লবণ দিয়ে কমপক্ষে ১৫ দিন চামড়া সংরক্ষণে রাখা সম্ভব হবে।