ধর্মীয় উগ্রতা বা চরমপন্থাকে সমর্থন করে না এনসিপি: নাহিদ ইসলাম
Published: 19th, May 2025 GMT
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, তার দল ইসলামবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করে। ধর্মীয় উগ্রতা বা চরমপন্থাকে সমর্থন করে না। এনসিপি সেক্যুলারিস্ট বা ধর্মতান্ত্রিক-কোনো মতবাদকেই আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করে না। এনসিপি জাতি, ধর্ম বা গোত্রভিত্তিক পরিচয়ের পরিবর্তে সভ্যতাগত জাতীয় পরিচয় ধারণ করে।
সোমবার দুপুরে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ‘কয়েকটি বিষয়ে এনসিপি’র দৃষ্টিভঙ্গি’ শিরোনামে একটি পোস্ট দিয়েছেন নাহিদ ইসলাম। এই পোস্টে নানা বিষয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেছেন তিনি।
ফেসবুক পোস্টে নাহিদ ইসলাম বলেন, বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে একটি নতুন অর্থনৈতিক জোন (অঞ্চল) তৈরির ভিশন আছে এনসিপির।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের পোস্টটি নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো:
‘কয়েকটি বিষয়ে এনসিপি'র দৃষ্টিভঙ্গি-
১। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সাম্য, ইনসাফ ও মানবিক মর্যাদার আদর্শ এবং চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেই এনসিপির পথচলা। এছাড়াও আমরা বাংলার হিন্দু-মুসলমান-দলিতের উপনিবেশবিরোধী ও ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ধারাবাহিকতাকে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করি।
২। এনসিপি নাগরিকের ধর্মবিশ্বাস ও আত্মিক অনুভবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্ম ইসলাম—তার নৈতিকতা ও মানবিকতা এবং বাঙালি মুসলমানের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনচর্চাকে এনসিপি মূল্যায়ন করে। সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে এনসিপি। এনসিপি মনে করে রাষ্ট্রের উচিত প্রতিটি জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অখণ্ডতা রক্ষা করা। এনসিপি ইসলামবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করে এবং ধর্মীয় উগ্রতা বা চরমপন্থাকে সমর্থন করে না। এনসিপি সেকুলারিস্ট বা ধর্মতান্ত্রিক (Theocratic)—কোনো মতবাদকেই আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করে না; বরং ধর্মীয় সহাবস্থান, সম্প্রীতি ও দায়-দরদ অনুশীলনের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়াই এনসিপির লক্ষ্য।
৩। এনসিপি জাতি, ধর্ম বা গোত্রভিত্তিক পরিচয়ের পরিবর্তে সভ্যতাগত জাতীয় পরিচয় ধারণ করে। বহু ভাষা ও সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র বঙ্গীয় বদ্বীপের সভ্যতাগত পরিচয়কে ধারণ করে জাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তুলবে এনসিপি।
৪। নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতায়ন এনসিপির অন্যতম মূলনীতি। নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, নেতৃত্ব ও কর্মসংস্থান নিশ্চিতে এনসিপি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। পারিবারিক আইনের আওতায় সম্পত্তিতে নারীর ন্যায্য অধিকার আদায়ে এনসিপি কাজ করবে।
৫। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও হিন্দুত্ববাদ বাংলাদেশের জন্য একটি সাংস্কৃতিক ও ভূরাজনৈতিক হুমকি। এনসিপি এই আধিপত্যবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে কঠোর রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করবে। এনসিপি মনে করে বাংলাদেশের উচিত ন্যায্যতা, মর্যাদা, সভ্যতা ও জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে অন্য রাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধি করা।
৬। এনসিপি বৈষম্যহীন ইনসাফভিত্তিক দূর্নীতিমুক্ত একটি আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যা একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের অনুরুপ হবে। শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, কৃষি, জলবায়ু, নগর ব্যবস্থাপনা, শ্রম অধিকার ও কর্মসংস্থান হবে এনসিপির প্রধান নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্র। বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে একটি নতুন অর্থনৈতিক জোন তৈরির ভিশন আছে এনসিপির।
৭। এনসিপি বিশ্বাস করে, একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়তে হলে রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনর্গঠন, প্রতিষ্ঠান সংস্কার এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন জরুরি। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করা এনসিপির প্রধানতম রাজনৈতিক কর্তব্য। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের জন্য প্রথম ধাপটি হচ্ছে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার ও নতুন সংবিধান প্রনয়ণ।’
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন হ দ ইসল ম এনস প ন হ দ ইসল ম র জন ত ক ব যবস থ এনস প র
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতিবিপ্লবী রাজনীতি ও গণমাধ্যম
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কামাল আহমেদের লেখা ও পর্যবেক্ষণ আমাদের সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করে তোলায় মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে শুধু রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমের স্বায়ত্তশাসন যথেষ্ট নয়। ব্যক্তি খাতে গণমাধ্যমে কালোটাকার দৌরাত্ম্য, প্রভাবক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং নৈতিক মানের অনুপস্থিতির মতো বিষয়গুলোতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ প্রয়োজন।’
তাঁর (কামাল আহমেদ) সঙ্গে আমরা একমত। তবে তিনি লিবারেল ইকোনমিক পলিসি নামে পরিচিত ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগ’কে যে ইতিবাচক চোখে দেখেন এবং নির্বিচার গ্রহণ করেন, আমি সেভাবে দেখি না, গ্রহণও করি না।
মুক্তবাজার অর্থনীতি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে না। ইউরোপে বাজারব্যবস্থা বিকাশের সঙ্গে গণতন্ত্রের আবির্ভাব ও বিকাশের সম্বন্ধ আছে বটে, কিন্তু একালের কাছাখোলা মুক্তবাজার অর্থনীতি গণতন্ত্রের সহায়ক নয়; বরং গণতন্ত্রের, বিশেষত গণমাধ্যমের ঘাতক। পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলোর দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যায়।
২.কামাল আহমেদ ‘জুলাই সনদে কী থাকছে, কী থাকা উচিত’ (২৬ জুন ২০২৫) নিবন্ধটিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘জুলাই ঘোষণা’ দিতে বাধা দেওয়া নিয়ে কিছু বলেননি। জনগণকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার দলিল হিসেবে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার সিদ্ধান্তে কোনো রাজনৈতিক বা আইনি সমস্যা দেখেননি।
আরও পড়ুনজুলাই ঘোষণা, জুলাই সনদ এবং গণমাধ্যম২১ ঘণ্টা আগে৫ আগস্টে গণ–অভ্যুত্থান হয়েছে, কিন্তু ৮ আগস্টে বিদ্যমান সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বহাল রাখার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবিপ্লবী রাজনীতির বৃত্তে প্রবেশ করে। কামাল আহমেদ ৮ আগস্টের সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব এবং পরবর্তী সময়ে জনগণকে সজ্ঞানে বাদ দেওয়ার প্রতিবিপ্লবী রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকেও ৫ আগস্ট থেকে আলাদা করতে পারেননি।
অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা সরকার লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করছে লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির রাজনৈতিক আধিপত্য নিশ্চিত করার জন্য। এটাও তাঁর কাছে সমস্যা মনে হচ্ছে না।
৩.রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের জনগণের প্রতিনিধি গণ্য করা এবং তাঁদের সঙ্গেই আপসরফা করা আদতে পুরোনো ব্যবস্থাকেই পুনর্বাসিত করা। অধ্যাপক ইউনূস এই ভুল করছেন।
লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির প্রতিনিধিদের সঙ্গেই আপসরফার প্রক্রিয়া গণ-অভ্যুত্থানের মর্মের বিরোধী এবং তিনি সেটা করছেন জনগণকে বাদ দিয়ে। এটাই প্রহসনের জায়গা। কারণ, এই লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণি যদি জনগণের প্রতিনিধি হতো, তাহলে তাদের নেতৃত্বেই গণ–অভ্যুত্থান হতো।
৮ আগস্টের সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের পর তথাকথিত সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন আদতে প্রতিবিপ্লবকেই বৈধতা ও ন্যায্যতা দেওয়ার প্রক্রিয়া।
‘জুলাই সনদ’ বানানোর প্রক্রিয়া জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের স্পিরিট বা মর্মের বিরোধী এবং সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবকে বৈধতা দেওয়ার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।
তথাকথিত জুলাই সনদ লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বন্দোবস্তের দলিলের অধিক কিছু নয়, অধিক কিছু হয়ে ওঠা অসম্ভব।
৪.ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে প্রধান উপদেষ্টা ‘জুলাই ঘোষণা’ দিতে দেননি। ৬ জুন ২০২৫ তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই মাসেই একটি ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করে জাতির সামনে উপস্থাপন করার কথা বলেছেন।
তিনি বলেছেন, তথাকথিত ‘জুলাই সনদে’ একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যে কটিতে একমত, তার তালিকা থাকবে। সেই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে রাজনৈতিক দলগুলো নাকি জাতির কাছে সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে।
ব্যস। এতগুলো মানুষ শহীদ হলো আর এতগুলো মানুষ পঙ্গুত্বের জীবন বরণ করে নিল কেন? লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণি নিজেদের
মধ্যে কোথায় কোন বিষয়ে একমত হলো, সেই সনদের জন্য?
যে রাজনৈতিক দলগুলো শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে কার্যত কিছুই করতে পারেনি, তারা এখন আমাদের ‘জাতীয় সনদ’ উপহার দেবে!
জুলাই সনদ সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবকে বৈধতা ও ন্যায্যতা দেওয়ার দলিল; গণ–অভ্যুত্থানের ঘোষণাকে নস্যাৎ করার প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা।
‘জুলাই সনদ’ প্রকৃতপক্ষে ৫ আগস্টের মৌলিক গঠনতান্ত্রিক মুহূর্তকে (কনস্টিটুয়েন্ট মোমেন্ট) অস্বীকার করার কৌশল, যেখানে জনগণ বিদ্যমান রাষ্ট্রশক্তির বাইরে নতুন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
জুলাই ঘোষণার অধিকার কেড়ে নেওয়া মানে জনগণের অভিপ্রায় ও আকাঙ্ক্ষাকে ‘অদৃশ্য’ করে ফেলা।
৫.জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, তথাকথিত ‘সংস্কার কমিশন’, ‘জুলাই সনদ’ প্রভৃতি মূলত লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিনিধি এবং বিদেশি স্বার্থান্বেষী শক্তির মধ্যকার নতুন বোঝাপড়ার প্রক্রিয়া ও দলিল।
এতে স্পষ্টতই জনগণের অভিপ্রায়ের কথা নেই, আছে ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ’ করে রাস্তায় নামা জনগণকে বাদ দিয়ে ‘ঐকমত্যের নামে’ সংলাপভিত্তিক রাজনৈতিক ক্ষমতা পুনর্বিন্যাসের সমঝোতা।
কামাল আহমেদের লেখায় সংস্কারপন্থী বিবেচনা, যেমন বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, জনপ্রশাসন ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে ‘গণতন্ত্রের কার্যকারিতা’ স্থাপনের দাবি করা হয়েছে।
কিন্তু এগুলো এমন এক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কারচেষ্টা, যার মৌলিক ভিত্তি হলো জনগণ থেকে কর্তৃত্ব কেড়ে নিয়ে শাসকশ্রেণির মধ্যে
ভাগ করে দেওয়া। জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত; বরং এই সংস্কার বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার একটা কারিগরি বা কৌশল।
কামাল আহমেদের লেখার সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রবণতা হলো ‘সবার ঐকমত্যে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ’—এই ভাষ্য। বাস্তবে এই ‘ঐকমত্য’ কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে? কে ঠিক করছে, কোন সুপারিশ গ্রহণযোগ্য, কোনটি নয়?
জনগণের পক্ষ থেকে কোনো গণপরিষদ, গণশুনানি বা প্রতিনিয়ত সংলাপ তো দেখা যাচ্ছে না। জনগণকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য স্থাপনের মধ্য দিয়ে যে ‘সনদ’ তৈরি হয়, তা কোনোভাবেই জনগণের সার্বভৌমত্ব কায়েম করতে পারে না।
৬.কামাল আহমেদের লেখাটিতে গণমাধ্যম সংস্কারের ঘাটতি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে যে উদ্বেগ জানানো হয়েছে, সেটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরে বসে এবং সেই ব্যবস্থাকে অক্ষত রেখে কিছু ‘নৈতিক সংশোধন’ কামনা করা।
কামাল আহেমদের চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে সংবাদমাধ্যমকে একপ্রকারের ‘সরকারি বা করপোরেট স্বাধীনতা’ দেওয়ার চিন্তা ফুটে উঠেছে, যেখানে জনগণের তথ্য নিরীক্ষণের অধিকার ও জনগণের ভাষ্য নির্মাণের অধিকার মোটেও স্বীকৃত নয়।
কামাল আহমেদ শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, নিরাপত্তা, অধিকার ইত্যাদি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সেটা শূন্য বুলি ছাড়া কিছু হয়ে ওঠে না। কারণ, সাংবাদিক হিসেবে তিনি জানেন, এই তথাকথিত সনদ বা কমিশনের মধ্যে শ্রমিকদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এই অবস্থান শ্রমিকশ্রেণিকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সরিয়ে রেখে তাদের আবার ‘সক্ষম শাসকদের দয়া’র অধীন করার চেষ্টা মাত্র।
৭.‘সংস্কার’ কথাটির বিপজ্জনক ব্যবহার সংস্কারপন্থীরা বুঝলেও অনেকে বুঝতে পারেন না। ‘সংস্কার’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে এমনভাবে, যেন শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার দু–এক জায়গায় স্বল্প সংশোধন মানেই গণতন্ত্র। এতেই বুঝি জনগণের অধিকার আদায় হয়ে যাবে।
আসলে ‘সংস্কার’ কথাটি জনগণের অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ কিংবা নতুন গঠনতান্ত্রিক শক্তির দাবিয়ে রাখা বা নির্মূল করার ভাষিক অস্ত্র। জনগণের সার্বভৌম অধিকার হলো নিজেদের নিজেরা রাজনৈতিকভাবে গঠন করার ক্ষমতা, নিজেদের গঠনতন্ত্র, রাষ্ট্রকাঠামো এবং বিশ্বব্যবস্থায় নিজেদের যোগ্য স্থান নির্ধারণের অধিকার—সেটা লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক দলের ‘ঐকমত্যে’ বন্দী হতে পারে না।
৮.কামাল আহমেদের লেখা গুরুত্বপূর্ণ হলেও শেষমেশ লেখাটি সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবকে কৌশলে রক্ষা করার একটি দুর্বল ভাষ্য হয়ে রইল, তার অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারল না।
গণমাধ্যম শুধু জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়ের কাছে জবাবদিহি করে, কিন্তু কোনো করপোরেট স্বার্থ, রাষ্ট্র, আমলাতন্ত্র বা পুলিশি ব্যবস্থার কাছে নয়। গণসার্বভৌমত্বের আলোকে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিয়ে কীভাবে আমরা ভাবব এবং গণমাধ্যমে চর্চা করব, তার কোনো নীতি বা দিশা কামাল আহমেদ দিতে পারলেন না। জনগণের অভ্যুত্থান গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের মধ্য দিয়ে নিজেদের নতুনভাবে গঠন এবং একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য এটা আমাদের প্রয়োজন।
৯.জুলাই ঘোষণা হলো জনগণের নতুন গাঠনিক ক্ষমতার ঘোষণা; লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণির সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য জনগণ অকাতরে শহীদ হয়নি।
গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের অভিপ্রায় এবং জনগণের সামষ্টিক গাঠনিক ক্ষমতা ও গঠনের কর্তব্য ইত্যাদি সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে পুরোনো শাসকেরাই নতুন মুখোশ পরে পুরোনো ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাই বহাল রাখছে।
একে বলা যায় প্রতিবিপ্লবকে (লিগ্যালাইজড কাউন্টার রেভল্যুশন) বৈধতা ও ন্যায্যতা দেওয়ার কৌশল। ফলে সংস্কারের নামে পুরোনো শাসকশ্রেণি ও শাসনকেই চিরস্থায়ী করার আয়োজন চলছে।
কিন্তু জনগণ কি তা মেনে নেবে?
ফরহাদ মজহার কবি, লেখক ও চিন্তক
*মতামত লেখকের নিজস্ব