কেজি দরে সরকারি বই বিক্রি, তোপের মুখে বিদ্যালয় ছাড়লেন প্রধান শিক্ষক
Published: 27th, May 2025 GMT
আক্কেলপুরে কেজি দরে সরকারি বই বিক্রি করা সেই প্রধান শিক্ষক এলাকাবাসীর তোপের মুখে বিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য হলেন। মঙ্গলবার অভিভাবক ও এলাকাবাসী বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে তার অপসারণ চেয়ে বিক্ষোভ করলে নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
অভিযুক্ত শওকত আনোয়ার শ্রীকৃষ্টপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। তিনি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিগত বছরের বই ফেরত নেন। গত রোববার সেই বই জালাল হোসেন নামে এক ব্যক্তির কাছে ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। জালাল হোসেন ভ্যান বোঝাই করে বই নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় কয়েক যুবক তাঁকে আটক করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকায় শোরগোল পড়ে যায়।
নিয়মবহির্ভূতভাবে বইগুলো বিক্রির কথা স্বীকার করেন প্রধান শিক্ষক। বিষয়টি নিয়ে সমকালে সংবাদ প্রকাশ হলে বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ইমরান হোসেনকে।
মঙ্গলবার শিক্ষা কর্মকর্তা বিদ্যালয়ে তদন্ত করতে যান। এ সময় অভিভাবক ও এলাকাবাসী বিদ্যালয়ে এসে প্রধান শিক্ষকের অপসারণ চেয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। প্রধান শিক্ষকের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে বিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যান তদন্তকারী কর্মকর্তা ইমরান হোসেন।
অভিভাবক দেলোয়ার হোসেন বলেন, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বই বিক্রি, ভর্তির জন্য টাকা দাবি করা, স্কুল উন্নয়নের টাকা আত্মসাৎ, প্রাইভেট বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। তিনি দুর্নীতিবাজ শিক্ষক। এরকম শিক্ষককে এই প্রতিষ্ঠানে চাই না। তাঁকে দ্রুত অপসারণ করা হোক।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মঙ্গলবার ঘটনার তদন্ত চলছিল। এ সময় উত্তেজিত অভিভাবকরা তাঁর অপসারণ দাবি করেন। প্রধান শিক্ষকের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাঁকে বিদ্যালয় থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সত্যতা পেলে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বই কর মকর ত তদন ত ব ষয়ট
এছাড়াও পড়ুন:
রাস্তায় শিক্ষকেরা, সিদ্ধান্তহীন সরকার
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছেন মো. ইসমাইল হোসেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি ঢাকার উত্তরখান হাইস্কুলে কৃষিশিক্ষা বিষয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এমপিওভুক্ত (বেতন বাবদ সরকারের অনুদান) শিক্ষক হিসেবে সাকল্যে বেতন পান ১৮ হাজার ৩০০ টাকা।
ইসমাইল হোসেনের মোট বেতনের মধ্যে মূল বেতন ১৬ হাজার টাকা। বাড়িভাড়া ভাতা ১ হাজার টাকা। চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা। এর বাইরে সামান্য কিছু টাকা অন্যান্য সুবিধা হিসেবে পাওয়া যায়। তবে স্কুল থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা তিনি পান না।
ইসমাইল হোসেন ভাড়া বাসায় থাকেন। অনেকটা মেসের মতো, এক কক্ষে তিনজন। তাঁকে দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখনকার বেতন দিয়ে চলতে তাঁর খুব কষ্ট হয়।
বাড়িভাড়া বাড়ানোসহ তিন দফা দাবিতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা গতকাল বুধবার শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। কর্মসূচিতে যোগ দিতে এসেছিলেন ইসমাইল হোসেন। সেখানেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। এ সময় পাশে থাকা অন্য একাধিক শিক্ষক বলেন, কৃষিশিক্ষা, শারীরিক শিক্ষা এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির শিক্ষকদের বেতন কিছুটা বেশি। কিন্তু বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানসহ সাধারণ বিষয়ের শিক্ষকদের শুরুতে মূল বেতন থাকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। সঙ্গে ভাতাসহ বাড়তি কিছুটা সুবিধা যোগ হয়। কিন্তু এই টাকা দিয়ে তাঁদের চলে না।
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে শিক্ষক-কর্মচারীরা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। এর মধ্যে তাঁরা এখন মূল বেতনের ২০ শতাংশ (ন্যূনতম ৩ হাজার টাকা) বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা দেড় হাজার টাকা করা এবং কর্মচারীদের উৎসব ভাতা ৭৫ শতাংশ বাড়ানোর দাবিতে চার দিন ধরে ঢাকায় কর্মসূচি পালন করছেন। কখনো জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায়, কখনো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বা হাইকোর্টের সামনের সড়কে এসব কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দাবির প্রতি সংহতিও জানিয়েছে।
দাবি পূরণ করে প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে গতকাল রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন শিক্ষকেরা। বেলা আড়াইটার দিকে শাহবাগ মোড় অবরোধ শুরু হয়। শেষ হয় বিকেল সাড়ে চারটার দিকে। ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোট’–এর সদস্যসচিব অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজিজী সে সময় বলেন, সরকার তাঁদের দাবি মেনে না নিলে আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখে লংমার্চ করবেন তাঁরা। বর্তমানে তাঁরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান করছেন।
শিক্ষক-কর্মচারীরা যখন ঢাকায় এমন কর্মসূচি পালন করছেন, তখন একই দাবিতে সারা দেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে কর্মবিরতি। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাবর্ষের শেষ সময়ে এসে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ক্ষতির মুখে পড়েছে। আর রাস্তার আন্দোলনে শিক্ষকদের যেমন কষ্ট হচ্ছে, তেমনি সাধারণ মানুষকেও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। তবে এমন পরিস্থিতি চললেও সরকারের পক্ষ থেকে, বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তা নিরসনে এখন পর্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বরং গত ৩০ সেপ্টেম্বর এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ভাতা মাত্র ৫০০ টাকা বাড়ানোর বিষয়ে অর্থ বিভাগের সম্মতিপত্র প্রকাশ করা হয়। এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ বেড়েছে। শিক্ষকদের ভাষ্য, এই ‘সামান্য’ ভাতা বৃদ্ধি তাঁদের জন্য লজ্জাকর। তাঁরা চান মূল বেতনের শতকরা ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া ভাতা। শতকরা হারে বাড়িভাড়া ভাতা চাওয়ার পেছনে শিক্ষকদের যুক্তি হলো, এটি করা হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে, বিশেষ করে পরবর্তী নতুন বেতন স্কেল করার সময় বাড়িভাড়া ভাতার পরিমাণ বাড়বে।
কী ভাবছে সরকার, কত টাকা দরকারমৌলিক অধিকার শিক্ষা সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করার জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন–ভাতার জন্য আর্থিক অনুদান দেয় সরকার, যা এমপিও (মান্থলি পে অর্ডার) নামে পরিচিত। বর্তমানে সারা দেশে ছয় লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে আছেন ৩ লাখ ৯৮ হাজার, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে পৌনে ২ লাখের মতো এবং কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে আছেন ২৩ হাজারের বেশি শিক্ষক ও কর্মচারী। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয় বেশি, তারা এমপিওর বাইরে শিক্ষক ও কর্মচারীদের টাকা দেয়। তবে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সেই সক্ষমতা থাকে না।
শিক্ষকেরা এখন ভাতা বাড়ানোর দাবি করছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও চায় মূল বেতনের শতকরা হারে বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ানো উচিত। এ জন্য ৫০০ টাকা বাড়ানোর বিষয়ে অর্থ বিভাগ সম্মতিপত্র দিলেও সেটি কার্যকরের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশাসনিক আদেশ জারি করেনি। বরং মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাড়িভাড়ার সম্ভাব্য চার ধরনের হার ঠিক করে তাতে কত টাকা লাগবে, তার প্রাক্কলন করে অর্থ বিভাগকে দিয়েছে। সেখান থেকে সরকারের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ বিভাগ যেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করে, তার অনুরোধ করা হয়েছে।
শতকরা হারে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৫ অক্টোবর অর্থ বিভাগকে অনুরোধপত্র পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া দিলে বছরে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, ১৫ শতাংশ হারে দিলে ২ হাজার ৪৩৯ কোটি, ১০ শতাংশ হারে দিলে ১ হাজার ৭৬৯ কোটি এবং ৫ শতাংশ হারে দিলে ১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে।
এ বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব রেহানা পারভীনের বক্তব্য নিতে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবির সঙ্গে একমত। এখন সিদ্ধান্ত দেবে অর্থ বিভাগ।
জানা গেছে, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও অর্থ বিভাগের সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) বার্ষিক সম্মেলনে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। ২২ অক্টোবর তাঁদের দেশে ফেরার কথা। তাঁরা দেশে না থাকায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্তও নেওয়া যাচ্ছে না বলে সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, বিষয়টি অর্থসচিবকে জানানো হয়েছে। এখন এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগের দুজন কর্মকর্তা কাজ করছেন।
‘আমরা মানবেতর জীবন যাপন করি’কেউ কেউ মনে করেন, চলতি বছরের বাজেটে অর্থ সংস্থান করা হয়নি। মাঝামাঝি এসে মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া নির্ধারণ কঠিন। সরকারের একটি ভাবনা হলো ১০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া বাড়ানো। কিন্তু আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা বলছেন এটা তাঁরা মানবেন না। কারণ, তাতে তেমন লাভ হবে না।
অন্যদিকে কেউ কেউ চান সিদ্ধান্তটি পরবর্তী নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করুক। তবে আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা হুমকি দিয়েছেন, এবার দাবি আদায় না করে তাঁরা বাড়ি ফিরবেন না। প্রয়োজনে আমরণ অনশন করবেন।
ঢাকার আন্দোলনে অংশ নিতে নরসিংদীর মনোহরদী থেকে আসা একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মানবেতর জীবন যাপন করি। আমাদের যে বেতন, তা দিয়ে কিছুই হয় না। তাই আমাদের যৌক্তিক দাবি যেন সরকার মেনে নেয়।’