দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার ক্ষেত্রে শর্ত যোগ করার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানান দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের নবম দিনের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

আলোচনা শেষে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আজ নতুন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যোগ করেছি। যদি কোনো ব্যক্তিগত অপরাধ, যেমন হত্যাকাণ্ড ঘটে এবং দোষী ব্যক্তিকে দণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে ভুক্তভোগী পরিবারের সম্মতি ছাড়া রাষ্ট্রপতি বা কমিটি এককভাবে সেই সাজা মাফ করতে পারবেন না। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সম্মতি দিলে, তবেই ক্ষমা বিবেচনায় আসবে। এতে ইনসাফ (ন্যায়বিচার) নিশ্চিত হবে।’

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীর পরিবার বা ভুক্তভোগীর সম্মতি ছাড়া কাউকে ক্ষমা না করার নীতিতে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে বলেও জানান জামায়াতের এই নায়েবে আমির।

অতীতে রাষ্ট্রপতির একক সিদ্ধান্তে চিহ্নিত অপরাধীদের ক্ষমা করার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করে জামায়াতের এই নেতা বলেন, এটা ছিল ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। তিনি বলেন, সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবারের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের আগে একটি সুপারিশ কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমার বিষয়ে পরামর্শ দেবে।

হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হয় বলে জানান আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, ২০ কোটি মানুষের দেশে সবাই ঢাকায় এসে বিচার পাওয়ার সুযোগ রাখে না। তাই বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে বিচারসেবা মানুষের আরও কাছাকাছি পৌঁছাবে।

জামায়াতের এই নায়েবে আমির বলেন, বিচারপতি ও দক্ষ আইনজীবীর ঘাটতির কথা এলেও প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, মেধাবী ব্যক্তিদের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে এ ঘাটতি পূরণ সম্ভব।

আর সংবিধানে একটি একক সুপ্রিম কোর্ট রাখার বিষয়টি অপরিবর্তিত রেখে বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখন স্পষ্ট ঐকমত্য তৈরি হয়েছে বলেও জানান আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আজকের আলোচনায় বিএনপিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি মো.

এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার ও মো. আইয়ুব মিয়া এতে উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা সঞ্চালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) মনির হায়দার।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রস ত ব র জন ত ক য গ কর

এছাড়াও পড়ুন:

আবারও কি সংস্কারের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে

গত ২১ মে প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে আমি সুপারিশ করেছিলাম যে সংস্কারের বিষয়ে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলাদাভাবে ‘সাইলো পদ্ধতি’র আলোচনা প্রলম্বিত না করে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণসম্পন্ন ‘উন্মুক্ত পদ্ধতি’র আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন। এর দুটি সুফলের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।

একটি হলো, এর ফলে বিভিন্ন সংস্কার সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবে। আরেকটি হলো, আলোচনা উন্মুক্ত হওয়ার কারণে জনগণও তা জানতে পারবে। তাতে রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার প্রসঙ্গে অযৌক্তিক অবস্থান গ্রহণের বিষয়ে সতর্ক হবে। কারণ, সে ক্ষেত্রে জনমত তাদের বিপক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে উন্মুক্ত আলোচনা ঐকমত্য অর্জনে সহায়ক হবে।

এটি আনন্দের বিষয় যে গত ১৭ জুন থেকে ঐকমত্য কমিশন সংস্কার নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনার আয়োজন করেছে এবং তা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারও করছে। এর সুফলও দৃশ্যমান হচ্ছে।

বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সব রাজনৈতিক দলের নেতারা এক স্থানে মিলিত হয়ে জনসমক্ষে সমপাটাতনে ‘সভ্য-শান্তভাবে’ গঠনমূলক আলোচনা করছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক ঘটনা।

২.

সেই নিবন্ধে করা আমার দ্বিতীয় সুপারিশ ছিল, সব সংস্কার প্রস্তাবের পরিবর্তে গুরুত্বপূর্ণ একগুচ্ছ পরস্পর–সম্পর্কিত রাজনৈতিক (মূলত সংবিধান ও নির্বাচন–সংক্রান্ত) সংস্কারের প্রতি বেশি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা শ্রেয় হবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেও উৎসাহজনক যে আলোচনা শেষ পর্যন্ত এ ধরনের সংস্কার প্রস্তাবের ওপরই নিবদ্ধ হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদে বিরোধী দল থেকে নিয়োগ, ৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ এবং নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির বিষয়ে মোটাদাগে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কিন্তু এগুলোর খুঁটিনাটি বিষয়ে এখনো মতানৈক্য রয়ে গেছে।

অনেকগুলো বিষয়ে মোটাদাগে ঐকমত্যে পৌঁছানোও দুরূহ বলে প্রতিভাত হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আনুপাতিক নির্বাচন, সংসদের উচ্চকক্ষের গঠনপ্রণালি, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি, প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন থাকার ওপর সময়সীমা আরোপ এবং জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল ও তার কার্যাবলি ইত্যাদি।

৩.

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সম্পর্কে ঐকমত্যের সম্ভাবনা দেখা কঠিন। সেই কারণে রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে, তার পদ্ধতি তথা ‘মেকানিকস’–এর ওপর মনোযোগ নিবদ্ধ করাই শ্রেয়।

মতাদর্শগত ভিন্নতা সত্ত্বেও এই মেকানিকস সম্পর্কে একমত হওয়া সম্ভব। কারণ, সংখ্যালঘিষ্ঠের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন না করে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে—এই মৌলনীতির বিষয়ে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সবারই একমত হওয়ার কথা। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই নীতি বাস্তবায়নের শ্রেষ্ঠ পন্থা কী?

মোটাদাগে, দুটি পন্থা রয়েছে। একটি হলো আসনভিত্তিক নির্বাচন এবং অন্যটি আনুপাতিক নির্বাচন। আনুপাতিক নির্বাচনে যে দল কিংবা দলগুলো সম্মিলিতভাবে ৫০ কিংবা ততোধিক শতাংশ ভোটারের সমর্থন পাবে, তারা সরকার গঠন করবে। পক্ষান্তরে আসনভিত্তিক নির্বাচনে যে দল কিংবা দলগুলো সম্মিলিতভাবে ৫০ কিংবা ততোধিক শতাংশ আসনে বিজয়ী হবে, তারা সরকার গঠন করবে।

দ্বিতীয় পদ্ধতির দুর্বলতা হলো, যেহেতু প্রতিটি আসনে সরল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বিজয়ী নির্ধারিত হয়, সেহেতু সারা দেশে মোট ৫০ শতাংশের অনেক কম ভোট পেয়েও একটি দল কিংবা জোট সংসদে ৫০ শতাংশের বেশি আসন পেতে পারে ও সরকার গঠন করতে পারে। যেমন ২০০১ সালে বিএনপি ৪৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ৬৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ আসন পেয়েছিল ও সরকার গঠন করেছিল। একইভাবে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ৭৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ আসন পেয়েছিল ও সরকার গঠন করেছিল।

৪.

আসনভিত্তিক নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশের সংসদে কখনো সব মতাদর্শের রাজনৈতিক দলের প্রকৃত জনসমর্থন (ভোটের অনুপাত) অনুযায়ী প্রতিনিধিত্ব অর্জিত হয়নি। এ কারণে তাদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সহযোগিতার সংস্কৃতি অগ্রসর হয়নি।

বিদ্যমান নির্বাচনব্যবস্থা বরং প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকে একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কারণ, এই ব্যবস্থার অধীনে সামান্য কয়েক শতাংশ ভোট এদিক-ওদিক করার মাধ্যমেই সামগ্রিক নির্বাচনী ফলাফল উল্টে দেওয়া যায়। এর ফলে নির্বাচন নিয়ে সব ধরনের অনিয়ম উৎসাহিত হয়েছে। অর্থ, পেশিশক্তি, প্রশাসনের অপব্যবহার ইত্যাদি চরমমাত্রায় পৌঁছায়।

সংসদ বহুলাংশে অসাধু ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি, মজুতদার, মাদক ব্যবসায়ী ইত্যাদি ধরনের লোকজন দ্বারা আকীর্ণ হয়ে পড়ে। নির্বাচনব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছিল ও সংসদীয় গণতন্ত্র অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল।

এসব অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর অনেক রাজনৈতিক দল আনুপাতিক নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে মনে হয়েছিল, এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, সেটা হয়তো দুরাশাই ছিল।

একটি বড় ও প্রভাবশালী দলসহ আরও কয়েকটি দল শুধু নিম্নকক্ষ আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হওয়ার বিরুদ্ধে নয়, তারা উচ্চকক্ষের নির্বাচন আনুপাতিক পদ্ধতিতে করার আপসমূলক প্রস্তাবেরও বিরোধী।

৫.

২০২৪ সালে প্রকাশিত রাষ্ট্র সংস্কার ও সংবিধান সংশোধনীশীর্ষক গ্রন্থে আমি ১১টি রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবের যে বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছিলাম, তাতে দেখা গিয়েছিল যে অধিকাংশ প্রস্তাবের কার্যকারিতার জন্য আনুপাতিক নির্বাচনের প্রয়োজন। এর মূল কারণ হলো, নির্বাচন আনুপাতিক হলে নিশ্চিত করা যায় যে সংসদে যেকোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার জন্য ভোটারদের (তথা জনগণের) কমপক্ষে ৫০ শতাংশের সমর্থন থাকবে।

সম্প্রতি বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ আনুপাতিক নির্বাচন সম্পর্কে আপত্তি জানাতে গিয়ে অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে এ ব্যবস্থার অধীন সংসদে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। কারণ, বাংলাদেশে (সম্প্রতিক কালে) কোনো দল ৫০ শতাংশ কিংবা তার বেশি ভোট পায়নি (প্রথম আলো, ২০ জুন ২০২৫)।

তাঁর (সালাহউদ্দিন আহমদ) এই পর্যবেক্ষণ বরং আনুপাতিক নির্বাচনের শক্তির দিকই তুলে ধরে। কারণ, ৫০ শতাংশের কম ভোটের সরকার বস্তুত একটি সংখ্যালঘিষ্ঠের সরকার। আনুপাতিক নির্বাচন এ ধরনের সরকার নাকচ করে।

এ ধরনের নির্বাচনব্যবস্থা ৫০ শতাংশের কম ভোটপ্রাপ্ত দলকে বাধ্য করে সম অথবা কাছাকাছি মতাবলম্বী দল বা দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠন করতে। ফলে কোনো একক দলের স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয় এবং সেই দলের প্রধানের স্বৈরাচার হওয়ার সম্ভাবনাও কঠিন হয়ে পড়ে।

৬.

বাংলাদেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে আনুপাতিক নির্বাচনের ১১টি সুফলের কথা আমি ওই বইয়ে তুলে ধরেছি। এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে সেগুলোর বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। তবে লক্ষ করা যেতে পারে যে ঐকমত্য কমিশনের চলমান আলোচনায় যেসব বিষয়ে মতৈক্য অর্জনের জন্য যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে, তার অনেকগুলোরই সহজ সমাধান আনুপাতিক নির্বাচনের অধীনে সম্ভব। যেমন ধরা যাক, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর ইস্যু।

বর্তমানে পৃথক আসন সৃষ্টির মাধ্যমে নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তা করা হচ্ছে। এসব আসন ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নাকি বর্তমানের প্রতি তিনটি আসনকে একত্র করে চিহ্নিত হবে, তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। যেভাবেই হোক না কেন, এতে করে একই আসনে একাধিক সংসদ সদস্যের উপস্থিতি এড়ানো যাবে না।

বড় কথা, এভাবে নির্বাচিত হলে নারী সংসদ সদস্যরা বিশেষ কোটার অধীন নির্বাচিত বলে বিবেচিত হবেন। সে ক্ষেত্রে তাঁদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণি’র সংসদ সদস্য বলে পরিগণিত হওয়া ও জনমনে পূর্ণ মর্যাদা না পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে নারী প্রতিনিধিত্ব অর্জনের মূল লক্ষ্য ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে।

পক্ষান্তরে আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনে সব দলকে স্বীয় প্রার্থী তালিকায় একটি কাঙ্ক্ষিত আনুপাতের নারী প্রার্থীর অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করে দেওয়া যেতে পারে। এভাবে যেসব নারী সংসদ সদস্য হবেন, তাঁরা পুরুষ সদস্যের সমমর্যাদাসম্পন্ন হবেন।

আরেকটি উদাহরণ দেখা যেতে পারে প্রস্তাবিত জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন বিষয়ে। এর গঠন ও কর্মপরিধি—উভয় নিয়েই বিতর্ক অব্যাহত আছে। মনে হচ্ছে, আলোচনাক্রমে এর কর্মপরিধি ক্রমেই সংকুচিত হয়ে কেবল বিভিন্ন সাংবিধানিক কমিশন গঠনে সীমাবদ্ধ হচ্ছে।

আপাতদৃষ্টে এনসিসি গঠনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাংবিধানিক কমিশনগুলোর দলীয়করণ প্রতিহত করা। এর জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশন যে ৯ সদস্যের এনসিসি গঠনের প্রস্তাব করেছে, তাতে সরকারি দলের প্রাধান্য এড়ানো যাবে কি না, সন্দেহ।

এ ক্ষেত্রেও আনুপাতিক নির্বাচন একটি সহজ উপায় করে দিতে পারে এবং তা হলো, এসব কমিশনের গঠন সংসদের কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন সাপেক্ষে করা। সে ক্ষেত্রে সরকারি দল অথবা জোটকে প্রায় অনিবার্যভাবেই সাংবিধানিক কমিশনগুলোয় অন্তর্ভুক্তির জন্য এমন ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে হবে যাঁদের প্রত্যাখ্যান করা বিরোধী দলের জন্যও কঠিন হবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্যও একই বিধান করা যেতে পারে।

একইভাবে আনুপাতিক নির্বাচন প্রবর্তিত হলে বাংলাদেশে সংসদের উচ্চকক্ষের তেমন প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। রাজনৈতিক দলগুলো যে ধরনের ব্যক্তিদের এই কক্ষে দেখতে চায়, তাঁদের সংসদের জন্য স্বীয় প্রার্থী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমেই এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।

ফলে উচ্চকক্ষের গঠন এবং উচ্চ ও নিম্নকক্ষের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে বর্তমানে যেসব মতানৈক্যের সৃষ্টি হচ্ছে, সেগুলো এড়ানো যাবে। নির্বাচনে অর্থ ও পেশিশক্তির প্রভাব হ্রাস পাবে। রাজনীতিতে ও সংসদে যোগ্য ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ বাড়বে। ‘জমিদার এমপি’দের উদ্ভব প্রতিরুদ্ধ হবে এবং তা স্থানীয় সরকারের বিকাশ অর্জনে সহায়ক হবে। সব মিলিয়ে, আনুপাতিক নির্বাচন হতে পারে ‘সব সংস্কারের মাতা’।

৭.

এটি অপ্রত্যাশিত নয়, ভোটারদের মধ্যে তার সরল সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে বলে বিশ্বাসী এমন রাজনৈতিক দল আনুপাতিক নির্বাচনের বিরোধিতা করবে। তবে জাতির ইতিহাসে কিছু মাহেন্দ্রক্ষণের আবির্ভাব ঘটে, যখন ব্যক্তি ও দল স্বীয় সংকীর্ণ স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে।

১৯৯০ সালের গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সময় তিন জোটের একটি রূপরেখাও প্রণীত হয়েছিল। তবে তাতে রাষ্ট্রপতি শাসিতব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় উত্তরণের ইস্যু প্রাধান্য পেয়েছিল। দুঃখজনকভাবে, তখন আনুপাতিক নির্বাচনের বিষয়টি তাতে আসেনি। যদি আসত, তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস অন্য রকম হতে পারত।

২০২৪ সালের জুলাই গণ–অভ্যুত্থান বাংলাদেশের জন্য আরেকটি মাহেন্দ্রক্ষণের সৃষ্টি করেছে, যখন আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তনের সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে। তবে পরিস্থিতি যেমন এগোচ্ছে, তাতে এ বিষয়ে আশাবাদী হওয়া কঠিন। এ কারণে প্রশ্ন উঠেছে, অর্থবহ রাজনৈতিক সংস্কারের আরেকটি সুযোগ কি হাতছাড়া হতে যাচ্ছে?

নজরুল ইসলাম অধ্যাপক, এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন গবেষণার সাবেক প্রধান

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কোন কোন অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য, সে ব্যাপারে আইনি ব্যাখ্যা থাকা উচিত: এনসিপি
  • বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠায় ঐকমত্য হয়েছে: আলী রীয়াজ
  • রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ও বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য
  • আত্মত্যাগের পথ পেরিয়ে সুযোগ এসেছে, হেলায় হারানো যাবে না: আলী রীয়া
  • প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগ নিয়ে আলোচনায় একাধিক প্রস্তাব
  • নির্বাচনী রাজনীতি কোন দিকে গড়াচ্ছে?
  • তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দ্বিমত নেই : আলী রীয়া
  • জুলাইয়ের মাঝামাঝি একটা অবস্থানে পৌঁছার ব্যাপারে আশাবাদী আলী রীয়াজ
  • আবারও কি সংস্কারের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে