দেশে গত এক বছরে ১৩ লাখ মেট্রিক টনের মতো চাল আমদানি হয়েছে। গত বোরো মৌসুমে ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু এতে চালের দাম কমেনি, বরং বাড়ছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, বাজারে মোটা চালের সর্বনিম্ন দর উঠেছে প্রতি কেজি ৫৫ টাকায়, যা এক মাস আগে ছিল ৫০ টাকা। মাঝারি চালের কেজি ৬০-৬৫ টাকা। সরু চাল কিনতে লাগছে প্রতি কেজি ৭৫-৮৫ টাকা।

চালের এই মূল্যবৃদ্ধি শুরু হয় মূলত ২০২০ সালের শুরু থেকে। তখন প্রতি কেজি মোটা চালের দর ছিল ৩০-৩৫ টাকা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার নানা পদক্ষেপের কথা বলেও চালের দাম কমাতে পারেনি। এখনো সেটা কমছে না।

তানিয়া বলেন, সংসারের খরচ নিত্য বাড়ছে। অথচ বেতন কিন্তু বাড়ছে না। এভাবে দাম বাড়লে সংসারে চালাবেন কী করে, প্রশ্ন তাঁর।

চাল দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য। চালের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব সবচেয়ে বেশি হয়। আর দরিদ্র পরিবারে ব্যয়ের বড় একটি খাত হলো চাল কেনা।

রাজধানীর কাজীপাড়ার মোসলেম উদ্দিনের দোকানে গতকাল রোববার নিত্যপণ্য কিনছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা তানিয়া বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর পরিবারে প্রতি মাসে মিনিকেট চালের ২৫ কেজির একটি বস্তা কেনা হয়। পবিত্র ঈদুল আজহার আগে এক বস্তা চাল ২ হাজার ১৫০ টাকায় নিয়েছিলেন। কয়েক দিন আগে সেই একই চালের বস্তা নিয়েছেন ২ হাজার ৩০০ টাকায়। বেশি পড়েছে কেজিপ্রতি ৬ টাকা।

তানিয়া বলেন, সংসারের খরচ নিত্য বাড়ছে। অথচ বেতন কিন্তু বাড়ছে না। এভাবে দাম বাড়লে সংসারে চালাবেন কী করে, প্রশ্ন তাঁর।

ঢাকায় চালের দাম

বোরো মৌসুমে দেশে দুই কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদিত হয়, যা সারা বছরের মোট উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি। বোরোর ভরা মৌসুমে সাধারণত চালের দাম অনেকটাই কমে যায়। এবার কিছুটা কমেছে। তবে মোটা চালের কেজি ৫০ টাকা বা বেশি ছিল।

সাধারণত মে মাস পর্যন্ত বোরো মৌসুম ধরা হয়। এবার দেখা গেছে, জুনেই চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। টিসিবির হিসাবে, মোটা চালের কেজি যেমন ৫ টাকা বেড়েছে, তেমনি মাঝারি চালের দর কেজিপ্রতি ৩-৭ টাকা এবং সরু চাল ৩-৫ টাকা বেড়েছে।

৫৫ টাকা কেজিতে যে মোটা চাল বিক্রি হয়, তা সাধারণত সব বাজারে পাওয়া যায় না। নিম্ন আয়ের মানুষকে চাল কিনতে হয় মূলত ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে। রাজধানীর কাজীপাড়ার বাইশবাড়ী এলাকা ও পশ্চিম তেজতুরী বাজারের মুদিদোকান এবং কারওয়ান বাজারের আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, মানভেদে পাইজাম চাল ৬০-৬২ টাকা এবং বিআর আটাশ ৬০-৬৫ টাকা দরে বিক্রি হয়। এই চালই মূলত নিম্নবিত্তের মানুষেরা কেনেন।

কাজীপাড়ার বাইশবাড়ী জেনারেল স্টোরের মালিক মোসলেম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মোজাম্মেল ব্র্যান্ডের মিনিকেট চাল বিক্রি করেন। ১৫ দিন আগে মিনিকেট চালের ৫০ কেজির বস্তা ৩ হাজার ৮০০ টাকায় কিনেছেন। গত শুক্রবার তা কিনেছেন ৪ হাজার ১০০ টাকায়। তাই তাঁকেও বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

সাধারণত মে মাস পর্যন্ত বোরো মৌসুম ধরা হয়। এবার দেখা গেছে, জুনেই চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। টিসিবির হিসাবে, মোটা চালের কেজি যেমন ৫ টাকা বেড়েছে, তেমনি মাঝারি চালের দর কেজিপ্রতি ৩-৭ টাকা এবং সরু চাল ৩-৫ টাকা বেড়েছে।আমদানি ১৩ লাখ টন

দেশে গত আগস্টে বন্যায় আমনের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তখন সরকার শুল্ক কমানো ও ১০ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৩ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে সরকারিভাবে এসেছে ৮ লাখ ৩৫ হাজার টন। বেসরকারি আমদানিকারকেরা এনেছেন প্রায় ৪ লাখ ৭০ হাজার টন চাল। একই সময়ে ৬২ লাখ টন গমও আমদানি হয়েছে।

সরকারের কাছে এখন খাদ্যশস্য মজুত আছে প্রায় ১৮ লাখ টন, যা সন্তোষজনক বলে গণ্য করা হয়। এর মধ্যে ১৫ লাখ টনের বেশি চাল।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে চাল আমদানি সাধারণত নিষিদ্ধ থাকে। সরকার বিশেষ অনুমতি দিয়ে চাল আমদানি করে। বিশেষ অনুমতির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। শুল্কছাড়ের মেয়াদও শেষ। এ কারণে চাল আমদানি হচ্ছে না। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।বিশ্ববাজারে দাম কমেছে

বিশ্ববাজারে চালের দাম কমেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে থাইল্যান্ড ৫ শতাংশ ভাঙা চালের প্রতি টনের গড় দাম ছিল ৫৮৬ ডলার, যা গত মাস জুনে নেমেছে ৪১৯ ডলারে। ভিয়েতনামের চাল ৫৪৩ ডলার থেকে কমে নেমেছে ৩৭৭ ডলারে। গত জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় চালের দাম কম।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে চাল আমদানি সাধারণত নিষিদ্ধ থাকে। সরকার বিশেষ অনুমতি দিয়ে চাল আমদানি করে। বিশেষ অনুমতির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। শুল্কছাড়ের মেয়াদও শেষ। এ কারণে চাল আমদানি হচ্ছে না। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্কহার অনুযায়ী, চাল আমদানিতে মোট শুল্ক–কর এখন সাড়ে ৬৭ শতাংশ।

বেনাপোল আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো.

জিয়াউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ এপ্রিলের পর চাল আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। যেসব আমদানিকারক অনুমতি পেয়েছিলেন, তাঁদের ওই সময়ের মধ্যে আমদানির জন্য বলা হয়েছিল। শুল্কছাড়ও উঠে গেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ভারতীয় চাল আমদানি হয় মূলত বর্ধমান থেকে। সেখানে প্রতি কেজির দর ৩৪ রুপি। বাংলাদেশে আনতে কেজি পড়বে ৫৩-৫৪ টাকা।

করণীয় কী

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০২২ সালের পর ডলারের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। ফলে দেশি চাল ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের বাজার সুরক্ষা পেয়েছেন। বিদেশ থেকে চাল আমদানির খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ফলে দেশীয় ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হচ্ছে না। বড় ব্যবসায়ীরা বিপুল বিনিয়োগ করে ধান-চাল কিনে রাখছেন। তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট একটি সংস্থার একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ীরা যদি মুনাফার সুযোগ দেখতে পান, সেখানে বিনিয়োগ করবেন, ধান-চাল মজুত করবেন; এটা থামানো যাবে না। তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে শুল্ক–কর তুলে নিয়ে চাল আমদানি অবাধ করে দিতে হবে। তিনি বলেন, সরকার তিন মাসের জন্য শুল্ক–কর তুলে নিয়ে আমদানি উন্মুক্ত করে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, তা দেখতে পারে।

অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে বাজারে ঋণপ্রবাহ কমানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে। মূল্যস্ফীতি কমেছে। তবে তা এখনো চড়া, ৯ শতাংশের বেশি (মে, ২০২৫)। অন্যদিকে অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য কম থাকায় কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ কম।

চাল উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সে ক্ষেত্রে ঠিক সময় আমদানি করতে হবে, যাতে চাহিদাজনিত চাপ চালের বাজারে আলাদা সংকট সৃষ্টি করতে না পারে। সরবরাহ ঠিক থাকার কারণে এবার রোজার সময় অনেক পণ্যের দাম সেভাবে বাড়েনি। সরকারের সেই চেষ্টা সামগ্রিকভাবে সারা বছর ধরে দেখা যাচ্ছে না।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু মুদ্রানীতির ওপর জোর দিয়েছে। তাতে হবে না। বাজার ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ঠিকমতো আছে কি না, সেই দিক খেয়াল রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে দেশে উৎপাদন যদি যথেষ্ট না হয়, সঠিক সময় আমদানিটা নিশ্চিত করতে হবে।

দেশে মূল্যস্ফীতি মূলত সরবরাহ–সংকটের কারণে উল্লেখ করে সেলিম রায়হান বলেন, চাল উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সে ক্ষেত্রে ঠিক সময় আমদানি করতে হবে, যাতে চাহিদাজনিত চাপ চালের বাজারে আলাদা সংকট সৃষ্টি করতে না পারে। সরবরাহ ঠিক থাকার কারণে এবার রোজার সময় অনেক পণ্যের দাম সেভাবে বাড়েনি। সরকারের সেই চেষ্টা সামগ্রিকভাবে সারা বছর ধরে দেখা যাচ্ছে না।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চ ল র দ ম কম প রথম আল ক ব যবস য় র চ ল আমদ ন স ধ রণত সরক র র সরবর হ ব শ বব ১৩ ল খ ল খ টন উৎপ দ

এছাড়াও পড়ুন:

কার্ড কৃষকের, গুদামে ধান দেন মিলার-নেতারা

প্রচুর উৎপাদন, ভালো দাম। তবু ঘাম ঝরানো ফসল হাতে নিয়ে হতাশ কৃষক। সরকার নির্ধারিত মূল্যে গুদামে ধান বিক্রি করতে পারছেন না তারা। মুনাফা গিলছেন রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, মিলার ও কিছু সরকারি কর্মকর্তা। কৃষকের নামে কার্ড; কিন্তু সরকারি গুদামে ধান দিচ্ছেন রাজনৈতিক নেতা ও মিল মালিক। কৃষককে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করে বাড়তি লাভ নিচ্ছে ফড়িয়া সিন্ডিকেট। এভাবেই প্রকৃত কৃষক বঞ্চিত হচ্ছেন সরকারের দেওয়া সুযোগ থেকে। 

চলতি বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি ধান ৩৬ এবং চালের মূল্য ৪৯ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। প্রতি মণ ধানের দাম ১ হাজার ৪৪০ টাকা, যা বাজারমূল্যের চেয়ে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা বেশি। ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রতি বছরই কৃষক পর্যায় থেকে সরকারিভাবে ধান কেনার খবর ছড়িয়ে দিতে চেষ্টার কমতি থাকে না খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের। তবে বাড়তি দাম কৃষকের মধ্যে আশা জাগালেও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল থেকে শুরু করে শেরপুর, ফেনী, রাজশাহী, সুনামগঞ্জ, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন জেলায় কৃষকের পরিবর্তে দালাল ও মিলাররা সরকারি গুদামে ধান সরবরাহ করছে।

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার শ্রীরামকাঠি খাদ্যগুদামে চলতি বোরো মৌসুমে ৯৬৫ টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় বিএনপি নেতারা সরবরাহ করেছেন ৬০০ টন, জামায়াত নেতারা ৩০০ টন। প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে মাত্র ৬৫ টন। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, কার্ডধারী কোনো কৃষকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৩ টন পর্যন্ত ধান সংগ্রহের কথা। কিন্তু বাস্তবে কৃষকের কার্ড ও পরিচয় ব্যবহার করে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা ধান সরবরাহ করে বিল উঠিয়ে নিচ্ছেন। তারা কৃষকের কাছ থেকে প্রতি মণ ১ হাজার ১০০ টাকায় কিনে সরকারি গুদাম থেকে ১ হাজার ৪৪০ টাকা বিল তুলছেন। 

কৃষকদের অভিযোগ, যারা ভালো মানের শুকনো ধান নিয়ে গুদামে যান, তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু নেতাদের সরবরাহ করা ভেজা, পচা ধানও গ্রহণ করে গুদাম। এতে প্রকৃত কৃষক সরকার নির্ধারিত দামে ধান বিক্রি করতে না পেরে বাজারে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় আদিবাসী ও দরিদ্র কৃষকদের নামে ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে সরকারি ধান সংগ্রহ কার্যক্রমে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী আতাউর রহমান ‘সাথী চালকল’ নামে একটি ক্ষুদ্র মিলের মাধ্যমে সরকারকে ৪৬ টন চাল সরবরাহ করেছেন। অথচ তাঁর মিলের উৎপাদন ক্ষমতা এত নয়। বিষয়টি স্বীকার করে আতাউর বলেন, ‘আমি বাইরে থেকে ধান কিনে স্থানীয় কৃষকের নামে গুদামে দিই। বিনিময়ে তাদের ৫০০ টাকা করে দিই।’ আদিবাসী অনুকূল সরদার বলেন, ‘আমাদের এলাকার ৩০-৪০ জনকে দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে চেক বইয়ের পাতায় আগেভাগেই সই করিয়ে নিয়েছে। এর পর এই নামেই চাল সরবরাহ করা হয়েছে।’

সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে হলে কৃষককে আগে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। তারপর গুদামে ধান দিয়ে কমপক্ষে ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় টাকার জন্য। অনেক সময় এই টাকা পৌঁছাতে আরও বেশি সময় লেগে যায়। তাই কৃষকরা স্থানীয় বাজারে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করে দেন। এতে প্রকৃত কৃষকের প্রতি মণে অন্তত ২৪০ থেকে ৪৪০ টাকা ক্ষতি হয়। এই সুযোগটাই নিচ্ছেন ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারা। তারা গরিব কৃষকদের নাম ব্যবহার করে সরকারিভাবে ধান জমা দিচ্ছেন এবং বড় অঙ্কের মুনাফা করছেন।

গোদাগাড়ীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ বলেন, লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এ বিষয়ে নাজিরপুরের খাদ্য কর্মকর্তাদের কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
হাওরবেষ্টিত কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে কৃষক সারাবছরে শুধু একবার বোরো ফসল ঘরে তোলেন। সেখানে সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে গিয়ে চাষিদের গুনতে হচ্ছে ঘুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, অষ্টগ্রামের খাদ্য পরিদর্শক জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া একজন কৃষকের কাছ থেকে প্রতি টন ধানে ২ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করছেন। কৃষকরা জানান, ঘুষ না দিলে ধান ‘ভেজা’ বা ‘অনুপযুক্ত’ বলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অষ্টগ্রাম খাদ্যগুদামের প্রহরীও কাগজ তৈরির নামে প্রতি টনে ২৭০ টাকা করে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

শুধু ঘুষই নয়, প্রকৃত কৃষকদের না জানিয়েই তাদের নাম ব্যবহার করে অন্যরা ধান দিচ্ছে। কৃষক জাকির হোসেন বলেন, ‘সরকারি গুদামে ধান দিতে পারিনি, অথচ আমার নামে কেউ স্লিপ নিয়েছে।’ কৃষক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ধানে আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের কম হলেও তা নেয়নি গুদামের লোকজন। কারণ আমি ঘুষ দেইনি।’

শেরপুর জেলায় গড়ে তোলা হয়েছে ‘ফার্মার সিন্ডিকেট’। সরকারি অ্যাপে আবেদন করে যারা ধান দেওয়ার অনুমতি পান, তাদের অনেকেই ধান দেন না। এতে সুযোগ নেয় গুদামের দালাল চক্র। ৪০০ জন সাধারণ নারী-পুরুষকে দিয়ে ৪০০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। পরে সরকারি অ্যাকাউন্টে প্রতিজনের নামে ১ লাখ ৮ হাজার টাকা জমা হয়। ওই চক্র প্রত্যেককে মাত্র ২ হাজার টাকা দিয়ে বাকি অর্থ তুলে নেয়।

এ ঘটনায় দুই দালালকে আটক করে পুলিশ, তবে অভিযোগকারী না থাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়। শেরপুরের খাদ্য নিয়ন্ত্রক নাজমুল হক ভূঁইয়া বলেন, এত সংখ্যক কৃষকের নামে হিসাব খোলাটা সন্দেহজনক। বিষয়টি তদন্ত করা হবে।

ফেনীর দাগনভুঞা উপজেলার কৃষকদের দাবি, সরকারি গুদামে ধান সরবরাহ করতে গেলে টনপ্রতি ২ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ না দিলে ধান ফেরত দেওয়া হয়। দালালরা কৃষকের কার্ড কিনে নিজেরাই ধান দিয়ে মুনাফা করছে। কৃষক সাদেক হোসেন বলেন, আমরা ধান নিয়ে গেলে ঘুষ চাওয়া হয়, দালালের ধান ঠিকই নেয়। 

দাগনভুঞার ১৬ জন কৃষক লিখিতভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স ম আজহারুল ইসলাম বলেন, কৃষকের অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা থেকে খাদ্য উপদেষ্টার দপ্তরে পাঠানো কৃষকদের অভিযোগপত্রে বলা হয়, প্রতি টন ধানে ১ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে বেশি আর্দ্রতার ধান গ্রহণ করছেন গুদামের কর্মকর্তারা। এ কাজে সহায়তা করছে স্থানীয় দালাল সিন্ডিকেট, যারা কৃষকদের কার্ড কিনে চেকে স্বাক্ষর করিয়ে দিচ্ছে। এতে প্রকৃত কৃষকরা সরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

নওগাঁয় চাল ও ধান মজুত করে বাজার অস্থির করার অভিযোগে জেলা খাদ্য বিভাগ এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে ২২ হাজার টাকা জরিমানা করে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ফরহাদ খন্দকার বলেন, বাজারে দাম বাড়ার পেছনে মজুতদারির অভিযোগ ছিল। নিয়ম না মেনে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

তাহিরপুর উপজেলার খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা নুরুল হকের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের অভিযোগ তুলেছেন কৃষকরা। স্থানীয় কৃষক আশরাফুল আলম, ঝিনুক তালুকদারসহ অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ করেন, খাদ্যগুদামে ধান দিতে গিয়ে তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আর্দ্রতার অজুহাতে তাদের ধান না নিয়ে ব্যবসায়ীদের নিম্নমানের ধান গুদামে তোলা হচ্ছে। এ নিয়ে উপজেলার মাসিক উন্নয়ন ও সমন্বয় সভায় একাধিক ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হাসেম বলেন, প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলায় খাদ্য ও কৃষি বিভাগের কিছু কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং দালালের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ধান সংগ্রহ সিন্ডিকেট। কৃষকদের অভিযোগ, যাচাই-বাছাই ছাড়া কৃষি বিভাগ তালিকা তৈরি করেছে এবং গোপনে লটারির মাধ্যমে নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। কৃষকরা নতুন তালিকা করে ধান সংগ্রহের দাবি জানিয়েছেন।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, এভাবে চলতে থাকলে সরকারিভাবে ধান সংগ্রহের প্রতি কৃষকের আস্থা চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়বে। বাজার নিয়ন্ত্রণও সম্ভব হবে না।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ধানের দাম বাড়িয়ে সরকার এটিকে কৃষকের জন্য ‘সুবর্ণ সুযোগ’ ভেবেছিল, বাস্তবে তা পরিণত হয়েছে দুর্নীতির উৎসে। কৃষক নয়, লাভবান হচ্ছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও দলীয় শক্তি। এখনই কঠোর নজরদারি ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ না নিলে ন্যায্য দামে ধান বিক্রির স্বপ্ন কৃষকের কাছে রয়ে যাবে অধরাই।

খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর বলেন, সারাদেশে এবার কৃষক ন্যায্য দাম পাচ্ছেন। তার পরও কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এশিয়ার দেশগুলোয় ট্রাম্পের শুল্কনীতির কী প্রভাব পড়বে
  • যেসব এলাকায় আজ ১১ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না
  • বৈশ্বিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে তেল উৎপাদন বাড়াবে ওপেক জোট
  • সোমবার ১১ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
  • সাজা মাথায় নিয়ে ঘুরছিলেন ধামাকার চেয়ারম্যান মোজতবা আলী
  • ধামাকার চেয়ারম্যান কারাগারে, সাজা মাথায় নিয়ে ঘুরছিলেন
  • রেকর্ড উৎপাদন, বেড়েছে মজুত, তবুও চালের বাজারে উত্তাপ
  • হামলা চালিয়ে যাবে মস্কো, পুতিনে হতাশ ট্রাম্প
  • কার্ড কৃষকের, গুদামে ধান দেন মিলার-নেতারা