ইসরায়েলের সহায়তায় ফিলিস্তিনিরা গাজা ছাড়ছে?
Published: 15th, November 2025 GMT
সবকিছু শুরু হয়েছিল আল-মাজদ ইউরোপ সংস্থার একটি বিজ্ঞাপনী পোস্ট দিয়ে। ওই পোস্টে গাজা উপত্যকার বাইরে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তাই অনেক ফিলিস্তিনি ওই পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, তাদের আবেদনপত্র পূরণ করেছেন এবং সংস্থার কাছ থেকে একটি ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
গাজার পরিস্থিতি ফিলিস্তিনিদের উপত্যকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য যথাসাধ্য অর্থ প্রদান করতে বাধ্য করেছে। তারা সবকিছু হারিয়েছে। তারা তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে এবং তারা বিশ্বাস করে যে এখানে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
সমস্যা হচ্ছে, ইসরায়েলের অনুমতি ছাড়া এক জন ফিলিস্তিনিও গাজা থেকে বের হতে পারে না। তাহলে কীভাবে তারা গাজা থেকে বের হবে?
ওই ফিলিস্তিনিরা গাজার মধ্যবর্তী এলাকায় একটি বাসের মধ্যে ছিল। তারা তাদের প্রস্থানের কয়েক ঘন্টা আগে একটি ফোন কল পেয়েছিল। তারা ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় তথাকথিত হলুদ রেখা (ইয়োলো লাইন) অতিক্রম করেছিল। এই বাসটি তারপর কারেম আবু সালেম (কেরেম শালোম, ইসরায়েলিদের কাছে) ক্রসিং এবং তারপর দক্ষিণ ইসরায়েলের র্যামন বিমানবন্দরে গিয়েছিল। শুধু এই একটি বাস নয়, কয়েকটি বাসই ফিলিস্তিনিদের নিয়ে ইসরায়েলের র্যামন বিমানবন্দরে গিয়েছিল। ১৫৩ ফিলিস্তিনিকে নিয়ে একটি চার্টার বিমান কেনিয়ার নাইরোবিতে যাত্রাবিরতির পর বৃহস্পতিবার সকালে জোহানেসবার্গের ও.
বৃহস্পতিবার রাতে দক্ষিণ আফ্রিকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে এবং গিফট অফ দ্য গিভার্স নামে একটি স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা ফিলিস্তিনিদের থাকার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেওয়ার পর পরিবার ও শিশুসহ ১৫৩ জন যাত্রীকে বিমান থেকে নামতে দেওয়া হয়।
অক্টোবরের যুদ্ধবিরতি থেকে কমপক্ষে ২০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে শুধুমাত্র হলুদ রেখা অতিক্রম করার জন্য। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, শতাধিক ফিলিস্তিনিকে গাজা থেকে বের করে দেওয়ার ব্যবস্থাটি ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয় ছাড়া কীভাবে সম্ভব?
ঢাকা/শাহেদ
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
হাশিম মোল্লা—সাকিন আশিমপুর
ঘিয়ে রঙের বেজায় দীর্ঘ দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ আদতে সামাজিক প্রকৃতির মানুষ। গ্রামের বাজারেই তিনি ঘোরাফেরা করেন। মুদি-মনিহারির কোনো দোকানে বারান্দায় বসে ডাবাহুক্কায় ধূমপান করতে করতে খুকখুকিয়ে কাশেন। মাঝেমধ্যে উলের ময়লা টুপিটি খুলে জটাজুটে ঝকড়িমকড়ি লাগা চুল ভইষের শিংয়ের কাঁকই দিয়ে আঁচড়ান। নেড়ি কুত্তাগুলো তাকে ঘিরে ধরলে, কুঁকড়ামতো লাঠি দিয়ে তাড়া করেন। তাঁর সঙ্গে সব সময় থাকে ছালার টাটে তৈরি বস্তনী ও একটি লন্ঠন। বাজারে নতুন কোনো মুখ দেখলে আগ বাড়িয়ে পরিচয় দেন,‘জ্বে…আমার নাম হাশিম মোল্লা, সাকিন তিনশুকিয়ার আশিমপুর,’ তারপর খুব মিঠে হেসে ইশারায় মাঙ্গেন একশলা সিগ্রেট; এবং অজুহাতের ভঙ্গিতে জানান, হালফিল টিকি-তামাক জুটানো মুশকিল হয়ে পড়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে, জমানা বদলেছে, তিনিও ফুঁকতে শুরু করেছেন সিগ্রেট। বাচনভঙ্গিতে এমন কিছু আছে যে আগন্তুকেরা সচরাচর তাঁর অনুরোধকে অবজ্ঞা করেন না, কেউ কেউ কিনেও দেন দু-পাঁচ শলা বগুলা সিগ্রেট। হাশিম মোল্লা ঢোলা কোর্তার জেব থেকে বের করেন জংধরা একটি ম্যাচলাইটার, খুট করে তা জ্বালিয়ে ধূমপান করতে করতে কাশেন, হাঁপানির তোড়ে তাঁর পাঁজর ওঠানামা করে। কাশির টান সামলিয়ে তিনি মন্তব্য করেন, সোনার বাংলায় বগুলা সিগ্রেট ফের চালু হয়েছে বটে, কিন্তু আংরেজ আমলের মতো এতে আর তেমন তুন-তেজ নেই। সাহেবদের আমলে তিনি পাসিং-শো সিগ্রেট ফুঁকে যে আমোদ পেতেন, এ তথ্যটি জানাতেও দ্বিধা করেন না।
এ আত্রাফে আশিমপুর নামে কোনো গ্রাম নেই, তিনশুকিয়া নামক অঞ্চলটি কোনো মহকুমায়, এ ব্যাপারেও কেউ ওয়াকিবহাল নয়। স্বদেশে বছর তিনেক আগে ফিরে আসা একজন শরণার্থীর ধারণা, জায়গাটির অবস্থান ভারতের আসাম রাজ্যের কোথাও। তিনি হাশিম মোল্লাকে সাওয়ালাদি করে নিশ্চিত হন, বৃদ্ধ আদতে ওপারের মানুষ, এখানে কেন এসেছিলেন, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাশিম মোল্লা জবাবে নির্দিষ্টভাবে কিছু না বলে, সুরেলা গলায় ব্যঙ্গাত্মক একটি ছড়া তথা ‘কানমে বিড়ি, মুমে পান/লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান,’ গেয়ে প্রশ্নকর্তাকে আমোদ দেন। পার্টিশনের সময় প্রচলিত এ ছড়াটির সঙ্গে হাশিম মোল্লা স্বরচিত একটি পদ, ‘হায় রে…নয়নের সামনে অইলো গোরস্তান,’ যুক্ত করে শ্রোতাদের উল্লাস বর্ধনে সাহায্য করেন। তাঁর শ্লেষ্মা মাখানো গলার স্বরটি দাঁড়িয়ে পড়ে চোখ মুদে শোনার মতো। তো শ্রোতারা তাঁর গায়ন-বয়নে মুগ্ধ হয় এবং হাশিম মোল্লার সাকিন সম্পর্কিত কৌতূহলটি একাধিক সুখটানে জ্বলে ওঠে নাসির-বিড়ির আগুনের মতো মিইয়ে আসে।
এ আত্রাফে আশিমপুর নামে কোনো গ্রাম নেই, তিনশুকিয়া নামক অঞ্চলটি কোনো মহকুমায়, এ ব্যাপারেও কেউ ওয়াকিবহাল নয়। স্বদেশে বছর তিনেক আগে ফিরে আসা একজন শরণার্থীর ধারণা, জায়গাটির অবস্থান ভারতের আসাম রাজ্যের কোথাও।মোল্লা নামে পরিচিত হলেও হাশিম দোয়া-কালাম তেমন একটা জানেন না। পাঞ্জেগানা জামাতের সময় সচরাচর গয়েরহাজির থাকেন। রোজারমজানের দিনে লীলাবতী মিষ্টান্ন ভান্ডারের পেছন দিকের চিপাচাপায় বসে তাঁকে ডাবাহুক্কা টানতেও দেখা যায়। পেশা হিসেবে তিনি কারও ঘরবাড়ি সাময়িকভাবে খালি হয়ে পড়লে তা পাহারা দেন। বাড়ির মালিকেরা বিশ্বাস করে তাঁর হাতে তুলে দেন তালাবদ্ধ ঘরের চাবি। রাত্রিবেলা একটি কামরা খুলে হাশিম ঘুমান। তাঁর বস্তনীতে আছে—কাঁথা ও বালিশ। মাঝরাতে কাশির গমকে তাঁর ঘুম ভাঙে, তিনি লন্ঠনের শিখা উসকিয়ে দিয়ে হাঁক পাড়েন, ‘পার করো পরোয়ারদিগার/ মাঙ্গে পানা হাশিম গুনাগার…,’ এতে চোরচোট্টারা হুঁশিয়ার হয়, তাঁরও কেটে যায় নিশিরাত।
পাহারাদি ছাড়া মহররমের চান্দেও হাশিমের ডাকখুঁজ পড়ে। বাদ-মাগরেব কোনো না কোনো গ্রামে ইন্তেজাম হয় জারিগানের। দশাসই ডেগে রান্না হয় আখনি। চাঁদোয়াতলে হ্যাজাকের আলোয় হাজির হন হামসায়ার পঞ্চজন। গাঁওগেরামের বউ-ঝিরা কদর করে হাশিমকে জোগান টিকির ধিকিধিকি আগুনে উত্তপ্ত ডাবাহুক্কা। তাতে কষে দম দিয়ে উঠে দাঁড়ান তিনি, তাঁকে ঘিরে দাঁড়ায় জারিগানে গলা মেলানোর সাগরেদরা। চোখ মুদে তিনি বুক চাপড়ান। কারবালায় কতল হওয়া শহীদানের করুণ কাহিনির স্মরণে আফসোসও করেন। তারপর ঢিমেতালে গেয়ে ওঠেন,‘ আখেরি সালাম লহ ওহে নানাজান/ তোমারই হোসেন চলে কারবালার ময়দান…।’ তাঁর কণ্ঠনিঃসৃত সুরছন্দে হিন্দু-মুসলমান শুভ্র-ভদ্র সকলে হায় হায় করে ওঠে।
এ অত্রাফের হরেক গ্রামে ছড়ানো আছে সম্পন্ন গেরস্তদের ঘরবাড়ি। নানা কারণে এগুলো সপ্তা-দশ দিনের জন্য জনশূন্য হয়, তখন পাহারাদার হিসেবে ডাক পড়ে হাশিম মোল্লার। পাঞ্জেগানা নামাজে হাশিমের গাফিলতি থাকলেও, জুমাবার হলে তিনি গামছায় জটাজুট পেঁচিয়ে রীতিমতো পাগড়ি বেঁধে ওই গ্রামের মসজিদে হাজির হন। মোয়াজ্জিন গয়েরহাজির থাকলে আজান-আকামতের ব্যাপারটা কুলিয়ে দেন। আর মিলাদ পড়তে খুবই ভালোবাসেন হাশিম। বাদ জুমা মিলাদের ইন্তেজাম হলে তিনি জোশগ্রস্ত হয়ে জপেন, ‘ইয়া নবী সালামালাইকা…।’ শিন্নির বাটচিটেও তাঁর দক্ষতা প্রচুর, পরিমাণ কম হলে কিছু আসে যায় না, তাঁর বণ্টনে কোনো কাচ্চাবাচ্চা কখনো খালি হাতে খাজুল হয়ে বাড়ি ফিরেছে, এমনটি শোনা যায়নি।
আজ হাশিম মোল্লার যে বাড়িতে ডাক পড়েছে, তা গ্রামের শেষ প্রান্তে। চুনকাম করা ইটের দেয়াল, ঢেউটিনের দশচালা বিরাট-বড় ঘর। গেরস্ত রিটায়ার করা সাবরেজিস্ট্রার। তাঁর ছেলেমেয়েদের একজন ঢাকা নগরীতে চাকরিরত, অন্যজন বিলেতে প্রবাসী। সাবরেজিস্ট্রার সস্ত্রীক ঢাকা গেছেন, উদ্দেশ্য, হাওয়াই জাহাজে করে হজে যাওয়া। বৈঠকখানায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছেন হাশিম। দুটি নেংটি ইঁদুর তার সিনার ওপর দিয়ে ডিগবাজি খেয়ে ছুটে গেলে ঘুম ভাঙে। চিনকিরি দিয়ে জানান দেয় প্রবল শূলবিষ, তিনি বগুলা-সিগ্রেট ধরিয়ে মৃদু মৃদু কাশেন। তখনই শুনতে পান, মেয়েলি গলায় খিলখিলিয়ে হাসি। চুড়ির আওয়াজও ভেসে আসলে তিনি লন্ঠন উসকান। এ বাড়িতে কামরা অনেকগুলো। সাবরেজিস্ট্রার তাবৎ কিছু তালা দিয়ে ঢাকায় গেছেন, কোনো কারণে চাবি তাকে দিয়ে যাননি। দরোজা খুলে আসমানে তাকিয়ে তারকার নকশা ধুন চেয়ে দেখে হাশিম আন্দাজ করেন, রাত এক-ঘড়ির বেশি হয়নি। কুঁকড়া লাঠিটা হাতে বাড়ির চারদিকে ঘুরপাক করতে করতে ফের ব্যথাটা চিনকিরি দিয়ে ওঠে। তো হাশিমের আজ আর হাঁকডাক করতে ইচ্ছা হয় না।
আজ হাশিম মোল্লার যে বাড়িতে ডাক পড়েছে, তা গ্রামের শেষ প্রান্তে। চুনকাম করা ইটের দেয়াল, ঢেউটিনের দশচালা বিরাট-বড় ঘর। গেরস্ত রিটায়ার করা সাবরেজিস্ট্রার। তাঁর ছেলেমেয়েদের একজন ঢাকা নগরীতে চাকরিরত, অন্যজন বিলেতে প্রবাসী।কামরায় ফিরে এসে তিনি মুখে তোলেন হোমিওপ্যাথিকের একটি পুরিয়া। ওষুধটি তাঁকে মনমোহনবাবু দিয়েছেন। শূল-বিষের উৎপাত হলেই তিনি বাবুর ফার্মেসিতে যান, বাবু তাঁকে ফ্রি ওষুধ দেন, চা-পানি খাওয়ান, এক শলা ব্রিস্টল সিগ্রেটও দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবুর পরিবার বিরানব্বই বছরের বৃদ্ধা মাকে দাসীর তদারকিতে রেখে চলে গিয়েছিলেন ত্রিপুরায়। তখন বাড়ি পাহারার দায়িত্বে ছিলেন হাশিম। হানাদার সৈনিকেরা হিন্দুপট্টিতে আগুন দিয়ে, পাড়ার শেষ দিকে মনমোহনবাবুর বাড়ির কাছে এলে, হাশিম বুদ্ধি করে রংচটা জায়নামাজখানা বিছিয়ে তসবিহ হাতে বসে পড়েছিলেন পুকুরপাড়ে। সৈন্যরা পাগড়ি পরা বৃদ্ধকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে তাঁকে সালাম-আলেক করেছিল, তখন তিনি ধ্যান ভেঙে আওয়াজ দিয়েছিলেন, ‘ইশককা পিয়ালা পিয়া করো/ আল্লা-নবী কা নাম লিয়া করো।’ খানসেনারা বিভ্রান্ত হয়ে তার হাত ছুঁয়ে মোসাফা করে ফিরে গিয়েছিল তাদের ক্যাম্পে।
হোমিওপ্যাথিকের পুরিয়ায় শূল-বেদনার উনিশ-বিশ কিছু হয় না। বৈঠকখানায় ফিরতে পায়েও বড্ড জ্বালাযন্ত্রণা হয়, লন্ঠনের আলোয় দেখেন, পা দুখানা পানি জমে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। আউলামাড়া কাঁথায় তিনি ঝিম ধরে বসে থাকেন। রাত বাড়ে। সাবরেজিস্ট্রার ফিরে এলে এখানে পাহারার কামকাজে তামাদি পড়বে। ভিন্ন কোন বাড়িতে পাহারার ডাকখুঁজ না পেলে হয়তো বাজারের কোনো না কোনো আড়তে চৌকি দেওয়ার ছোটা-কাজ পেয়ে যাবেন। কিন্তু ছোটা-কামকাজে হুজ্জোত কম না। একবার আড়ত পাহারার সময় বিডিআরের রেইড হয়। ধরা পড়ে, চালের বস্তার আড়াল-আবডালে রাখা হরেক কিসিমের চোরাই মাল। কিছু জানেন না, এ ধরনের সাফাই গাইতে গেলে তাকে হাতকড়া পরিয়ে চালান দেওয়া হয় প্রথমে থানা-হাজতে, তারপর মহকুমার জেলখানায়। কারাগারে হাশিমের সময় কাটতে চায় না। তো তিনি বাঁধতে শুরু করেন ছড়া-গানের পদ। রাতবিরাতে সুর করে জপেন, ‘তোমার তিলিসমাত বোঝা বড় দায়/ চোরচোট্টারা হাটবাজারে ঘুইরা বেড়ায়/ হাশিম মোল্লা রে পাঠাইলা তুমি জেলখানায়/ তোমার তিলিসমাত বোঝা বড় দায়…।’
মাস চারেক খামোকা জেল খেটে তিনি যখন বেকসুর খালাস পান, তখন তাঁর শরীর ছেয়ে গেছে বেতালা ধরনের চর্মরোগে। হাঁপানির টানও বেড়ে গিয়েছিল বেহদ। তখন রাত গুজরানোর আশ্রয় হিসেবে গিয়ে ওঠেন বাজারের মসজিদে। ইমাম চুলকানির বিষয়টা খেয়াল করে, নামাজরোজায় গাফিলতির তমদ দিয়ে তাঁকে বের করে দেন মসজিদ থেকে। তো হাশিম বাজারের কোনো কোনো দোকানের দেয়ালে হেলান দিয়ে কাটাতে শুরু করেন রাত। তত দিনে চর্মরোগের ক্ষতে এসে বসতে শুরু করেছে পোকা। বিষয়টা মনমোহনবাবুর কানে গেলে তিনি শুধু আশ্রয়ই দেন না, এলএমএফ পাস দেওয়া অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসারও বন্দোবস্ত করে দেন। কিছুদিনের মধ্যে চর্মরোগের উপশম হয়, তবে হাঁপানির টান বেড়ে যায় ব্যাপকভাবে।
ইয়াদগারিতে ফিরে আসে আরও বছর তিনেক পর তাঁর কৈশোরের কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা। লামডিং নামে আসামের একটি রেলওয়ে জংশনের টি–স্টলে কিছুদিন কাজকামও করেছিলেন, তারপর কী হয়েছিল ঠিক মনে পড়ে না।কাঁথার খানিকটা গতরে জড়িয়ে নানা কিছু ভাবতে ভাবতে ঝিমিয়ে পড়েছিলেন হাশিম। শূল-বিষের চিনকিরি দেওয়া ব্যাথায় ফের জেগে ওঠেন। লন্ঠনের শিখা উসকিয়ে বস্তানীর ভেতর থেকে খুঁজে পেতে বের করেন কাগজের মছা, তা থেকে মুঠো করে গেলেন খাবারের বেকিং-সোডা। দাঁত কিড়মিড়িয়ে শূল-বিষের প্রদাহ সহ্য করে তিনি অপেক্ষা করেন, পাকস্থলীতে বেকিং-সোডা কার্যকরী হওয়ার। আশপাশে কোন কামরায় মনে হয় নড়েচড়ে ওঠে দুজন মানব-মানবী। মেয়েটি মুখ ঝাপটা দিয়ে বলে, ‘একবার না করলা হানজারাইতে, আরবার টানতাছো কেন?’ হি হি হেসে পুরুষটি বলে, ‘এলা কাছে আয় এট্টু, তোর শরীল গরম কইরা দিই।’ পাহারাদার হিসেবে দায়িত্ববশত হাশিম উঠতে যান, কিন্তু গতরে কোনো সাড়া-সাবুদ পান না। হাত বাড়িয়ে লাঠিটিও ধরতে পারেন না। ফের চেষ্টা করেন লাঠি স্পর্শ করতে। ঘষটিয়ে লন্ঠনের কাছে গেলে, উল্টে পড়ে শিখায় ধোঁয়াগ্রস্ত হয় কাচ। অনুভব করেন, তাঁর শরীর ঘামছে তুমুলভাবে। লন্ঠনটি ছুঁতে না পেরে চেষ্টা করেন, ‘ইয়াল্লা পরোয়ারদিগার/ চোরচোট্টা হুঁশিয়ার…,’ বলে হাঁক পাড়েন। কিন্তু গলা দিয়ে বেরোয় না কোনো আওয়াজ।
অনেকক্ষণ তেলচিটচিটে কাঁথায় পড়ে থেকে দারুণভাবে হাঁপাচ্ছিলেন হাশিম। কয়েকটি পাখি বাড়ির বাঁশবাগানে কাকলি করে উঠলে, বুঝতে পারেন, আসমানে এখন ভোরবিহানের নির্ঘোষবাহী নক্ষত্র পরি-তেরা ছড়াচ্ছে শুভ্রনীল আলো। বেশ একটু হিমও পড়েছে। ঠান্ডায় কাতর হতে হতে হাশিম চেষ্টা করেন, হাত বাড়িয়ে কাঁথায় শরীর মুড়তে, কিন্তু অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কিছুই নাড়াতে পারেন না। হাল ছেড়ে দেন, তখনই অনুভব করেন, শূল-বিষের জিলকানি-গরফানি বেশ খানিকটা ভোঁতা হয়ে এসেছে; আর মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে বয়োস্কোপের ছায়াচিত্রের মতো যাপিত জীবনের খণ্ডচিত্র। স্পষ্ট মনে পড়ে তাঁর ক্রন্দনরতা মাকে। মশালধারীরা ঘরে অগুন দিয়ে তাঁকে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, ছাগলের প্রিয় ছানাটিকে কোলে নিয়ে দৌড়ে এসে বালক হাশিম লুকোন খড়ের গাদার আবডালে, কিন্তু রেহাই পান না। স্মৃতির দিলদগ্ধ চিত্রটি ভোরবিহানের অরুণিম আভার মতো মুছে যায় দ্রুত তাঁর ইয়াদগারি থেকে।
কাঁথায় পড়ে থেকে কাতরানোর চেষ্টা করেন হাশিম, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হয় না, আন্দাজ করেন, তাঁর জবান বন্ধ হয়েছে। চেষ্টা করেন রায়টে বিপন্ন হওয়ার বিষয়টি ভাবতে। কিন্তু ইয়াদগারিতে ফিরে আসে আরও বছর তিনেক পর তাঁর কৈশোরের কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা। লামডিং নামে আসামের একটি রেলওয়ে জংশনের টি–স্টলে কিছুদিন কাজকামও করেছিলেন, তারপর কী হয়েছিল ঠিক মনে পড়ে না। তবে পাকিস্তান-হিন্দুস্তান ভাগ হওয়ার আগে বদরপুরের এক মাজারে তিনি আশেকানদের তোহফা তথা গোলাপের পাপড়ি মাখানো নকুলদানা প্রভৃতি বণ্টনের দায়িত্বে ছিলেন। আর মাজারে জিকির-আজকারের ইন্তেজাম হলে গোলাপজলও ছিটাতেন।
হেমন্তে টুপটাপিয়ে ঝরে পড়া পত্রালীর মতো তাঁর স্মৃতি থেকে ক্রমশ মুছে যায় শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিচিত্র। দারুণ এক শূন্যতার ভেতর হাশিম আন্দাজ করেন, শেষ হয়ে এসেছে তাঁর জিন্দেগির মেয়াদ। বুঝতে পারেন, এ যাত্রা তিনি আর উঠে দাঁড়িয়ে লাঠি ঠুকে ঠুকে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের পুরিয়ার জন্য যেতে পারবেন না মনমোহনবাবুর ফার্মেসিতে। গৃহহীন মানুষ তিনি, তামাম জনমভর কোনো না কোনো ঘরবাড়ি-দোকান-আড়ত পাহারা দিয়ে জুটেছে তাঁর রাত গুজরানোর আশ্রয়। হাঁপানির টানে তাঁর জান যেন গলায় এসে আটকে আছে। দম বেরিয়ে গেলে, কাফন-দাফন-কবরের কী বন্দোবস্ত হবে? তিনি তো এ আত্রাফের কোনো মহল্লার পাঁচ-পঞ্চায়েতের কেউ না। এদিকে কোথাও তাঁর কুটুমখেশ, গুষ্টিগাড়াও নেই। তাঁর সাকিন আশিমপুর সীমান্তের ওপারে, সম্পূর্ণ আলাদা একটি দেশে। ওখানে তাঁর আত্মীয়স্বজনদের কেউ এখনো বেঁচে আছে কি? তাঁর মৃত্যুসংবাদ কি কখনো জনমভিটায় পৌঁছবে?