ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রায়ই তরুণদের দেখা যায় সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে ভুগতে। ফলে অনেক সময় যথেষ্ট মেধা, আগ্রহ ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ক্যারিয়ারে ভালো করতে পারেন না। তরুণদের সঠিক দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাতে প্রথম আলো ডটকম ও প্রাইম ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত পডকাস্ট শো: লিগ্যাসি উইথ এমআরএইচ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ রিদওয়ানুল হকের সঞ্চালনায় পঞ্চম পর্বে অতিথি হিসেবে অংশ নেন হাতিলের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম এইচ রহমান। আলোচনার বিষয় ছিল ‘উদ্ভাবন, নৈতিকতা ও টেকসই উন্নয়নই লিগ্যাসির নতুন সংজ্ঞা’।

বাবা কিংবা দাদার পরিচয়ে বড় হওয়ার চেয়ে নিজের স্বকীয়তা তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন ব্যক্তির উচিত নিজের কাজ, নৈতিকতা ও সাহস দিয়ে এমন কিছু করা, যা তাঁকে একটি নতুন ও স্বতন্ত্র পরিচয় দেবে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তরুণদের উদ্দেশে এ পরামর্শ দেন সেলিম এইচ রহমান। পডকাস্ট শো: লিগ্যাসি উইথ এমআরএইচের এই পর্ব গতকাল শনিবার প্রথম আলোর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রচার হয়।

সঞ্চালক মোহাম্মদ রিদওয়ানুল হক অনুষ্ঠানের শুরুতেই জানতে চান, পারিবারিক একটি ব্যবসাকে এত বড় পরিসরে নিয়ে আসার সাহস কীভাবে পেলেন?

উত্তরে সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘১৯৮৮ সালে পড়াশোনা শেষ করে আমি বাবার প্রতিষ্ঠানে যোগ দিই। সেখানে মূলত আমার কাজ ছিল কাঠ বিক্রি করা। প্রায় দুই বছর এই কাজটা করি। ভালোই করছিলাম, কিন্তু আমার তাতে মন ভরছিল না, কারণ এর মধ্যে আমি তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ অনুভব করছিলাম না।’

সেলিম এইচ রহমান আরও বলেন, ‘তখন বাবার প্রতিষ্ঠানে একজন কাজ করতেন, যিনি একসময় সৌদি আরবে একটি ডোর ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি করতেন। তাঁর কাছ থেকে শুনে ভাবলাম, বাংলাদেশে তো এখনো সলিড কাঠের দরজা বানানোর কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এই ভাবনা থেকেই বাবার অনুমতি নিয়ে তাঁর কাঠের মিলের উল্টো দিকে এক হাজার স্কয়ার ফিটের একটি গোডাউনে স্যাম্পল বানাতে শুরু করি। এর মধ্যেই এক ভদ্রমহিলা বার্মাটিক কাঠ কিনতে এসে আমার ধারণা শুনে মুগ্ধ হন এবং পাঁচ হাজার টাকা হাতে দিয়ে বলেন, আর কাঠ কিনলাম না, তুমি দরজাটা বানাও। সেই রসিদই হাতিলের যাত্রার সূচনা।’

সঞ্চালক জানতে চান, দরজা থেকে আসবাব বানানো কীভাবে শুরু করলেন?

সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘যাঁরা হাতিলের দরজা কিনতেন, তাঁরা কাজ দেখে সন্তুষ্ট হয়ে প্রায়ই বলতেন, আপনারা তো ভালো করছেন, তাহলে আসবাব নিয়ে কেন কাজ করছেন না! ক্রেতাদের এই উৎসাহ আর পরামর্শ থেকেই পরবর্তী সময়ে ফার্নিচার তৈরির কাজ শুরু হয়।’

প্রসঙ্গক্রমে সঞ্চালক হাতিলের ব্যবসা বিস্তারের গল্পটি শুনতে চান।

সেলিম এইচ রহমান স্মৃতিচারণা করেন, ‘হাতিলের প্রথম ফ্যাক্টরি ছিল বাবার গোডাউনে। এরপর গেন্ডারিয়ার একটি বন্ধ ময়দার মিল ভাড়া নিয়ে সেটিতে ফ্যাক্টরি হিসেবে কাজ চালু হয়। পরে কুড়িল বিশ্বরোডে মেশিনসহ আরেকটি ফ্যাক্টরি চালু করা হয়।’ সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা কাজ একত্রে আনার প্রয়োজন দেখা দেয়। তাই সাভার ইপিজেডের পাশে ৯ বিঘা জমি কিস্তিতে কিনে সেখানে গড়ে তোলা হলো হাতিলের মেগা ফ্যাক্টরি। এভাবেই ছোট থেকে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে হাতিল। এখন প্রায় ২ হাজার ৪০০ মানুষ কাজ করছেন এখানে।’

সেলিম এইচ রহমান আরও বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে আমার ছোট ভাইরা পড়াশোনা শেষ করে আমার সঙ্গে ব্যবসায় যোগ দেয় এবং প্রত্যেকে আলাদা দায়িত্ব ভাগ করে নেয়। এখন আমরা পাঁচ ভাই মিলে একসঙ্গে ব্যবসা চালাচ্ছি। মেজ ভাই বাবার প্রতিষ্ঠানের দেখভাল করছেন।’

২০০০ সালে আধুনিকায়নের যে পদক্ষেপগুলো নিলেন, তা কি শুধুই দক্ষতা বাড়ানোর জন্য নাকি গ্রাহকদের রুচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাকে গুরুত্ব দিয়েছেন? সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের উত্তরে সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘আসলে পুরো বিষয়টি এসেছে প্রয়োজন থেকে। তখন দেশে প্রচুর দরজা আর আসবাব মালয়েশিয়া থেকে আমদানি শুরু হয়েছিল। সেই আমদানিকৃত পণ্যগুলো বাজারে আসতেই বুঝলাম—ডিজাইন, মান এবং দামে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করাই আসল চ্যালেঞ্জ। তখনই আধুনিক মেশিনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি।’

সেলিম এইচ রহমান আরও বলেন, ‘কিন্তু শুধু মেশিন থাকলেই হবে না—প্রোডাক্টিভিটি, কর্মপরিবেশ এবং ফ্যাক্টরির কাজের প্রক্রিয়াও উন্নত করতে হবে। এসব বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ ছিলাম না, তাই পেশাদারদের নিয়োগ দিই, তাঁদের কাছ থেকে শিখি, নিজের টিমকেও শেখাই।’

সঞ্চালক এবার ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেন, অনলাইনে শোরুম চালু করার ধারণাটি কীভাবে আপনার মাথায় এল?

আরও পড়ুনব্যর্থতার শিক্ষা কাজে লেগেছে গোযায়ান প্রতিষ্ঠার সময়: রিদওয়ান হাফিজ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘আসলে ধারণাটি এসেছে একেবারে বাস্তব সমস্যার মধ্য থেকে। আমাদের ফার্নিচারের শোরুমগুলো সাধারণত বড় আকারের হয়, কারণ পণ্যগুলো ডিসপ্লে করতে অনেক জায়গা লাগে। কিন্তু ঢাকায় এত বিশাল স্পেস ভাড়া নেওয়া খুব ব্যয়বহুল, ফলে মুনাফায় থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন ভাবলাম অন্যভাবে চিন্তা করা যায় কি না? সেই চিন্তা থেকেই ভার্চ্যুয়াল শোরুমে বিনিয়োগ করি।’

গ্রিন ইনিশিয়েটিভ এবং ওয়েস্ট ইন্টিগ্রেশন কি নৈতিক দায়িত্ব না ব্যবসায়িক কৌশল? সঞ্চালক জানতে চাইলে সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘মানুষের প্রয়োজন থেকেই এই পরিবর্তনের সূত্রপাত। এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি, উড প্রসেসিংয়ের সময় যে ধুলা তৈরি হয়, তা কর্মীদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অনেকেই অসুস্থ হচ্ছিলেন, তাই আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখি এবং সেন্ট্রাল ডাস্ট এক্সট্রাকশন সিস্টেম চালু করি। এরপর ভাবলাম, কাঠের ডাস্ট যেগুলো আগে ফেলে দেওয়া হতো, সেগুলো রিসাইকেল করে কীভাবে কাজে লাগানো যায়। সেই ভাবনা থেকেই আমরা কাঠের ডাস্ট যেগুলো দিয়ে বোর্ড তৈরি শুরু করি। পরে দেখি, ফোম ও ফেব্রিকেরও অনেক অংশ নষ্ট হয়, সেগুলো দিয়েই আমরা এখন রিবন্ডেড ফোম তৈরি করছি।’

আলোচনার শেষ পর্যায়ে সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘পারিবারিক ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের জন্য যেমন অভ্যন্তরীণ সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত জরুরি, তেমনি তাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া সরাসরি বোর্ডে বসানো উচিত নয়। এটি কর্মীদের নিরুৎসাহিত করে।’

সেলিম এইচ রহমান স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘বাবা প্রথমে আমাকে একজন অফিস সহকারীর কাজ দিয়েছিলেন। আমার কাজ ছিল গ্রাহকদের চা দেওয়া এবং অফিসের ধুলা-ময়লা পরিষ্কার করা। তখন বিষয়টি খারাপ লাগলেও এখন বুঝি, তিনি আসলে আমাকে সব কাজের গুরুত্ব বোঝাতে এবং আমার ভেতরের সব অহংকারবোধ দূর করতেই এই কাজটি করেছিলেন।’

আরও পড়ুনব্যাংকিং খাতে আস্থা বাড়াতে নিজের কর্মপরিকল্পনা ও উদ্যোগের গল্প বললেন সৈয়দ মাহবুবুর রহমান২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন স ল ম এইচ রহম ন র জন য করছ ন ব যবস প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

লতিফ সিদ্দিকীর জামিন আবেদন মহানগর দায়রা আদালতেও নামঞ্জুর

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গ্রেপ্তার আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর জামিন আবেদন ঢাকার মহানগর দায়রা আদালতেও নামঞ্জুর হয়েছে।

ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ফারজানা ইয়াসমিন আজ রোববার এ আদেশ দেন। প্রথম আলোকে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর আইনজীবী গোলাম রব্বানী।

আইনজীবী গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, শাহবাগ থানায় করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গত ১১ সেপ্টেম্বর আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর জামিন আবেদন নাকচ করেন ঢাকার চিফ মেট্রপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত। ওই জামিন আবেদন চ্যালেঞ্জ করে লতিফ সিদ্দিকীর জামিন আবেদন করা হয় ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে। আজ তাঁর জামিন শুনানি হয়। আদালত তাঁর জামিন আবেদন নাকচ করেন। শিগগিরই লতিফ সিদ্দিকীর জামিন চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করা হবে।

গত ২৮ আগস্ট সকালে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, শেখ হাফিজুর রহমানসহ অন্যরা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিতে যান। ‘আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের সংবিধান’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনার আয়োজক ছিল ‘মঞ্চ ৭১’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। আলোচনা সভায় প্রথমে বক্তব্য দেন শেখ হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেশের সংবিধানকে ছুড়ে ফেলার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে জামায়াত-শিবির ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের জুতার মালা পরাচ্ছে।’

শেখ হাফিজুর রহমানের বক্তব্য শেষ হওয়ার পরই মিছিল নিয়ে একদল ব্যক্তি ডিআরইউ মিলনায়তনে ঢোকেন। একপর্যায়ে তাঁরা গোলটেবিল আলোচনার ব্যানার ছিঁড়ে আলোচনায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে পুলিশের (ডিএমপি) একটি দল এলে তাঁরা পুলিশের কাছে লতিফ সিদ্দিকী, শেখ হাফিজুর রহমান, সাংবাদিক মনজুরুল আলমসহ অন্তত ১৬ জনকে তুলে দেন। পরে তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশ। পরদিন তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। সেদিন লতিফ সিদ্দিকী ছাড়া অন্যরা জামিনের আবেদন করলে আদালত নাকচ করেছিলেন।

২৯ আগস্ট লতিফ সিদ্দিকীকে ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়েছিল। তখন তিনি ওকালতনামায় স্বাক্ষর করতে রাজি হননি। আদালতের প্রতি তাঁর আস্থা নেই বলে তখন তিনি উপস্থিত আইনজীবীদের বলেছিলেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ