স্বাস্থ্য খাতে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে: স্বাস্থ্য উপদেষ্টা
Published: 13th, January 2025 GMT
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেছেন, সাম্প্রতিক আন্দোলনে আমাদের এতগুলো বাচ্চা, এতগুলো ছেলে চোখ, হাত, পা হারিয়ে ফেললো— সব তো এই দেশের জন্যই করেছে। দেশের জনগণকে মুক্তির বাতাস নেওয়ার জন্য, বৈষম্যকে দূর করার জন্য তাদের এই অপরিমেয় আত্মত্যাগ। এই চেতনাকে ধরে রেখে সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের স্বাস্থ্য খাতে যে সমস্যাগুলো আছে, তা দূর করতে হলে আমাদের সবাইকে মিলে এগিয়ে আসতে হবে।
সোমবার (১৩ জানুয়ারি) সকালে তোপখানা রোডস্থ সিরডাপ মিলনায়তনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বাংলাদেশ হেলথ ওয়ার্কফোর্স স্ট্রাটেজি-২০২৪ প্রকাশের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, আমাদের পরিবারের মত রাষ্ট্রও একটা পরিবার। একটা পরিবারে যেমন মায়া, মমতা, ডিসিপ্লিন, দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ আছে— তেমনি একটা রাষ্ট্রের নাগরিকদের ভেতর সেই বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা উচিত। আমরা জনবল সংকটের কথা বলি কিন্তু সেই সঙ্গে যে জনশক্তি বিদ্যমান আছে সেগুলার যথাযথ ব্যবহারের কথাও বলা উচিত। এখন চট্টগ্রামে ও সিলেট অঞ্চলে নার্স পাওয়া যায় না। রংপুরে যার বাড়ি তার সিলেট অথবা চট্টগ্রামে পোস্টিং হলে সে কতদিন সেখানে কাজ করবে? তার ওপর নার্সদের বর্তমানে কোনো ক্যারিয়ার পরিকল্পনা নেই। কাজেই তাদের ক্যারিয়ার, ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা আমাদের ঠিক করতে হবে। জনবল আমরা ডিস্ট্রিবিউট করতে পারবো কিন্তু তার আগে আমাদের প্রয়োজনটা জানা দরকার।
তিনি বলেন, একটা পরিবারে বাবা যখন যেমন জিজ্ঞেস করে কী কী লাগবে? তেমনি কী কী খাতে কী রকম জনবল লাগবে সেটা নিয়েও আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে। মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের এনেশথেশিয়ার ডাক্তারের সংকট রয়েছে। এটার কারণ কী? এটা ছাত্ররা কম পড়তে চায় কারণ এতে প্রসার কম। কাজেই এই সমস্যাগুলোর গভীরে গিয়ে আমাদের সমাধান করতে হবে। ম্যানপাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন এবং জনশক্তি তৈরি করা এগুলো একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমরা চেষ্টা করছি ইনসেন্টিভ বা প্রণোদনা দিয়ে কিছু করা যায় কিনা। আমার ধারণার সঙ্গে আরও অনেক কিছু যোগ করতে হবে। শুধু প্রণোদনা দিয়ে হবে না। এটার জন্য সামাজিক স্বীকৃতিরও প্রয়োজন রয়েছে। স্বীকৃতি এবং সম্মানটা যদি আমরা দিতে পারি তাহলে ছাত্ররা এটা পড়তে আগ্রহী হবে। এছাড়া আমাদের কোথায় কী রকম জনবল লাগবে, গাইনোকোলজিস্ট বেশি লাগবে নাকি ফার্মাসিস্ট বেশি লাগবে সেটাও আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে। একটা পরিবারে যেমন মায়া থাকে মমতা থাকে জবাবদিহিতাও থাকে। স্বাস্থ্য খাতে সকলের জবাবদিহিতা এবং দায়িত্ববোধও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা.
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমানের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন, স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর, ডব্লিউএইচওর বাংলাদেশ প্রতিনিধি আহমেদ জামশেদ মোহাম্মদ, ব্রিটিশ হাইকমিশনার ঢাকার ডেপুটি ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টর ডানকান ওভারফিল্ড প্রমুখ।
ঢাকা/আসাদ/এনএইচ
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
আউটসোর্সিং এবং শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন
আধুনিক শ্রমবাজারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তৃত খাত হলো আউটসোর্সিং। এ খাতের মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক প্রতিদিন সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। অথচ এই শ্রমিকদের অধিকাংশই শোভন কাজের মৌলিক মানদণ্ড থেকে বঞ্চিত। চাকরির স্থায়িত্ব নেই; সুরক্ষার নিশ্চয়তা নেই; নেই সংগঠনের অধিকার– এমন বাস্তবতায় শ্রমিকরা এক অনিশ্চিত ও অনুৎপাদনশীল পরিবেশে দিন কাটাচ্ছেন।
এ প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি শ্রম সংস্কার কমিশন সরকারের কাছে ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা: শ্রমিক-অধিকার, সুসমন্বিত শিল্প-সম্পর্ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি সুপরিকল্পিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনের বিভিন্ন অধ্যায়ে কাজের স্বীকৃতি, অধিকার, নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব নিয়ে যেসব সুপারিশ রাখা হয়েছে, তার মধ্যে আউটসোর্সিং খাতে নিযুক্ত শ্রমিকদের নিয়ে তৎপরতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে সরকারের রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত ১২৫০টি ঠিকাদারি সংস্থা জনবল সরবরাহ করছে। এর বাইরেও অগণিত অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা শ্রম আইনের তোয়াক্কা না করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকরা কর্মঘণ্টা, মজুরি, ছুটি, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার।
অধিকাংশ আউটসোর্সিং শ্রমিক ন্যূনতম মজুরি পান না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার নির্ধারিত মজুরি না দিয়ে বেতন থেকে অবৈধভাবে টাকা কেটে রাখে; উৎসব ভাতা দেয় না; ওভারটাইমের ভাতা দেয় না। সাম্প্রতিক ২০২৫ সালের আউটসোর্সিং নীতিমালায় উৎসব ভাতা ও বৈশাখী ভাতা অন্তর্ভুক্তিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলা যায়, তবে বাস্তবায়ন ও নজরদারি এখনও দুর্বল।
নীতিমালায় নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি সংক্রান্ত কোনো অর্থনৈতিক সুরক্ষা না থাকায় তারা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে অন্তঃসত্ত্বা হলেই চাকরিচ্যুতির শঙ্কা থাকে। বেসরকারি খাতে এ অবস্থা আরও ভয়াবহ। নতুন নীতিমালায় ৪৫ দিনের প্রসূতিকালীন ছুটি সংযুক্ত করা হয়েছে, যা বিদ্যমান শ্রম আইনের ১১২ দিনের বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আউটসোর্সিং শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার পথ রুদ্ধ। তারা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন না। করলে চাকরিচ্যুতির শিকার হন। ফলে শ্রমিকস্বার্থে কোনো সামাজিক সংলাপ বা দরকষাকষির সুযোগ থাকে না।
বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্য, ওয়াসা, নিরাপত্তা খাতে কর্মরত হাজার হাজার আউটসোর্সিং শ্রমিক পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। করোনা মহামারিতে তারা সম্মুখ সারিতে থেকেও কোনো রকম ক্ষতিপূরণ পাননি। শ্রম বিধিমালার ১৬(৩) অনুযায়ী মালিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ দুর্বল।
সে জন্য শ্রম সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে আউটসোর্সিং শ্রমিকদের জন্য যেসব সুপারিশ করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে এ খাতে শোভন কাজের নিশ্চয়তা আসবে। আউটসোর্সিং খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের শোভন কাজ, মৌলিক অধিকার এবং কর্মস্থলে সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
আমি মনে করি, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, করপোরেশন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ করতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থায়ী জনবল কাঠামো হালনাগাদ করে আইনের ধারা ও বিধি অনুসরণপূর্বক প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা দরকার। ঠিকাদারের মাধ্যমে সার্ভিস চার্জ বা কমিশনের ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সরাসরি নিয়োগ প্রদান নিশ্চিত করা দরকার। যারা ৫-১০ বছর বা তদূর্ধ্ব সময় ধরে কর্মরত থেকে দক্ষতা অর্জন করেছেন, তাদের শ্রম আইন অনুযায়ী অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মূল মালিককে দায়বদ্ধ করা দরকার।
শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত কাজ করতে রাজি না হলে তাদের চাকরিচ্যুত বা ভয়ভীতি প্রদর্শন করা যাবে না। এ বিষয়ে শ্রম পরিদর্শন দপ্তর কঠোর নজরদারি করবে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, দপ্তর ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আউটসোর্সিং বন্ধ করতে হবে। যেসব দপ্তর ও সেবা খাতে ইতোমধ্যে আউটসোর্সিং করা হয়েছে, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে স্থায়ী নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রত্যাশা একটাই– শোভন কাজের বাস্তবায়ন। এ খাতের বৈষম্য কমাতে হলে সরকারের নীতিগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপ দরকার। একই সঙ্গে সমাজকেও সচেতন হতে হবে, যাতে মানুষ সস্তা সেবার পেছনে শ্রমের শোষণকে গুরুত্ব দিতে শেখে।
মো. মাছুম বিল্লাহ: আইন কর্মকর্তা, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর