‘পানিযুদ্ধের’ পথে চীন ও ভারত, প্রবল ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
Published: 28th, January 2025 GMT
স্থানীয়দের বিক্ষোভ উপেক্ষা করে অরুণাচল প্রদেশে সিয়াং নদীর ওপর বাঁধ দিতে যাচ্ছে ভারত, উদ্দেশ্য হলো একই নদীর উজানে চীনের তৈরি বাঁধকে টেক্কা দেওয়া। কিন্তু এই দুই পাল্টাপাল্টি বাঁধ তৈরির দৌড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভাটির বাংলাদেশ।
ভারতের উত্তর-পূর্ব অরুণাচল প্রদেশে সিয়াং নদীর ধারে জড়ো হয়েছেন একদল বিক্ষোভাকারী। পড়ন্ত বিকেলে শীত উপেক্ষা করে সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়ে যাচ্ছেন তারা।
‘আনে সিয়াং (সিয়াং মা) এর ওপর কোনো বাঁধ হবে না,’ পারং গ্রামের বিক্ষোভকারীদের স্লোগানে শোনা যায়।
পারং গ্রাম এবং আশেপাশের এলাকায় বাস করেন কৃষিজীবী ‘আদি’ নৃ গোষ্ঠীর মানুষ। শত শত বছর ধরে অরুণাচলের পাহাড়ি এলাকায় বয়ে চলা সিয়াং নদীকে পবিত্র মেনে আসছেন তারা। কিন্তু বর্তমানে এই নদী, তাদের গ্রাম, এমনকি তাদের জীবিকা পড়তে যাচ্ছে হুমকির মুখে। কারণ সিয়াং নদীর ওপর তৈরি হতে যাচ্ছে ভারতের বৃহত্তম বাঁধ। রিপোর্ট- আল জাজিরা।
ভারত সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক ১৩ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যায়ে তৈরি হবে সিয়াং আপার মাল্টিপারপাস প্রজেক্ট। এই বাঁধ ধরে রাখবে নয় বিলিয়ন ঘনমিটার পানি, আর উৎপাদন করবে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। বাঁধ থেকে এত বিশাল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের নজির ভারতে নেই। ২০১৭ সালে প্রস্তাবনা দেওয়ার পর বর্তমানে এই বাঁধ তৈরির সম্ভাব্যতা নিয়ে চলছে জরিপ।
তবে বাঁধ তৈরির খবরে অসন্তুষ্টির ছায়া নেমে এসেছে সিয়াং নদীর অববাহিকায় বসবাস করা কৃষিজীবী মানুষের মনে। সিয়াং নদীতে বাঁধ দিলে পুরোপুরি তলিয়ে যাবে অন্তত ২০টি গ্রাম, এছাড়া আংশিক নিমজ্জিত হবে ভাটির আরও ১২টি গ্রাম। ঘরছাড়া হয়ে পড়বে হাজারো মানুষ।
এলাকাবাসীর বিক্ষোভ দমন করতে আধা-সামরিক বাহিনী নামাতে নির্দেশ দিয়েছে ভারত সরকার। তবে এখনও এই অঞ্চলে কোনো সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়নি।
"সরকার আমাদের জমি নিয়ে নিচ্ছে, আমাদের ‘সিয়াং মা’কে নিয়ে নিচ্ছে, এখানে ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলায় পাঁয়তারা করছে। আমরা তা হতে দিতে পারি না," বলেন স্থানীয় বাসিন্দা গেগং জিজং। তিনি সিয়াং আদিবাসী কৃষক ফোরামের প্রধান।
‘আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি, ততক্ষণ এই বাঁধ হতে দেবো না।’
ভারত সরকারের মতে, বিক্ষোভকারীরা ভুল বুঝছেন। অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু দাবি করেন, এই বাঁধের উদ্দেশ্য শুধু পানিবিদ্যুৎ নয়, বরং সিয়াং নদীকে বাঁচানো।
কিন্তু কার হাত থেকে সিয়াং নদীকে বাঁচাতে চাইছে ভারত?
উত্তর হলো- চীন।
দুই দেশের ঠুনকো সম্পর্ক
ভূ-রাজনৈতিক কারণে পানি সরবরাহ, পানি নিরাপত্তা নিয়ে অনেকদিন ধরেই ভারত ও চীনের মাঝে রয়েছে রেষারেষি। এর রেশ ধরে সীমান্ত এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনাও দেখা যাচ্ছে কিছু বছর ধরে।
যে সিয়াং নদী নিয়ে দুই দেশের মাঝে অশান্তি চলছে, তার উৎপত্তি তিব্বতের মেদং এলাকায়, কৈলাস পর্বতে। স্থানীয়ভাবে নদীটির নাম ইয়ারলুং জাংবো/সাংপো। তিব্বত থেকে নদীটি অরুণাচলে প্রবেশ করে, হয়ে যায় প্রশস্ত। ভারত হয়ে বাংলাদেশে এসে নদীটি মিশে যায় বঙ্গোপসাগরে।
ভাবছেন, কী সেই নদী? তাকে আমরা চিনি ব্রহ্মপুত্র নদ নামে।
গত মাসে চীন জানায়, ইয়ারলুং জাংবো নদীর ওপর তারা তৈরি করতে যাচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম বাঁধ। বাঁধটি বসবে ঠিক ভারত-চীন সীমান্ত ঘেঁষে, মেদং অঞ্চলে। ১৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নির্মিত হবে বাঁধটি। তবে এই বাঁধের কারণে কী পরিমাণ গ্রাম বা বাসিন্দা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এ বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। বছরে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে এ থেকে।
ইয়ারলুং জাংবো এবং তার শাখা-প্রশাখার ওপর এর আগেও ছোট ছোট বাঁধ দিয়েছে চীন। তবে এটাই হবে সর্ববৃহৎ, জানিয়েছেন বি আর দীপক, দিল্লীর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইনিজ স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক।
চীনের এই ঘোষণার পরপরই বাঁধের বিপরীতে বাঁধ দেওয়ার কথা ভাবে ভারতের সরকার। ভারতের মতে, চীন বাঁধ দিলে সিয়াং নদীর গতিপথে পড়বে নেতিবাচক প্রভাব। কিন্তু ভারত পাল্টা একটি বাঁধ দিতে পারলে এই প্রভাব কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, আর হুটহাট বন্যা বা খরার সম্ভাবনাও কমে যাবে।
স্থানীয়দের বুঝ দিতে ভারতীয় রাজনীতিবিদরা বলেন, চীন যে কোনো সময়ে তাদের বাঁধ খুলে দিয়ে বন্যায় ভাসিয়ে দিতে পারে সিয়াং নদীর তীর। এমন দুর্ঘটনা এড়াতেই পাল্টা বাঁধ দিতে হবে ভারতকে।
কিন্তু এত কাছাকাছি দুইটি বাঁধ দিলে আদতে ওই নদীর অববাহিকায় যে লাখ লাখ মানুষ বাস করেন, তাদের উপকার না হয়ে বরং অপকার হওয়ারই ঝুঁকি রয়েছে, হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পরিবেশবাদী এবং বিশেষজ্ঞরা। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আদিবাসী জনগোষ্ঠী।
চীন এবং ভারত এই দুই দেশের ওপর দিয়েই যেসব নদী গেছে, সেসব নদীর পানি নিয়ে দেশ দুটির রেষারেষি নতুন কিছু নয়। তবে চীনের বাঁধের বিপরীতে সিয়াং নদীতে ভারত পাল্টা একটি বাঁধ দিলে আগুনে বরং ঘি ঢালা হবে, অধ্যাপক দীপক বলেন।
অস্ট্রেলিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান লোয়ি ইন্সটিটিউট ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে বলে, তিব্বতীয় মালভূমিতে উৎপত্তি হওয়া নদীগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে চীন। আর এর মাধ্যমে আসলে দেশটি ভারতের অর্থনীতির ‘গলা চেপে ধরার’ ক্ষমতাও রাখে।
পানি যখন অস্ত্র
চীনের ইতিহাসে ইয়ারলুং জাংবোকে বলা হয় ‘বেয়াড়া নদী’। চীনের অন্য সব নদীর মতো সে পশ্চিম থেকে পূর্বে যায়নি, বরং তীক্ষ্ণ এক বাঁক নিয়ে দক্ষিণে চলে গেছে, প্রবেশ করেছে ভারতে। সীমান্ত ঘেঁষে এই নদীতে চীনের বাঁধ বসবে, এতে ভারতের দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে বই কি।
দিল্লীর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইনিজ স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক সাহেলি চট্টজার মতে, এই বাঁধ ব্যবহার করে ভারতের ভেতরে এই নদীর পানি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে চীন। আর এতে দুই দেশের সম্পর্কেও প্রভাব পড়বে।
এই মতের সঙ্গে সম্মতি জানিয়ে অধ্যাপক দীপক বলেন, এই নদীর ভাটিতে অবস্থিত ভারত ও বাংলাদেশ, দুই দেশেরই আশঙ্কা আছে যে, পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে চীন। এই বাঁধ অনেক বিশাল পরিমাণে পানি ধরে রাখতে পারে (৪০ বিলিয়ন ঘনমিটার) এটাই বেশি ভয়ের ব্যাপার।
সমঝোতায় রয়েছে ঘাটতি
সুপেয় পানি ব্যবহার নিয়ে জাতিসংঘের একটি চুক্তি আছে, যাতে অংশ নিয়েছে বিভিন্ন দেশ। ভারত বা চীন কেউই ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। তবে এ দুই দেশ ২০০২ সালে আলাদা একটি চুক্তি করে, যাতে বলা হয় বর্ষার মৌসুমে ব্রহ্মপুত্রের পানি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য একে অপরকে সরবরাহ করবে তারা।
কিন্তু ২০১৭ সালে ভুটানের কাছাকাছি চীন-ভারত সীমান্তে এক সামরিক সংঘর্ষের পর বেইজিং থেকে এ তথ্য সরবরাহ ব্যহত হয়। সে বছর বসন্তেই আসামে একের পর এক বন্যা দেখা দেয়, এতে নিহত হন অন্তত ৭০ জন, বাস্তচ্যুত হন চার লাখ মানুষ।
‘যখনই দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হয়, চীন সাথে সাথে তথ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়,’ দাবী করেন অধ্যাপক দীপক।
ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে মেদং বাঁধ নির্মাণের ঘোষণা দেয় চীন। এর পর পরই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় ভারত। এর প্রেক্ষিতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং সাংবাদিকদের বলেন, ভাটি অঞ্চলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না, এবং বেইজিং ভাটির দেশগুলোর সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবে।
এ মন্তব্যের পরও চীনের ওপর ঠিক ভরসা করতে পারছে না ভারত।
ভারত ও চীনের মাঝে সম্পর্কের তিক্ততা এত সহজে দূর হবে না, বলেন মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াভিত্তিক পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। তিনি বলেন, পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে বিভিন্ন দুর্যোগের শিকার হয়েছে ভারত ও চীন। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে, এবং পানি নিয়ে এই দুই দেশের মাঝে টানাপোড়েন চলতেই থাকবে।
ভূমিকম্পের ভয়
ভূমিকম্পের দিক দিয়ে হিমালয় খুবই উর্বর একটি অঞ্চল। ২০ শতকের অন্তত ১৫ শতাংশ বড় ভূমিকম্প এই এলাকাতেই ঘটে, বলেন অধ্যাপক দীপক। এই মাসেরই ৭ তারিখেই তিব্বতের দিংরি অঞ্চলে এক ভূমিকম্পে নিহত হয়েছেন অন্তত ১২৬ মানুষ। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলের অন্তত ১৪টি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই ভূমিকম্পে। কিছু বাঁধের দেওয়াল হেলে গেছে, কোথাও কোথাও ফাটল দেখা দিয়েছে। তিনটি বাঁধের পানি নিষ্কাশন করা হয়েছে, সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু গ্রামের বাসিন্দাদের। চীন ও ভারত যে দুটি নতুন বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে, ভূমিকম্পে এর কোনো একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ঝুঁকিতে পড়ে যাবে ভাটি অঞ্চলের অগুণিত মানুষ।
বাংলাদেশের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি
বাঁধ নিয়ে ভারত ও চীনের মাঝে দড়ি টানাটানি চলছে বটে, কিন্তু এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ। ব্রহ্মপুত্রের মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে গেছে, কিন্তু দেশের ৬৫ শতাংশ পানিই আসে এই নদ দিয়ে, বলেন শেখ রোকন, ঢাকাভিত্তিক সংস্থা রিভারাইন পিপলের মহাসচিব।
"চীন ও ভারতের মাঝে এই 'বাঁধের বদলে বাঁধ' প্রতিযোগিতায় আমাদেরই ক্ষতি হবে বেশি," তিনি আল জাজিরাকে বলেন।
একই ভয় পাচ্ছেন মালিক ফিদা খান, ঢাকাভিত্তিক সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এর নির্বাহী পরিচালক।
"আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রতিবেদন, নেই, এমনকি বাঁধ তৈরিতে কী প্রযুক্তি ব্যবহার হতে পারে এরও তথ্য জানি না আমরা," তিনি বলেন।
মালিক ফিদা খান আরও বলেন, বঙ্গোপসাগরে মিশে যাওয়ার আগে ব্রহ্মপুত্র তৈরি করেছে পাললিক বদ্বীপ। উজানে বাঁধ তৈরির কারনে পলিমাটির গতিপথে কোনো পরিবর্তন এলে আরও বেড়ে যেতে পারে ভাঙনের পরিমান।
একটি বাঁধ দিয়ে আরেকটি বাঁধের মোকাবিলা করা যায় না, তিনি বলেন। বরং ভাটি অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের ওপর বিশাল দুর্যোগ নেমে আসবে তাতে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান নীতি হলো হাত গুটিয়ে অপেক্ষা করা, কিন্তু এই নীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে, শেখ রোকন মনে করেন।
"ব্রহ্মপুত্র নদ নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বাংলাদেশ-ভারত বা ভারত-চীনের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, বরং এর অববাহিকার সব দেশ নিয়েই আলোচনায় বসা উচিত।"
বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে দিল্লীর সুসম্পর্ক ছিল। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে ভাটা পড়েছে। এর ফলে ব্রহ্মপুত্রের ওপর চীনের বাঁধ দেওয়া নিয়েও বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে কোনো যৌথ উদ্যগ দেখা যাচ্ছে না, বিশ্লেষকরা বলেন।
মালিক ফিদা খানের মতে, এই সুযোগে নিজেদের সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে পারে বাংলাদেশ ও ভারত। কিন্তু উইলসন সেন্টারের মাইকেল কুগেলম্যান এতটা আশাবাদী হতে পারছেন না।
"ভারত আর বাংলাদেশ একজোট হয়ে চীনের ওপর চাপ প্রয়োগ করলেও তাদের কাজে বাধা দেওয়ার জন্য তা যথেষ্ট হবে না," তিনি মনে করেন। যত সময় গড়াবে, এই বাঁধের কারণে ভাটির মানুষের ক্ষতির আশংকাও তত বাড়বে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ভ ম কম প ব যবহ র সরক র র সরবর হ এল ক য় র ওপর সবচ য়
এছাড়াও পড়ুন:
৭৭ মেট্রিক টন চাল তুলে নিয়েছেন ডিলার, উপকারভোগীরা জানেন ‘বরাদ্দ হয়নি’
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় গত জুলাই মাসে ট্রেডিং করপোরেশন বাংলাদেশের (টিসিবি) উপকারভোগীদের জন্য ৭৭ দশমিক ৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছিল। প্রক্রিয়া অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে এ চাল খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (ওএমএস) একজন ডিলার (পরিবেশক) তুলেও নেন। তবে ওই মাসে টিসিবির অন্য পণ্য পেলেও চাল পাননি বলে অভিযোগ করেছেন উপকারভোগীরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মহম্মদপুরের ৮ ইউনিয়নে টিসিবির উপকারভোগী কার্ডধারী আছেন ১৫ হাজার ৫৬৭ জন। এসব উপকারভোগী নিজেদের কার্ড দেখিয়ে প্রতি মাসে একবার ইউনিয়নের টিসিবির নিয়োগ করা ডিলারের কাছ থেকে বাজারের চেয়ে কম মূল্যে তেল, চিনি, ডাল ও চাল কিনতে পারেন। গত জুলাইয়ে ডিলারদের কাছ থেকে তেল, চিনি ও ডালের একটি প্যাকেজ কিনতে পেরেছেন তাঁরা। ওই মাসে চালের বরাদ্দ আসেনি বলে জানানো হয় কার্ডধারীদের।
মহম্মদপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে পাওয়া নথিতে দেখা গেছে, গত ৩০ জুলাই উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মজনুর রহমান স্বাক্ষরিত দুইটি বিলি আদেশে (ডিও) উপজেলার হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে একজন ওএমএস ডিলারের অনুকূলে ৭৭ দশমিক ৮৩৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই দিনই মহম্মদপুর ও বিনোদপুর খাদ্যগুদাম থেকে এ চাল তুলেও নেওয়া হয়।
সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।শরিফা, টিসিবির কার্ডধারী, রাজাপুর ইউনিয়নটিসিবি ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন টিসিবি উপকারভোগীদের চাল ছাড়া অন্য পণ্য সরাসরি তাঁদের নিয়োগ করা ডিলারদের কাছে সরবরাহ করে। চালের বরাদ্দ দেওয়া হয় খাদ্য বিভাগ থেকে। এ অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে প্রথমে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ করা ওএমএস বা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলারদের অনুকূলে ২৬ টাকা কেজি দরে চাল বরাদ্দ দেয়। সেই চাল ওই ডিলারদের কাছ থেকে ২৮ টাকা কেজি দরে নেন টিসিবির ডিলাররা। এরপর তাঁরা ৩০ টাকা কেজি দরে ওই চাল উপকারভোগীদের কাছে বিক্রি করেন।
উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের পারুল নামে টিসিবির এক উপকারভোগী ১ সেপ্টেম্বর জানান, আগস্ট মাসে চাল, ডাল, তেল ও চিনির প্যাকেজ পেলেও জুলাই মাসে তাঁদের চাল ছাড়া অন্য তিন ধরনের পণ্যের প্যাকেজ দেওয়া হয়েছিল। জুলাই মাসে তাঁদের জানানো হয় চাল বরাদ্দ হয়নি।
বিষয়টি জানতে উপজেলার ৮ ইউনিয়নে টিসিবির নিয়োগ করা ৮ জন ডিলারের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের মধ্যে মহম্মদপুর সদর, নহাটা, পলাশবাড়ীয়া, বালিদিয়া, রাজাপুর ও বাবুখালী ইউনিয়নের ডিলার জানিয়েছেন, জুলাই মাসে তাঁদেরকে চাল দেওয়া হয়নি। নহাটা ও রাজাপুর ইউনিয়নের ডিলার মিলন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মিলন ঘোষ ৪ সেপ্টেম্বর বলেন, ‘জুলাই মাসে আমাদের বলা হইছিল চাল বরাদ্দ নেই। এ কারণে চাল ছাড়া অন্য পণ্যগুলো বিক্রি করেছি। তবে অ্যাপে দেখাইছিল চাল। কিন্তু আমরা পাইনি।’
হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পানঅবশ্য বিনোদপুর ও দীঘা ইউনিয়নের দুই ডিলার দাবি করেছেন তাঁরা অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে চালও কার্ডধারীদের কাছে বিক্রি করেছেন। তবে দুই ইউনিয়নের অন্তত ১০ জন উপকারভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাঁরা কেউই চাল পাননি। এর মধ্যে বিনোদপুর বাজারের একজন ফল ব্যাবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জুলাই মাসে ডিলার জানাইছিল চাল ফুরায় গেছে।’
হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পান বলে খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে হোসেনিয়া কান্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে সরবরাহ করা তাঁর মুঠোফোনে সোমবার যোগাযোগ করা হলে একজন ধরে জানান, ওই নম্বর হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে কেউ ব্যবহার করেন না।
জানতে চাইলে টিসিবির ঝিনাইদহ ক্যাম্প অফিসের উপপরিচালক আকরাম হোসেন সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিসিবির চাল খাদ্য বিভাগ থেকে সরবরাহ করা হয়। আর বিতরণ কার্যক্রম তদারকির জন্য প্রতিটি উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। যেখানে প্রতি ইউনিয়নে একজন ট্যাগ অফিসার আছেন, যিনি এগুলো তদারকি করেন।’
জেলার কয়েকজন চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৬ টাকা কেজি দরে কেনা এসব চাল বাজারে প্রায় ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। উপকারভোগীদের কাছে তা ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করার কথা। এ হিসাবে উপকারভোগীদের ফাঁকি দিয়ে এ চাল বাজারে বিক্রি করতে পারলে কেজিতে ২২ থেকে ২৪ টাকা লাভ হয়।
চাল না পাওয়ার বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি বলে জানিয়েছেন মহম্মদপুরের ইউএনও শাহীনুর আক্তার। সোমবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাল দেওয়া হয়নি এখন পর্যন্ত এমন অভিযোগ কেউ দেয়নি। খাদ্য অফিস থেকে আমি যত দূর জানতে পেরেছি তাতে সবকিছু দেওয়া হয়ে গেছে। বরাদ্দ থাকলে তা আটকে রাখার সুযোগ নেই। তারপরও কোনো অভিযোগ থাকলে খতিয়ে দেখব।’
হঠাৎ এক মাসে চাল না পাওয়ায় বিপাকে পড়েন উপকারভোগীরা। রাজাপুর ইউনিয়নের শরিফা নামের টিসিবি কার্ডধারী এক নারী বলেন, ‘সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।’