যুদ্ধ বন্ধের কথা বলা ট্রাম্প এখন চান গাজার দখল
Published: 6th, February 2025 GMT
নির্বাচনী প্রচারণায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন না, যুদ্ধ বন্ধ করতে যাচ্ছেন। তাঁকে ভোট দিয়েছিলেন মুসলিমসহ আরব মার্কিনিরা। শপথের আগেই দূতিয়ালি করে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকরে সফল হন। কিন্তু এবার তিনি যা বললেন, তা ছিল নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘাঁ’র মতো। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প জানান, তিনি গাজা দখল করতে চান এবং সেখান থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক সরিয়ে দেবেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের আগে আর কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে এভাবে একপক্ষীয় অবস্থান নেননি। তীব্র সমালোচনা করে অনেকে এটাকে ট্রাম্পের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন ও ‘আকাশকুসুম কল্পনা’ বলেও বর্ণনা করছেন। ট্রাম্প যখন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করছিলেন, তখন হোয়াইট হাউসের বাইরে অবস্থান নিয়ে শত শত বিক্ষোভকারী স্লোগান তোলেন, ‘ফিলিস্তিন বিক্রির জন্য নয়’। তারা ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের দাবি জানান ও ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন।
বিক্ষোভকারীদের একজন মাইকেল সার্জার বলেন, মার্কিনিরা চান না তাদের করের টাকায় ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হোক। আলজাজিরাকে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের মানুষ কোথাও যাচ্ছে না। তারা ওই ভূখণ্ডের আদিবাসী। লোকজনকে জোর করে সরিয়ে দেওয়াটা দখলদারি মানসিকতা। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ছিলেন ইরানি বংশদ্ভূত মার্কিনি সোফিয়া আহমেদও। গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দিতে ট্রাম্পের পরিকল্পনার কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। সোফিয়া বলেন, ‘তিনি (ট্রাম্প) একজন ফ্যাসিস্ট, সাইকোপ্যাথ ও তীব্র আত্মপ্রেমী।’ এ সময় তিনি নেতানিয়াহুকে ‘গণহত্যার মূল স্থপতি’ বলে বর্ণনা করেন।
কয়েকদিন ধরে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছেন ট্রাম্প। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হোয়াইট হাউসে নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে ট্রাম্প আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, তিনি গাজা দখল করবেন। সেখানে থাকা ফিলিস্তিনিদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে চলে যেতে বলেন তিনি। ট্রাম্প বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র গাজা উপত্যকার দখল নেবে; আমরা এটিকে নিয়ে কাজও করব। আমরা এটির মালিক হব এবং সেখান থেকে সব বিপজ্জনক অবিস্ফোরিত বোমা ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস করার দায়দায়িত্ব নেব।’
ট্রাম্প বলেন, ‘যদি প্রয়োজন হয়, আমরা এটা করব। আমরা ভূখণ্ডটির দখল নিতে যাচ্ছি। আমরা এটির উন্নয়ন করতে চলেছি। এখানে হাজার হাজার কাজের সুযোগ তৈরি হবে। এটা এমন কিছু হবে, যার জন্য পুরো মধ্যপ্রাচ্য অনেক গর্বিত হবে।’ এ সময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, তাহলে সেখানে থাকবে কে? তখন ট্রাম্প বলেন, জায়গাটিকে উন্নত করা হবে এবং বিশ্ববাসী সেখানে থাকবেন।
ট্রাম্পের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছেন গাজার বাসিন্দারা। গাজা সিটির বাসিন্দা ৬৫ বছরের উম তামের রয়টার্সকে বলেন, ‘আমরা আমাদের মাটি ছাড়ব না; আমরা দ্বিতীয় নাকবা চাই না।’ তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প একটা উন্মাদ। কোনো বোমা বা অনাহারের কারণে আমরা গাজা ছাড়ব না।’ আরেক বাসিন্দা সামির আবু বাসেল বলেন, ‘নিজের পরিকল্পনা, অর্থ আর বিশ্বাস নিয়ে ট্রাম্প জাহান্নামে যেতে পারেন, আমরা কোথাও যাচ্ছি না।’ এক ফিলিস্তিনি নারী বিবিসিকে বলেন, ‘গাজা আমাদের মাতৃভূমি; আমরা এখানে বাঁচব ও মরব। আমরা প্রায় দেড় বছর হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ মোকাবিলা করেছি; বলতে গেলে এখনও করছি। কিন্তু কখন এমনটা ভাবিনি।’
একটি জনগোষ্ঠীকে তার নিজ ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করে অন্যায়ভাবে তা দখলের এ পরিকল্পনায় নিন্দার ঝড় উঠেছে বিশ্বব্যাপী। এরই মধ্যে ফিলিস্তিন, মিসর, সৌদি আরব ও অন্যান্য দেশ এর নিন্দা জানিয়েছে। বুধবার কায়রোতে ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহামেদ মুস্তফার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদেল আতি। এ সময় তারা ট্রাম্পের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেন। দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও। আর হামাস বলেছে, এটা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শত্রুভাবাপন্ন বক্তব্য, যা আগুনে তেল ঢালার মতো কাজ করবে। এমন বক্তব্য এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনবে না। হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা সামি আবু জহরি বলেন, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরানোর আহ্বান হলো জাতিগত নিধন চালানোর শামিল। ট্রাম্পের পরিকল্পনা অবাস্তব ও হাস্যকর। ইরান বলেছে, তারা এ পরিকল্পনা সমর্থন করেন না।
ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া বলেছে, পশ্চিম তীর দখল ও গাজার মানুষকে সরিয়ে দেওয়া ইসরায়েলের পরিকল্পনা। সংঘবদ্ধ শাস্তি দেওয়ার পদ্ধতিকে রাশিয়া সমর্থন করে না। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গাজা থেকে জোরপূর্বক বাসিন্দাদের সরানোর পরিকল্পনার বিরোধিতার কথা জানিয়ে দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের কথা বলেছে। তুরস্ক এটাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে বর্ণনা করেছে। জার্মানি বলেছে, গাজা ফিলিস্তিনের মানুষের। তাদের সরানো হবে অগ্রহণযোগ্য ও আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী। এ ছাড়া ফ্রান্স, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার আবারও দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের বিষয়ে বলেছেন এবং ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানিয়েছেন। ট্রাম্পের বক্তব্যে যুদ্ধবিরতি ব্যাহত হতে পারে বলে যে শঙ্কা করা হচ্ছে, সেটাও তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন। ফিলিস্তিনের জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টার ফ্রান্সিসেসকা আলবানিজ বলেছেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনা ‘বেআইনি, অনৈতিক ও একেবারেই দায়িত্বজ্ঞানহীন।’ ট্রাম্প ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ করার পরামর্শ দিচ্ছেন।
ইসরায়েলের অনেক বাসিন্দা ট্রাম্পের পরিকল্পনার সমর্থন করছেন না। নেটিভ হাসারার বাসিন্দা হিলা ফ্যানলন বলেন, এটা কোনো সমাধান নয়। নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির ভেতরেও এ নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেন, গাজার সম্ভাব্য দখল হবে বিপজ্জনক। যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই এ বিষয়ে তার আরব মিত্রদের বক্তব্য শুনতে হবে।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে একযোগে কাজ করার আহ্বান উপদেষ্টার
দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতা যখন নতুন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঠিক সেই সময় দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর প্রতি আস্থা পুনর্গঠন, আঞ্চলিক সংযোগ জোরদার এবং যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তিনি এ আহ্বান জানান।
আরো পড়ুন:
পরিবেশবান্ধব ‘গ্রিন বিল্ডিং’ নির্মাণ এখন সময়ের দাবি: পরিবেশ উপদেষ্টা
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পরিবেশ উপদেষ্টার নির্দেশ
পরিবেশ উপদেষ্টা মঙ্গলবার পাকিস্তানের ইসলামাবাদে এসডিপিআই’র বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশন ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ইন দি ইমারজিং ওয়ার্ল্ড ডিজঅর্ডার’-এ অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, “বায়ুদূষণ, প্লাস্টিক দূষণ, পানি নিরাপত্তা এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের মতো যৌথ সংকট মোকাবিলায় দক্ষিণ এশিয়াকে এখনই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।”
নদী শাসন, ন্যায্য পানি বণ্টন এবং প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আঞ্চলিক সহায়তা জোরদারের ওপরও তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
উপদেষ্টা বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ায় ইতোমধ্যে ঘন-ঘন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহসহ আকস্মিক দুর্যোগের পাশাপাশি লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মাটির উর্বরতা হ্রাস ও কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার মতো ধীর গতির জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখোমুখি।”
তিনি আরো বলেন, “বাংলাদেশেন একাই তার জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজন ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়নের ঘাটতি স্পষ্ট করে। যদি অর্থ না-ও আসে, আমরা অপেক্ষা করে থাকব না।”
সম্মেলনের বিষয়বস্তুকে ‘সময়সাপেক্ষ ও গভীরতাসম্পন্ন’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “শাসন ব্যবস্থার নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক কাঠামো আজ সংকটে, বহুপাক্ষিকতা দুর্বল হচ্ছে, বৈষম্য, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যবস্থাকে নতুনভাবে গঠন করছে।”
তিনি বলেন, “শ্রীলঙ্কা থেকে নেপাল পর্যন্ত জনগণের বিক্ষোভ প্রমাণ করে বর্তমান শাসন মডেল জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ। তারা যুক্ত, সচেতন এবং প্রভাবিত হওয়ার মতো নয়—তাদের হাতেই তৈরি হচ্ছে নতুন বিশ্বব্যবস্থা।”
সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী প্রফেসর আহসান ইকবাল, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, জাপানের আইজিইএস প্রেসিডেন্ট প্রফেসর কাজুহিকো তাকেওচি, পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. ইকবাল হোসেন খান, এসডিপিআই চেয়ারম্যান অ্যাম্বাসাডর শফকত কাকাখেল, এসডিপিআই নির্বাহী পরিচালক ড. আবিদ কাইয়ুম সুলেরি এবং এআইওইউ-এর ড. ইরশাদ আহমদ আরশাদ।
ঢাকা/আসাদ/সাইফ