টানা চার মাস বায়ুদূষণের রেকর্ড, নাকাল ঢাকাবাসী
Published: 4th, March 2025 GMT
বায়ুদূষণের প্রভাব রোধে এয়ার পিউরিফায়ার বা বায়ু বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র আমদানির ওপর শুল্ক কমায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ পদক্ষেপ নেওয়া হয় গত জানুয়ারি মাসে। এর পর থেকে এয়ার পিউরিফায়ার বিক্রি অনেকটা বেড়ে গেছে।
রাজধানীর গুলশান লিংক রোডে এয়ার পিউরিফায়ার বিক্রির প্রতিষ্ঠান স্মার্ট এয়ার বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠান সূত্র জানাচ্ছে, গত বছরের চেয়ে এবার তাদের পণ্য বিক্রি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে অন্তত এক শ পিস এয়ার পিউরিফায়ার বিক্রি হয়েছে।
এমন কোনো কাজ করা হয়নি, যাতে দূষণ নিয়ন্ত্রণে আসে। বায়ুদূষণ এমন বিষয়, তা এক দিনে যাবে না সত্য। এর জন্য সময়ভিত্তিক এবং এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। অধ্যাপক আব্দুস সালাম, দূষণবিশেষজ্ঞদূষণ রোধের এ যন্ত্রটির দাম অনেক। কেবল ছোট গাড়িতে ব্যবহারের জন্য এমন একটি যন্ত্রের দাম ৫ হাজার টাকা। ৪০০ বর্গফুটের কোনো স্থানে ব্যবহারের যন্ত্রের দাম সাড়ে ১৭ হাজার এবং ৯০০ বর্গফুট স্থানে ব্যবহারের যন্ত্র ৫০ হাজার টাকা। এয়ার পিউরিফায়ারের ক্রেতা সমাজের উচ্চ আয়ের মানুষ, বিক্রেতারা এমনটাই জানালেন।
নগরীতে বায়ুদূষণ বাড়ছে রেকর্ড হারে। গত বছরের (২০২৪) ডিসেম্বরে ঢাকা নগরীর দূষণ ছিল আগের ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। জানুয়ারিতেও তাই। আর সদ্য শেষ হওয়া ফেব্রুয়ারির দূষণ আগের আট বছরকে ছাড়িয়ে গেছে। বায়ুদূষণের এমন পরিস্থিতির তথ্য দিয়েছে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।
দূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের রোগশোক। ঢাকার ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালের তথ্যই প্রমাণ করছে দূষণে কতটা নাকাল নগরবাসী। ৩১ দিনের জানুয়ারি মাসের তুলনায় ২৮ দিনের ফেব্রুয়ারিতে সেখানে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা বেশি।
দূষণের রেকর্ড ৪ মাসে
সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বায়ুদূষণ অনেক বেড়ে যায়। এবারের শুষ্ক মৌসুমে নভেম্বর থেকে টানা চার মাস রাজধানীর বায়ুদূষণ আগের আট বছরকে ছাড়িয়ে গেছে।
বায়ুর মান শূন্য থেকে ৫০ থাকলে ‘ভালো’ বলা হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে ‘গ্রহণযোগ্য’। ১০১ থেকে ১৫০ ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ক্ষতিকর’, ১৫১ থেকে ২০০ ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১ থেকে ৩০০ ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০০-এর বেশি হলে তা হয় ‘দুর্যোগপূর্ণ’।
ক্যাপস ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে পাওয়া এয়ার নাওয়ের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ঢাকার বায়ুমান পর্যবেক্ষণ করছে ২০১৭ সাল থেকে। সেই গবেষণা অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার বায়ুর মান ছিল ২৬২। এটি ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এর মান ছিল ২৫৮। ২০২৩–এর ফেব্রুয়ারিতে এর মান ছিল ২২৫।
শুধু এবারের ফেব্রুয়ারি নয়। গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি—প্রতিটি মাস ছিল দূষণের দিক থেকে আগের আট থেকে ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি টানা চার মাসে আমাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, দূষণে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এমনটা আর কোনো বছরে হয়নি। দূষণ পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ, তা বোঝা যায়। কিন্তু এই দূষণ রোধে দুই সিটিসহ সরকারের দপ্তরগুলোর কার্যকর তৎপরতা দেখছি না।’
ঢাকার দুই সিটি কী করছে
ঢাকার দূষণে যানবাহন ও কলকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া, ইটভাটা, নির্মাণকাজের ধুলাবালু ইত্যাদি উপাদানই মুখ্য। পরিবেশ অধিদপ্তর দূষণের পর্যবেক্ষণ করে। কিন্তু কলকারখানা, নির্মাণকাজসহ নানা বিষয় দুই সিটি করপোরেশনের এখতিয়ারভুক্ত। সিটিগুলো পানি ছিটানো, নির্মাণকাজে মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনার মধ্যে তাদের কাজ সীমাবদ্ধ রাখে। তাতে যে কাজের কাজ তেমন হয় না, তা বাড়তে থাকা দূষণ প্রমাণ করে।
তবে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ এসব মানতে নারাজ। ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো.
ঢাকা উত্তরের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জানান, আগে দিনে একবার পানি ছিটানো হতো, এখন তিনবার হয়। তারপরও বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে ইটের ভাটা আর গাজীপুরের কলকারখানার ধোঁয়াকে দোষেন এই প্রশাসক।
প্রশ্ন করা হয়েছিল দূষণের এই দুই উৎস আগেও তো ছিল, তবে এখন তা এত বেড়ে গেল কেন? তাঁর উত্তর, ‘আমরা চেষ্টা করছি মান ভালো করতে। এর জন্য উন্মুক্ত স্থানে ঘাস লাগিয়ে ধুলা ওড়া বন্ধ করার কাজ করব।’
দূষণবিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, ‘এমন কোনো কাজ করা হয়নি যাতে দূষণ নিয়ন্ত্রণে আসে। বায়ুদূষণ এমন বিষয়, তা এক দিনে যাবে না সত্য। এর জন্য সময়ভিত্তিক এবং এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। তার তো নামগন্ধ নেই।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন য র কর ড বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
গংগাচড়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ, আতঙ্ক কাটেনি এখনও
রংপুরের গংগাচড়ায় ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ঘিরে সহিংসতার শিকার হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। তবে ঘটনার তিন দিন পরেও এলাকায় ফেরেনি অনেক পরিবার। আতঙ্কে এখনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে।
গত ২৭ জুলাই রাতে ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার আগে এলাকায় মাইকিং করে লোকজন জড়ো করা হয়।
পুলিশ, প্রশাসন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, যারা হামলা করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন ‘বহিরাগত’। পাশের নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা থেকে লোকজন এসে হামলা চালিয়ে চলে যায়। হামলার সময় ২২টি ঘরবাড়ি তছনছ ও লুটপাট করা হয়।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এলাকায় অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প বসানো হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে পুলিশ টহল। প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঢেউটিন, কাঠ, চাল-ডাল ও শুকনো খাবার বিতরণ করেছে এবং ঘরবাড়ি মেরামতের কাজও শুরু হয়েছে। তবু আতঙ্কিত পরিবারগুলো।
ক্ষতিগ্রস্তদের একজন অশ্বিনী চন্দ্র মোহান্ত বলেন, “সেদিনের ঘটনা ছিল এক ভয়াবহ। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে ধর্ম অবমাননাকারী কিশোরকে থানা হেফাজতে দিয়েছি। কিন্তু তারপরও ঘরবাড়ি রক্ষা হয়নি। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি এবং কিছু মুরুব্বি আমাদেরকে অভয় দিয়েছিলেন, কিন্তু রক্ষা হয়নি।”
তিনি আরো বলেন, “আমরা নিজেরাই অভিযুক্ত কিশোরকে থানায় সোপর্দ করেছি। তারপরও মিছিল নিয়ে এসে দুই দফায় আমাদের ২০ থেকে ২৫টি ঘরবাড়ি তছনছ করে দিয়ে লুটপাট করেছে তারা। এদের মধ্যে অধিকাংশ লোকেই অপরিচিত।”
আরেক ভুক্তভোগী দেবেন্দ্র চন্দ্র বর্মন জানান, “প্রথমে অল্পসংখ্যক কম বয়সী কিছু ছেলে আসে। পরে হাজারো লোকজন এসে আমাদের বাড়িঘরে তাণ্ডব চালায়। অনেকেই এখনো আত্মীয়দের বাড়িতে। আমরা চরম আতঙ্কে আছি।”
রবীন্দ্র চন্দ্রের স্ত্রী রুহিলা রানী বলেন, “ছোট ছেলেটা যদি ভুল করে থাকে, আমরা তাকে থানায় দিয়েছি। কিন্তু তারপরও এমন ধ্বংসযজ্ঞ কেন? আমাদের গরু, সোনা-টাকা সব লুটে নিয়েছে। শুধু চাল-ডাল আর টিনে কি জীবন চলে?”
গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রংপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম ও সদস্য সচিব আনিসুর রহমান লাকুসহ একটি প্রতিনিধি দল। তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরণ করেন এবং পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
গংগাচড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আল এমরান বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে কিশোরটিকে গ্রেপ্তার করে থানায় আনা হয় এবং পরে আদালতের মাধ্যমে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এখন পর্যন্ত কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তারপরও পুলিশ প্রশাসন সর্বাত্মক নিরাপত্তায় নিয়োজিত।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহামুদ হাসান মৃধা বলেন, “অপরাধীদের ধরতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হচ্ছে সহায়তা। পুলিশ ও সেনাবাহিনী পুরো এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে।”
উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্যমতে, হামলায় ১৫টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাতে ২২টি পরিবার বসবাস করতেন। ঘর মেরামতের পর কিছু পরিবার ফিরলেও অভিযুক্ত কিশোর ও তার চাচার পরিবারের কেউ এখনো ফিরে আসেনি।
ঢাকা/আমিরুল/ইভা