ধনী-গরিবনির্বিশেষে একই প্লেটে সম্প্রীতির ইফতার
Published: 5th, March 2025 GMT
মসজিদের বারান্দায় প্লেটে প্লেটে সাজানো বাহারি সব ইফতারি। ইফতারের আধা ঘণ্টা আগে থেকেই মুসল্লিরা সারিবদ্ধভাবে বসতে শুরু করেন। ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মুসল্লির সংখ্যা বেড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর মুসল্লিদের হাতে হাতে ইফতারির প্লেট তুলে দেন মসজিদের খাদেম ও স্বেচ্ছাসেবকেরা। চার থেকে পাঁচজনের জন্য একটি করে প্লেট। কেউ কাউকে চেনেন না। অথচ পাশাপাশি বসে ইফতার করছেন। সবার একটাই পরিচয়, রোজাদার মুসল্লি।
বগুড়া শহরের বায়তুর রহমান সেন্ট্রাল জামে মসজিদে এমন সম্প্রীতির পরিবেশে গতকাল মঙ্গলবার ইফতার করতে দেখা গেল। ধনী-গরিব, শ্রেণি ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে পাঁচ শতাধিক মানুষ ইফতার করেন। এক প্লেটের চারদিকে চার থেকে পাঁচজন মুসল্লি বসে ভাগাভাগি করে ইফতার সারেন।
দেড় যুগ ধরে সম্প্রীতির বন্ধনে এমনভাবে ইফতারের আয়োজন করা হচ্ছে জানিয়ে মসজিদের খাদেম মো.
সরেজমিনে দেখা যায়, জোহরের নামাজের পর থেকে মসজিদে স্বেচ্ছাসেবীদের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। স্বেচ্ছাসেবকেরা প্লেটে ইফতারসামগ্রী সাজাতে শুরু করেন আসরের নামাজের পর। প্লেটে খেজুর, ছোলা, পেঁয়াজু, মুড়ি, বেগুনি, জিলাপি, বিরিয়ানি বা খিচুড়ি ও শরবত থাকে। ইফতারের আগমুহূর্ত পর্যন্ত রোজাদারদের হাতে প্লেট পৌঁছে দেওয়া হয়। মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ইফতার।
সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবদুল গণি। বয়স ৭৫ ছুঁই ছুঁই। মঙ্গলবার ইফতারের আধা ঘণ্টা আগে মসজিদে ইফতার করতে আসেন। মসজিদে মাগরিবের নামাজের আজান হতেই তাঁর প্লেটের সঙ্গে বসলেন রিকশাচালক জামাল উদ্দিন (৬০), দিনমজুর খাদেম আলী (৬৫) ও নির্মাণশ্রমিক বাকের উদ্দিন (৪০)। তাঁরা কেউ কাউকে চেনেন না। অথচ একসঙ্গে বসে একই প্লেটে ইফতার সারলেন।
মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ব্যবসায়ী তোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৮ সালে বায়তুর রহমান সেন্ট্রাল জামে মসজিদে নামাজ আদায় শুরু হয়। ওই বছরের রমজান মাস থেকেই মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে একসঙ্গে ইফতার আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই হিসাবে ১৮ বছর ধরে মসজিদে ইফতারের আয়োজন চলছে। মসজিদের মুসল্লি ছাড়াও শহরের বিত্তবানদের সহায়তায় এ আয়োজন করা হয়। রোজার এক সপ্তাহ আগে প্রস্তুতি শুরু হয়। মাসব্যাপী ৫০০ থেকে ৬০০ মানুষের মধ্যে ইফতার পরিবেশন করা হয়। প্রতিদিন স্বেচ্ছাসেবক ও খাদেমরা ইফতার পরিবেশনের কাজ করেন।
মসজিদের খাদেম হেলাল উদ্দিন বলেন, প্রতিদিন সোয়া মণ সুগন্ধি চাল এবং ১০ থেকে ১৫ কেজি গরুর মাংসের বিরিয়ানি রান্না করা হয়। এ জন্য বাবুর্চি নিযুক্ত করা আছে। বিরিয়ানির সঙ্গে ছোলা, বুন্দিয়া, জিলাপি, খেজুর, মুড়ি, তরমুজ ও শরবত দেওয়া হয়। রমজান শুরুর আগেই স্থানীয় ব্যবসায়ী ও মুসল্লিরা ইফতার তহবিলে সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ দেন। এবার এখন পর্যন্ত ইফতার তহবিলে সাড়ে ২৬ লাখ টাকা জমা হয়েছে। তিনি বলেন, এক মাসের মধ্যে অন্তত ১০ দিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে এক হাজার মানুষের ইফতারের আয়োজন করা হয়। বাকি ২০ দিন ইফতারের আয়োজন করে মসজিদ কমিটি। মসজিদের মুসল্লি ছাড়াও মুসাফির, ভিক্ষুক, শ্রমজীবীসহ নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ এতে অংশ নেন।
ইফতারে আসা অটোরিকশাচালক সেলিম হোসেন বলেন, উপার্জনের টাকায় চার সদস্যের সংসার চলে। ১০০ টাকার নিচে ইফতার পাওয়া যায় না। নিজের টাকায় ইফতারি কিনে খাওয়ার সামর্থ্য না থাকায় এখানে ইফতারে এসেছেন। এখানে ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই। এক প্লেটে পাঁচজন বসে ইফতার করতে অন্য রকম ভালো লাগে। সবাই পাশাপাশি বসে ইফতার করছেন।
ইফতার শেষে মসজিদের ফটকে কথা হয় গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ভরতখালী এলাকার চান মিয়ার সঙ্গে। পেশায় ভিক্ষুক চান মিয়া চার বছর ধরে রেলবস্তিতে থাকেন। বলেন, ‘রোজা ছিলাম। একই প্লেটে বিরিয়ানিসহ ইফতার করেছি। পেট ভরেছে। রাতে আকবরিয়া হোটেলে বিনা মূল্যে খাবার বিতরণ হবে। সেই খাবার সংগ্রহ করে সাহ্রি খাব।’
সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থী রিফাত আহম্মেদ বলেন, ‘মেসে থাকি। প্রতিদিন এই মসজিদে ইফতার করতে আসি। এখানে এক প্লেটে চার-পাঁচজন ভাগাভাগি করে ইফতার করার অনুভূতি অন্য রকম। এটা শুধু একসঙ্গে ইফতার নয়; পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইফত র করত ইফত র ক মসজ দ র র ইফত র একসঙ গ
এছাড়াও পড়ুন:
আইএমএফের পর্ষদ বৈঠক ২৩ জুন, এরপর মিলতে পারে দুই কিস্তি অর্থ
২৩ জুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী পর্ষদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচির দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়টি উত্থাপনের কথা রয়েছে। বৈঠকে অনুমোদন হলে চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় একসঙ্গে দুই কিস্তির অর্থ পাবে বাংলাদেশ। আইএমএফ গতকাল শুক্রবার তার কার্যসূচিতে নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকের এ তারিখ নির্ধারণসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আইএমএফের এ বৈঠকে চলমান ঋণ কর্মসূচির তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যালোচনার (রিভিউ) প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এ প্রতিবেদন পর্ষদ অনুমোদন করলে বাংলাদেশ একসঙ্গে পেয়ে যাবে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ। দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে হতে পারে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
এর আগে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য সাড়ে তিন বছর মেয়াদি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। ঋণ অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, ঝুঁকিতে থাকা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে এ ঋণ কর্মসূচি। চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, টাকার দরপতন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া—মূলত এ তিন কারণে ওই সময় আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির মধ্যে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিলসহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ৩৩০ কোটি ডলার। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ১৪০ কোটি ডলার। আরএসএফ আইএমএফের একটি নতুন তহবিল, যেখান থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকেই প্রথম ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ও ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে এখন পর্যন্ত ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার।
আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ গত বছরের ডিসেম্বরে পাওয়ার কথা থাকলেও তা আর পাওয়া যায়নি। আইএমএফের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত। প্রায় প্রতিবছর ওয়াশিংটনসহ প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে বড় ধরনের তুষারপাত হয়। গত বছরও তাই হয়েছে। অতিমাত্রার বরফের কারণে অচল হয়ে যায় জনজীবন। মার্কিন প্রশাসন সতর্কবার্তা জারি করে। তুষারপাতের কারণে আইএমএফসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল অনেক দিন।
পরে আইএমএফের পক্ষ থেকে প্রথমে এ বছরের ফেব্রুয়ারি ও পরে মার্চে পর্ষদ বৈঠকের কথা বলা হয়। গত এপ্রিলে আইএমএফের একটি দল পর্যালোচনা করতে ঢাকায় আসে দুই সপ্তাহের জন্য। এর মধ্যে শর্ত পরিপালন নিয়ে দর–কষাকষিতে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় আটকে যায়। এরপর ওয়াশিংটনে গত ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। তখন দর-কষাকষি হচ্ছিল মূলত মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা নিয়ে। আইএমএফ তা চাইলেও করতে চাইছিল না সরকার।
সবশেষে গত মাসে এ নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কয়েকটি ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১২ মে দুই পক্ষ চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছায় ও বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে বাংলাদেশ। ১৪ মে আইএমএফ ওয়াশিংটন থেকে এক বিবৃতিতে জানায়, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে এবং ঋণের অর্থ ছাড় করা হবে জুনে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত পর্ষদ বৈঠকে অনুমোদন হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মাথায় আইএমএফ অর্থ ছাড় করে দেয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না।