যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি)-এর বিরুদ্ধে হতবাক করা প্রচারণা বা যুদ্ধকৌশল সংস্থাটিকে ‘বিশ্বের বৃহত্তম দাতা’ হিসেবে পরিচিত এ সংস্থাটিকে ধ্বংস করেছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তা ও মানবিক সহায়তা ব্যবস্থা উদ্ধার করতে সচেষ্ট কর্মীদের মরিয়া করে তুলেছে। এটা অস্বীকার করা যায় না, এই সহায়তা শিল্পের ওপর লাখ লাখ মানুষের জীবন নির্ভর করে।
এটা বলা যায়, ‘উন্নয়ন’-এর মূল বিষয় সবসময় তার প্রবক্তাদের দাবির তুলনায় অনেক কম মানবতাবাদী ছিল। প্রকৃতপক্ষে, সাহায্যের পুরো উদ্যোগটি ভূরাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং বিশ্বব্যাপী বৈষম্য দূর করার পরিবর্তে সম্পদ আহরণ ও জমানোর উপায়ে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইউএসএআইডির সমাপ্তির পর এই বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতনভাবে বা অচেতনভাবে ব্যাপারটি দিন দিন পরিষ্কার হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় মানবিক ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাদের বার্তা প্রচার করে যে সংস্থা সেই, ইন্টারঅ্যাকশন জারি করা একটি বিবৃতির কথা বলা যায়। সেখানে লেখা হয়েছে, এই সংস্থাগুলো ‘জীবন বাঁচাতে এবং বিশ্বব্যাপী মার্কিন স্বার্থ এগিয়ে নিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে’। এতে যুক্ত করা হয়েছিল, ইউএসএআইডির ওপর হামলার মধ্য দিয়ে ‘যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বকে সমর্থন করে এমন কর্মসূচি স্থগিত করেছে এবং বিপজ্জনক শূন্যতা তৈরি করেছে, যা চীন ও আমাদের প্রতিপক্ষরা দ্রুত পূরণ করবে।’
পশ্চিমা মানবতাবাদ শুধু পথ হারায়নি। এটি শুরু থেকেই পশ্চিমা উপনিবেশবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৮৪-১৮৮৫ বার্লিন সম্মেলন ইউরোপের আফ্রিকা বিজয়ের মঞ্চ তৈরি করেছিল, যা একটি মানবিক ঘটনা হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন প্রকল্পগুলো ভেঙে পড়ায় ইউরোপে সংঘাতের বর্বর পরিণতি মোকাবিলা করতে প্রথম মানবিক সংস্থাগুলো গঠন করা হয়েছিল। অনেকে সে সময় গ্লোবাল সাউথে জোরালো ভূমিকা পালন করতে শুরু করে, যেখানে তারা সক্রিয়ভাবে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যকে সমর্থন করেছিল।
এই সহায়তা শিল্প কার্যত ঔপনিবেশিক ‘সভ্যতা গড়ে তোলার মিশন’ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। অন্যের সম্পদ হস্তগত করার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে ভালোর মুখোশ পরিয়ে দেওয়া এবং বাস্তবে এই পদ্ধতির চ্যালেঞ্জ না করেই এর সবচেয়ে খারাপ দিকগুলো সাজিয়ে-গুছিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে। যদি কিছু ঘটে, তাহলে দুটির মধ্যে একটি জৈবিক সম্পর্ক রয়েছে। আন্তর্জাতিক তহবিল সহায়তা
নিষ্কাশনমূলক বৈশ্বিক বাণিজ্য ও শাসন ব্যবস্থার বৈধতা দেয়, যা ফলস্বরূপ এমন পরিণতি নিয়ে আসে, যা তহবিল সংস্থাগুলোর অস্তিত্বের বৈধতা নিশ্চিত করে।
ফলস্বরূপ, আজ তহবিল ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর বিস্তার সত্ত্বেও বর্ণবাদী বৈশ্বিক ব্যবস্থায় তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি এবং তা বিভিন্ন জাতির মধ্যে গভীর বৈষম্যভিত্তিক সম্পর্ক তুলে ধরে। ইউএস কংগ্রেসের বাজেট অফিসের ১৯৯৭ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বৈদেশিক সাহায্য সর্বোত্তমভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ও মানব কল্যাণের উন্নতিতে গৌণ ভূমিকা পালন করে। এমনকি ‘যে পরিবেশে সেই তহবিল ব্যবহার করা হয় এবং যে শর্তে এটি দেওয়া হয়, তার ওপর ভিত্তি করে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।’
পশ্চিমা সাহায্য তহবিল শূন্য হয়ে পড়া নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক হবে। বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল কিছু মানুষ কষ্ট পাবে এবং অনেকে মারাও যাবে। তবে বিশ্ব যেমন তেমনটাই আমাদের তুলে ধরা উচিত, আমরা যেমনটি চাই তেমনটি নয়।
এর ফলে এমন এক বিশ্ব সৃষ্টি হবে, যেখানে সাহায্যকে বিশ্বব্যাপী অন্যায়ের আবরণ হতে দেওয়া হবে না। আর তহবিলের অবসানকে ‘উন্নয়ন’-এর সমাপ্তি হিসেবেও দেখা উচিত। আমাদের এমন এক পদ্ধতি গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে, যা সত্যই একটি মানবতাবাদী ব্যবস্থাকে দৃশ্যমান করে তুলবে।
প্যাট্রিক গাথারা: দ্য নিউ হিউম্যানিটারিয়ানে অন্তর্ভুক্তিমূলক গল্প বলার সিনিয়র সম্পাদক
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে
সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।
এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।
এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।