নিজের পরিচিতি ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ভাঙচুর ও দখলের উদ্যোগ নেন ‘সমন্বয়ক’ পরিচয় দেওয়া মারইয়াম মুকাদ্দাস (মিষ্টি)। চার দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ এমনই তথ্য পেয়েছে। তবে তিনি কোনো সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা কি না, এখনো জানতে পারেনি পুলিশ।

চার দিনের রিমান্ড শেষে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে মারইয়াম মুকাদ্দাসকে টাঙ্গাইল সদর আমলি আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে আরও পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে শুনানি শেষে আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো.

গোলাম মাহবুব খাঁন তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। অন্যদিকে মারইয়ামের পক্ষে শুনানিতে অংশ নিয়ে আইনজীবীরা তাঁর জামিনের আবেদন করলে আদালত তা নামঞ্জুর করেন।

আরও পড়ুনকথায় কথায় হুমকি দিতেন মারইয়াম, ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে অংশ নিতেন প্রশাসনের সভায়১১ মার্চ ২০২৫

গত ৬ ফেব্রুয়ারি কয়েকজন অনুসারী নিয়ে খননযন্ত্র দিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় গুঁড়িয়ে দেন মারইয়াম মুকাদ্দাস। পরে জেলা আওয়ামী লীগের সদ্যপ্রয়াত সভাপতি ফজলুর রহমান খান, সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম ও সাবেক পৌর মেয়র জামিলুর রহমানের বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এ সময় বাড়িগুলোতে লুটপাট করা হয়। পর্যায়ক্রমে অন্য নেতাদের বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘোষণা দেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর দখল করে বৃদ্ধাশ্রম, পাগলের আশ্রম, এতিমখানা করা হবে বলে জানিয়েছিলেন মারইয়াম মুকাদ্দাস।

গত ৮ মার্চ শহরের আকুরটাকুর পাড়ায় জোয়াহেরুল ইসলামের বাড়ির তালা ভেঙে দখলে নেন মারইয়াম। সেখানে ১৮ জন মানসিক ভারসাম্যহীন নারী-পুরুষকে উঠিয়ে দিয়ে বাড়িতে ‘পাগলের আশ্রম’ চালুর ঘোষণা দেন। পরে রাতে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে বাড়িটি খালি করেন। পরে প্রশাসনের কাছে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান মারইয়াম। এ ঘটনায় ৯ মার্চ রাতে জোয়াহেরুল ইসলামের স্ত্রী বাদী হয়ে মারইয়ামের বিরুদ্ধে মামলা করলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।

আরও পড়ুনটাঙ্গাইলে সাবেক এমপির বাড়ি দখল করে ‘পাগলের আশ্রম’ চালু০৮ মার্চ ২০২৫

মারইয়াম মুকাদ্দাসকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, মারইয়াম টাঙ্গাইল শহরে একটি এনজিও করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাদের অসহযোগিতার কারণে তিনি তা ঠিকমতো চালাতে পারেননি। ২০২০ সালে এনজিওটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকেই ওই নেতাদের ওপর তাঁর ক্ষোভ তৈরি হয়। সেই ক্ষোভের কারণে নেতাদের বাড়িঘর ভাঙচুরে নেতৃত্ব দেন তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত অন্য নেতারা বাড়ি ভাঙচুর ও দখল করে দাতব্য প্রতিষ্ঠান করার পক্ষে ছিলেন না। মারইয়াম মুকাদ্দাস নিজের কয়েকজন অনুসারী নিয়ে ভাঙচুর ও দখলের উদ্যোগ নেন।

মারইয়াম মুকাদ্দাসের বাড়ি টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ফুলকী ইউনিয়নের যশিহাটী দোহার গ্রামে। ওই গ্রামের মাজহারুল ইসলামের মেয়ে তিনি। প্রতিবেশীরা জানান, মারইয়াম মুকাদ্দাস গ্রামে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। তারপর ঢাকায় চলে যায়।

আরও পড়ুনটাঙ্গাইলে সাবেক এমপির বাড়ি দখল করে ‘পাগলের আশ্রম’, গ্রেপ্তার মারইয়াম রিমান্ডে১০ মার্চ ২০২৫

পুলিশ জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানতে পেরেছেন, মারইয়াম ঢাকায় গিয়ে একটি ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেন। পরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাশন ডিজাইনে স্নাতকে ভর্তি হলেও শেষ করতে পারেননি। মারইয়াম বিভিন্ন সময় সৌদি আরব, দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারতের কাশ্মীরসহ একাধিক দেশ সফর করেছেন। টাঙ্গাইলে এনজিও করতে ব্যর্থ হয়ে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেন। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে ব্যাপক পরিচিতি পান। সেই পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর জেলা ও পুলিশ প্রশাসনেও গুরুত্ব পেতে শুরু করেন।

সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানবীর আহম্মদ বলেন, সাবেক সংসদ সদস্য জোয়াহেরুল ইসলামের বাড়ি দখল, চাঁদা দাবির উদ্দেশ্য, বিদেশ গমনের কারণসহ বিভিন্ন তথ্য জানতে তাঁকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে আবার রিমান্ড চাওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুনটাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় গুঁড়িয়ে দিলেন ছাত্র-জনতা, নেতাদের বাড়িতে হামলা০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম রইয় ম ম ক দ দ স জ য় হ র ল ইসল ম হ র ল ইসল ম র ন ম রইয় ম আওয় ম আরও প

এছাড়াও পড়ুন:

নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে যাক

লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকটি নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, তার অবসান হবে আশা করা যায়। নির্বাচনের দিনক্ষণের বিষয়ে দুই পক্ষই নীতিগতভাবে একমত হয়েছে যে ২০২৬ সালের রোজার আগে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। 

সাম্প্রতিক কালে নানা বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপি নেতৃত্বের বিরোধ লক্ষ করা যাচ্ছিল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে বিএনপি–দলীয় প্রার্থী ইশরাক হোসেনের শপথ ইস্যু সেই বিরোধকে আরও বাড়িয়ে দেয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সর্বশেষ বৈঠকে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি ও আকাঙ্ক্ষা পুনর্ব্যক্ত করে।

কিন্তু ঈদুল আজহার আগের রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার ব্যাপারে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়। এর আগে বিএনপির নেতৃত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ এনে তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে। 

এমনই একটি পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফরের সময় লন্ডনে তাঁর সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বৈঠকের ঘোষিত যৌথ বিবৃতিতে নির্বাচনের দিনক্ষণের বিষয়টি সামনে এলেও দুই পক্ষের আলোচনা কেবল এর মধ্যে সীমিত ছিল না। প্রধান উপদেষ্টার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান ও সংস্কারের ধারাবাহিকতার ওপরও জোর দেন তঁারা। 

বৈঠকের ফলাফলকে প্রায় সব দলই স্বাগত জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি ঘোষণার ধরন নিয়ে আপত্তি জানালেও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সরাসরি বিরোধিতা কেউ করেনি। আমরাও মনে করি, কোনো বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমেই তা সমাধান করতে হবে।

জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ যারা সংস্কার ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে, সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। লন্ডন বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার ও বিচারকাজ দৃশ্যমান করার ওপর জোর দিয়েছেন। ভবিষ্যতে যাতে দেশে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনরাগমন না ঘটে, সে জন্য রাষ্ট্র সংস্কারের কাজটি ত্বরান্বিত করা জরুরি। আবার অপরাধ করে যাতে কেউ পার না পায়, সে জন্য জুলাই-আগস্টের হত্যার বিচারও অপরিহার্য। কিন্তু এই দুটি বিষয়কে কোনোভাবে নির্বাচনের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা সমীচীন হবে না।

যেসব সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে নির্বাচন ও সংবিধানের বিষয়টি জড়িত নয়, সেগুলো সরকার নির্বাহী আদেশেও বাস্তবায়ন করা যায়। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তেমন বাধা আসার কথা নয়। তবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার অর্থ এই নয় যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এখন নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করাই বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক দলগুলোর সার্বিক সহযোগিতা না থাকলে সরকার একা কাজটি করতে পারবে না। 

ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তর্দলীয় ও আন্তদলীয় সংঘাতের যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা উদ্বেগজনক। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে না চললে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না। আমরা আশা করি, দিন-তারিখের বিষয়ে সমঝোতার পর নির্বাচনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন। রাজনীতিতে মত ও পথের পার্থক্য থাকবে; তাই বলে একে অপরকে ‘শত্রুজ্ঞান’ করার পুরোনো সংস্কৃতি থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ