ভুয়া হিন্দু রাষ্ট্রের আড়ালে বলিভিয়ায় পলাতক ভারতীয় সাধু নিত্যানন্দের জমি দখলের চেষ্টা
Published: 5th, April 2025 GMT
নিজস্ব পাসপোর্ট, সংবিধান আছে তাঁদের। তাঁদের দাবি, তাঁরা সোনা দিয়ে নিজস্ব মুদ্রা তৈরি করেন, একটি রিজার্ভ ব্যাংকের মাধ্যমে তাঁরা সেগুলো বিলি-ব্যবস্থা করেন। তাঁদের রয়েছে ‘মহাজাগতিক সংবিধান’। সর্বোপরি তাঁরা নিজেদের ‘বিশ্বের প্রথম সার্বভৌম হিন্দু রাষ্ট্রের’ দূত দাবি করেন।
অস্তিত্বহীন এই রাষ্ট্রের প্রতিনিধি জাতিসংঘে বক্তৃতা দিয়েছেন, বিশ্বনেতাদের সঙ্গে ছবি তুলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের সঙ্গেও তাঁদের ছবি আছে। তাঁদের নেতা ভারতীয় এক পলাতক সাধু।
ওই সাধু দাবি করেন, পুনর্জন্মের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তিনি। ধনকুবেররা তাঁর কাছে গেলে এবং তাঁর কাছ থেকে পরিষেবা নিলে পরজন্মেও তাঁরা ধনী থাকবেন, এমনকি গরিব হয়ে জন্ম নিলেও।
তাঁরা তাঁদের এই কল্পিত রাষ্ট্রের নাম দিয়েছেন ‘ইউনাইটেড স্টেট অব কৈলাসা’। তবে তাঁদের কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে কোনো মিল নেই। সেটাই এখন তাঁদের বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
গত সপ্তাহে বলিভিয়ার কর্মকর্তারা বলেছেন, কৈলাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২০ জনকে তাঁরা গ্রেপ্তার করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ভূমি দখলের অভিযোগ আনা হয়েছে। তাঁরা আদিবাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে এক হাজার বছরের জন্য আমাজন অঞ্চলের বিশাল এলাকা ইজারা নিয়েছেন।
বলিভিয়া সরকার ওই চুক্তিগুলো বাতিল করেছে এবং ওই সব ব্যক্তিকে বিতাড়ন করেছে। না, তাঁদের তাঁদের কল্পিত রাষ্ট্র কৈলাসে পাঠানো হয়নি। বরং তাঁরা বাস্তবে যেসব দেশের নাগরিক, তাঁদের সেসব দেশেই ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাঁরা মূলত ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন ও চীনের নাগরিক।
বলিভিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বলিভিয়া নিজেদের রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করা “ইউনাইটেড স্টেটস অব কৈলাসা”-এর সঙ্গে কোনো ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে না।’
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে এ বিষয়ে কথা বলতে কৈলাসার ‘প্রেস অফিস অব দ্য হলি সি অব হিন্দুইজম’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল, কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি।
উদ্ভট এই কাহিনির সূত্র খুঁজতে হলে আপনাকে যেতে হবে ২০১৯ সালে। সে বছর ধর্ষণ, নির্যাতন ও শিশুদের নিপীড়নের অভিযোগে অভিযুক্ত এক ভারতীয় হিন্দু ধর্মগুরু দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তিনি স্বামী নিত্যানন্দ নামে পরিচিত ছিলেন।
নিত্যানন্দের জন্ম ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় অরুণাচলম রাজশেখরন। একসময় তিনি হিন্দু সাধু হন এবং বয়স যখন কুড়ির কোটায়, তখন বেঙ্গালুরুর কাছে নিজের প্রথম আশ্রম গড়ে তোলেন। দ্রুতই তিনি পুরো ভারত ও ভারতের বাইরের শহরগুলোতেও নিজের রাজত্ব গড়ে তোলেন।
সে সময় তিনি অদ্ভুত সব দাবি করতেন। যেমন তিনি অন্ধকে ‘তৃতীয় চোখ’ দিয়ে দেখতে সহায়তা করতে পারেন অথবা সূর্যোদয় ৪০ মিনিট বিলম্ব করাতে পারেন।
একসময় এই সাধুর বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ জমতে শুরু করে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে ভারত সরকার তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। তখন তিনি দাবি করেছিলেন, এসব হিন্দুবিরোধীদের কারসাজি। তাঁর জমি দখলের জন্য এসব করা হচ্ছে।
ভারত থেকে পালিয়ে নিত্যানন্দ প্রথম কোথায় যান, তা স্পষ্ট নয়। তবে জানা যায়, তিনি দক্ষিণ আমেরিকা অথবা ক্যারিবীয় অঞ্চলে গেছেন।
বেশ কয়েক বছর পর দেখা মেলে নিত্যানন্দের। তিনি ঘোষণা করেন, ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব কৈলাসা’ নামে একটি দেশ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেটি আসলে অতীত হিন্দু রাজ্যের পুনর্জন্ম।
তাঁরা একটি ওয়েবসাইট বানান। যেখানে মাত্র কয়েক ক্লিকের মাধ্যমে বিনা মূল্যে পাওয়া যায় কৈলাসার ই-সিটিজেনশিপ বা ডিজিটাল নাগরিকত্ব। এভাবেই চলছিল কৈলাসার কার্যক্রম।
২০২৩ সালে প্যারাগুয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কৈলাসার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করার পর পদত্যাগ করেন। ওই বছরের শুরু দিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির নিউয়ার্কের মেয়র রাস বারাক কৈলাসার সঙ্গে ‘সিস্টার সিটিস’ চুক্তি বাতিল করেন। কয়েক দিন আগেই তিনি ওই চুক্তি করেছিলেন।
এমন আরও কয়েকটি বিতর্কের সঙ্গে কৈলাসার নাম উঠে আসে।
তাঁদের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি ফাঁস করে বলিভিয়ার একটি পত্রিকা। তাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, কৈলাসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আমাজনের আদিবাসীদের সঙ্গে জমি ইজারার চুক্তি করেছে।
যেসব আদিবাসী গোষ্ঠী কৈলাসার সঙ্গে জমি ইজারার চুক্তি করেছিল, তাদের একটি ‘বাউয়া’। বাউয়া নেতাদের একজন পেদ্রো গুয়াসিকো। তিনি বলেন, কৈলাসার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে তাঁদের চুক্তির কাজ শুরু হয় গত বছরের শেষ দিকে। বনে দাবানলের পর তাঁরা সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল।
গুয়াসিকো আরও বলেন, আলোচনার একপর্যায়ে কৈলাসা প্রতিনিধিরা জমি ইজারা নেওয়ার প্রস্তাব দেন। তাঁরা বাউয়া আদিবাসীদের কাছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির তিন গুণ আয়তনের জমি ২৫ বছরের জন্য ইজারা নেওয়ার প্রস্তাব দেন। এ জন্য প্রতিবছর তাঁরা প্রায় দুই লাখ মার্কিন ডলার দেবে।
প্রাথমিক আলোচনার পর কৈলাসার প্রতিনিধিরা ইংরেজিতে লেখা চুক্তির খসড়া নিয়ে হাজির হন। ওই চুক্তিতে জমি ২৫ নয়, বরং ১ হাজার বছরের জন্য ইজারা নেওয়ার কথা বলা ছিল। সেই সঙ্গে আকাশসীমাও ব্যবহার করা হবে, আর তুলে নেওয়া হবে প্রাকৃতিক সম্পদ।
তাঁরা না বুঝেই চুক্তি সই করে ফেলেছেন বলে দাবি করেন গুয়াসিকো। ফোনে তিনি বলেন, ‘তাঁদের কথা শুনে আমরা ভুল করেছি। তাঁরা আমাদের অঞ্চল সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য বার্ষিক বোনাস হিসেবে এই অর্থের প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র প রস ত ব ন ত য নন দ বল ভ য় র জন য বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
প্রযুক্তি কি ডিমেনশিয়া বাড়িয়ে দিচ্ছে? ৫৭টি ভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে বিস্ময়কর তথ্য
প্রযুক্তির কল্যাণে হুটহাট বড় পরিবর্তন আসা নতুন কিছু নয়। করোনা মহামারির আগে বাসা থেকেও যে অফিস করা সম্ভব, সেটা মানতে চাইতেন না অনেকে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হোম অফিস হয়েছে স্বাভাবিক। একই ঘটনা ঘটেছে ডিজিটাল দুনিয়ায়। একসময় যেকোনো তথ্য খুঁজে বের করার জন্য শরণাপন্ন হতে হতো সার্চ ইঞ্জিনের; এআই সেই উত্তর সবিস্তারে দিয়ে দিচ্ছে মুহূর্তেই। ফলে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন শুধু জীবনকে সহজতর করছে না, বাঁচিয়ে দিচ্ছে সময় ও পরিশ্রমও। কিন্তু এই বেঁচে যাওয়া সময় ও পরিশ্রম মস্তিষ্কের ওপর ঠিক কীভাবে প্রভাব ফেলছে?
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস ও বেলোর ইউনিভার্সিটির এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, এত দিন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে মানব মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমার যে গুঞ্জন ভেসে বেড়িয়েছে, তার কোনো সত্যতা নেই। ‘নেচার হিউম্যান বিহেভিয়ার’ জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, ‘ডিজিটাল ডিমেনশিয়া’ নামে যে হাইপোথিসিস আছে, তার কোনো প্রমাণ নেই গবেষকদের কাছে। বরং পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষদের স্মার্টফোন, কম্পিউটার কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহার তাঁদের স্বাভাবিক স্মৃতিভ্রম অনেকটা স্তিমিত করে।
ডিজিটাল ডিমেনশিয়া কী২০১২ সালে প্রথম ‘ডিজিটাল ডিমেনশিয়া’ তত্ত্ব নিয়ে হাজির হন জার্মান স্নায়ুবিজ্ঞানী ও মনোবিদ ম্যানফ্রেড স্পিৎজার। মূলত যে হারে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে এবং মানুষ যান্ত্রিক পর্দার সামনে প্রতিদিনের বেশির ভাগ সময় কাটাচ্ছে, তাতে প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে অনেকটাই। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় তথ্যগুলোও মনে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে অনেকে। যেমন ফোন নম্বর। একসময় প্রিয়জনের ফোন নম্বর আমাদের মুখস্থ থাকত। এখন ফোন নম্বর ঠাঁই পায় মুঠোফোনের কনটাক্ট লিস্টে। ফোন নম্বর মনে রাখার চেষ্টাই করে না কেউ। আবার অনেকক্ষণ যান্ত্রিক পর্দার সামনে থাকলেও সেখান থেকে শেখার ইচ্ছা থাকে না অনেকের। চোখের সামনে যা আসছে, স্ক্রল করে চলে যাচ্ছে পরের কোনো কনটেন্টে। এতে মনোযোগ হারিয়ে যায় দ্রুত। আর প্রযুক্তির এমন অতিব্যবহার যে স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দিচ্ছে, একেই ধরা হয় ‘ডিজিটাল ডিমেনশিয়া’ হিসেবে।
আরও পড়ুনডিজিটাল স্ক্রিন ব্যবহারের সময় ২০-২০-২০ নিয়ম মানাটা কেন জরুরি২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩গবেষণা যা বলছেপ্রায় ৪ লাখ ১১ হাজার পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের ওপর চালানো ৫৭টি ভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যে স্মৃতিভ্রম দেখা দেয়, তার অনেকটাই হ্রাস করে প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের ফলে স্মৃতিশক্তি কমে আসার আশঙ্কা প্রায় ৫৮ শতাংশে নেমে আসে।
স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া বরং আরও কিছু সূচকের (যেমন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক অবস্থা) ওপর নির্ভর করে। মজার ব্যাপার হলো, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার থেকেও বেশি কার্যকর প্রযুক্তির ব্যবহার।
তবে এর সবকিছুই নির্ভর করছে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের ওপর। পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরা বেশির ভাগ সময়ই অনলাইনে কাটান ইউটিউব ভিডিও অথবা ফেসবুক স্ক্রল করে। এতে তাঁদের মস্তিষ্কের ব্যবহার হয় না বললেই চলে। মস্তিষ্ক সচল রাখতে পারে এমন কনটেন্টে তাঁদের মনোযোগ সরিয়ে নিতে পারলে আনন্দ যেমন পাবেন, তেমনই ডিজিটাল দুনিয়া সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিও পালটে যাবে। এ ছাড়া অনলাইনের হাজারো গুজব ও উসকানি থেকে মুক্ত থাকবেন তাঁরা।
সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট
আরও পড়ুনমাত্রাতিরিক্ত স্ক্রিনটাইম যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩