বিয়ার গ্রিলস। দুঃসাহসী অভিযাত্রী। টিভি সিরিজ ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’-এর জন্য বিখ্যাত। তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে অনুপ্রেরণামূলক কথা তুলে এনেছেন মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ

স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস আমার ভেতরে জাগতিক ভয়-ডরকে কমিয়ে দিয়েছে। লোকজন বলে, গ্রিলস নাকি কোনোকিছুতেই ভয় করে না। আসলে আমার অনেক কিছুতেই ভয়। মিলিটারি প্রশিক্ষণের সময় আমি স্কাই-
ডাইভিংয়ের দুর্ঘটনায় পড়ি। ডাক্তার তো ধরে নিয়েছিলেন, সারা জীবনের জন্য আমি 
পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে থাকব। তারপর থেকে এখনও প্যারাস্যুট দেখলে আমার ভয় লাগে!  এই মহাজগতে আমি একা লড়ছি না– এ বোধটি আমাকে সাহস জোগায়। নিজের ওপর রাখা আস্থায় আমাকে ঘরের বাইরে উন্মুক্ত পরিবেশে টেনে নিয়ে যায়। ফলে পাহাড়-পর্বত কিংবা জঙ্গল– যেখানে যাই, কোনো না কোনো 
অলৌকিকতার মুখোমুখি হই। যেহেতু প্রতিটি অভিযাত্রা শেষে রয়েছে বাড়ি ফেরার সম্ভাবনা। ফলে মৃত্যুর ভয়ও তেমন কাজ করে না আমার।
 
বাবার অনুপ্রেরণা
কিশোর বয়সে নিজেকে নিজে বলেছি, এমনভাবে এগিয়ে চলো, যেন তোমার বাবা স্বয়ং রয়েছেন তোমার পাশে। আমার বয়স বিশে পৌঁছানোর আগে বাবা মারা যান। অসাধারণ এক বাবা ছিলেন তিনি। ভীষণ মিশুক ও ফূর্তিবাজ। মূলত তিনি আমাকে অল্প বয়সে ক্লাইম্বিং করতে শিখিয়েছেন। বাবা বলতেন, গ্রিলস, তুমি বন্ধুদের দিকে তাকাও আর মনের সাড়ায় এগিয়ে চলো। কখনও কোনোকিছু দেখে ভড়কে যেও না।

নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস
স্কুলের পাঠ শেষে আর্মিতে যখন যোগ দিই তখন আমার বন্ধুরা সবাই অফিসার হিসেবে যোগ দিলেও আমি যোগ দিই একজন প্রাইভেট হিসেবে। কেননা নিজের মতো করে একটি পথ খুঁজে নেওয়ার আত্মবিশ্বাস ছিল আমার। নিজের কিশোর বয়সে যখন ফিরে তাকাই, দেখি এক লাজুক বিয়ার গ্রিলসকে, যে কিনা আত্মপরিচয় খুঁজে পেতে মরিয়া। ট্রেন্ডি পোশাক পরতে আর চুলে স্পাইক করতে ভালো লাগত তখন। যদি পারতাম তবে সেই কিশোরকে বলতাম, শোনো, এত পরিপাটি থাকার কোনো মানে নেই। তোমাকে মানায় না এসব। কোনো কিছু ভালো না লাগলে মন খারাপ করার কিছু নেই; বরং যা করতে ভালো লাগে করে যাও, আর মুখে রাখো হাসি। ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার সুযোগ না পেলে মন খারাপ করো না। কেননা একাডেমিক পড়াশোনা জীবনের খুবই ছোট্ট একটা অংশ। বাবা বলতেন, স্কুলে সেরা হওয়ার চেষ্টা করো না; এতে বাকি জীবন দুঃসহ হয়ে উঠবে!

পরিবার ও অনুপ্রেরণা
তরুণ বয়সে টিভি-পার্সোনালিটি হয়ে ওঠার বিষয়ে আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। টিভি কোনোদিন আমার রাডারে ধরা পড়েনি। খ্যাতি কোনোদিন আমার লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠতে পারেনি। কেউ যদি বলে, তুমি তো টিভির লোক; আমি বলি, ‘ওহ, তাই নাকি? খুব হাস্যকর না?’ আরকেটা কথা। নিজের একটি পারিবারিক ছবি সব সময়ই জুতার মধ্যে বয়ে চলি আমি। অনেকের কাছে এটি হাস্যকর মনে হলেও আমার কাছে বড্ড অনুপ্রেরণার। ছবির পাশাপাশি সব সময় সঙ্গে রাখি স্যাটেলাইট ফোন। প্রতি রাতে, ছবিতে দেখা সন্তানদের ‘শুভরাত্রি’ বলে ঘুমোতে যাই। সময় পেলে বই পড়তে বসি। জীবনী গ্রন্থগুলো আমাকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়।  মাদার তেরেসাও আমাকে প্রেরণা জোগায়।

ভালো লাগতো না পড়াশোনা; তবে.

..
কলেজের পড়াশোনা ভালো লাগত না আমার। বিশেষ করে, বাড়ি থেকে দূরে থাকতে হতো বলে। তাই ১৬ বছর বয়সে পর্বতারোহণ ও মার্শাল আর্টের প্রতি ঝুঁকে পড়ি। কারাতে খেলার দিনগুলোতে এমন একদল বন্ধু পাশে পেয়েছিলাম, যারা শক্তি ও সামর্থ্যে আমার চেয়ে এগিয়ে ছিল। দিন দিন তারা সবাই সরে গেলেও রয়ে গেলাম আমি। প্রতিকূল আবহাওয়া ও ঝড়ের ভেতর পাহাড়ে চড়ার লড়াইটা বেশ জমাতে পারি আমি। এটি আমার জন্য 
অনেক গর্বের! 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র বয়স

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ