নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের ‘বিতর্কিত সুপারিশ’ বাদ দেওয়ার আহ্বান এবি পার্টির।
Published: 21st, April 2025 GMT
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনকে একপেশে ও বিতর্কিত উল্লেখ করে এবি পার্টি বলেছে, এই কমিশনে বহুমাত্রিক নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব ছিল না। প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নের আগে তা জনসমক্ষে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা দরকার। এ ছাড়া সুপারিশগুলো নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা, সমালোচনা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনেরও সুযোগ রাখতে হবে।
আজ সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক যৌথ বিবৃতিতে এসব কথা বলেন এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান (মঞ্জু) ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ। তাঁরা সংস্কার প্রস্তাবের বিতর্কিত দিক ও সুপারিশগুলো বাদ দিয়ে প্রতিবেদনটি পরিমার্জনের আহ্বান জানিয়েছেন।
১৯ এপ্রিল ‘সর্ব ক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলুপ্তি এবং নারী–পুরুষের সমতা অর্জনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ চিহ্নিতকরণ’ শিরোনামে প্রতিবেদন জমা দেয় নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। এতে ১৫টি বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব এবং ৪৩৩টি সুপারিশ করা হয়।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না দাবি করে এবি পার্টির বিবৃতিতে বলা হয়, এতে কেবল বিশেষ চিন্তা ও দর্শনের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিয়ে-তালাক, উত্তরাধিকারে সমান অধিকার, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা, যৌনপেশাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করা, শ্রম আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করাসহ বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়গুলো বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিবেচনায় খুবই সংবেদনশীল।
এবি পার্টির বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে নারী অধিকারের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মানুষের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বিশ্বাসকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর প্রবণতা দেখা গেছে। এই প্রবণতা জাতীয় উন্নয়ন ও সংহতির জন্য হুমকি।
এ ছাড়া জাতীয় সংসদকে ৬০০ আসনে উন্নীত করা ও নারীদের জন্য ৩০০ আসন সংরক্ষিত করে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাবকে বিপ্লবী প্রস্তাবনা বলে মনে করে এবি পার্টি। বিবৃতিতে এবি পার্টির চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদক বলেন, সংস্কার কমিশন ১০০ নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পর্যায়ক্রমে নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে অগ্রসর হওয়া যায়।
আরও পড়ুননারীর জন্য ৩০০ সংরক্ষিত আসন, বিয়ে-তালাক, উত্তরাধিকারে সমান অধিকার দেওয়ার সুপারিশ ১৯ এপ্রিল ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র প রস ত ব
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতিবেশী দেশগুলো অস্থির, ভারত এখন কী করবে
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অস্থিতিশীলতা নতুন কিছু নয়। তবে এখন যে অস্থিরতা এ অঞ্চলে চলছে তা ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি ভারতকে আগের চেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
সাম্প্রতিক নেপালের সহিংস অস্থিরতা তারই উদাহরণ। শুধু নেপালের ঘটনা নয়। ভারতের পূর্বদিকে বাংলাদেশে ২০২৪ সালে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল এবং তার জের ধরে সেখানে সরকার পতন হয়েছিল; সেই সংকটের মীমাংসা এখনও হয়নি।
অন্যদিকে ভারতের দক্ষিণ-পূর্বে থাইল্যান্ড নতুন করে অশান্ত হয়ে উঠেছে। কারণ সেখানে আদালতের রায়ে প্রধানমন্ত্রীকে পদচ্যুত করা হয়েছে ও সম্প্রতি কম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্তে তাদের একাধিক সংঘর্ষ হয়েছে।
আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রকল্পের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে অন্তত ৮০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ নাগরিকের পাশাপাশি যোদ্ধারাও আছেন।
আরও পড়ুনভারত ও চীনের টানাটানিতে পড়েছে নেপাল৩১ জুলাই ২০২০ভারতের পশ্চিমে পাকিস্তান এখনও অতীতের ‘ভূতদের’ সঙ্গে লড়াই করছে। উগ্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠী, দুর্বল অর্থনীতি আর অকার্যকর শাসনব্যবস্থা পাকিস্তানকে অস্থির করে রেখেছে। ভারতের দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা তিন বছর আগে প্রেসিডেন্টকে সরানোর পর আপাত শান্ত হয়েছে। কিন্তু দেশটির অর্থনীতি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। আর উত্তরে চীনের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টাও এই অস্থিরতার বড় কারণ হয়ে আছে।
ভারতের জন্য এসব সংকট মোটেও দূরের কোনো ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ ইতিমধ্যেই পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে অস্বস্তি তৈরি করছে। পাকিস্তানের সীমান্তপারের সন্ত্রাসের হুমকি এ গ্রীষ্মে কাশ্মীরে প্রায় যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলেছিল। আর এখন নেপালের অস্থির রাজনীতি চীনের জন্য নতুন করে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিয়েছে। এত বড় এক অস্থিরতার বলয়কে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
এখন কীভাবে এই ধাক্কাগুলো সামলানো যায় এবং কীভাবে গোটা অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনা যায়, সেটিই ভারতের নেতৃত্বের সামনে মূল প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
সাদা চোখে থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর কম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষকে ততটা গুরুতর মনে নাও হতে পারে। কিন্তু ভারত তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির অধীনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত ১০ দেশ ও তাদের ৬০ কোটিরও বেশি মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক গড়ছে।নেপাল দিয়েই শুরু করা যাক। দেশটি দুই দশক আগে দীর্ঘ মাওবাদী বিদ্রোহের অবসান ঘটাতে যে উচ্চাভিলাষী সংবিধান প্রণয়ন করেছিল, তা টিকিয়ে রাখতেই তারা হিমশিম খাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল, বিতর্কিত ও ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। পক্ষপাত, দুর্নীতি আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে স্থিতিশীলতার আশা বারবার ভেঙে পড়েছে। সম্প্রতি যেসব ভয়াবহ সহিংসতা ঘটেছে, তা আসলে এই গভীর অস্থিরতার লক্ষণ।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আছে, তারা আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে বা মানবাধিকারের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। যে অর্থনীতি কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প ছিল, দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কড়া শুল্কনীতির কারণে সেটিও এখন টালমাটাল।
আরও পড়ুনভারত ‘তুমি রিয়েলিটি মাইন্যে ন্যাও’০৪ ডিসেম্বর ২০২৪সাদা চোখে থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর কম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষকে ততটা গুরুতর মনে নাও হতে পারে। কিন্তু ভারত তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির অধীনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত ১০ দেশ ও তাদের ৬০ কোটিরও বেশি মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক গড়ছে।
এই অঞ্চলের যে কোনো অশান্তি সেই প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলবে। তাছাড়া থাইল্যান্ড বহুদিন ধরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করেছে। যদি এর প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয় কিংবা বা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের শান্তি-প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কম্বোডিয়ার সঙ্গে থাইল্যান্ডের বিরোধ আরও বেড়ে যায়, তাহলে ভারতের ইন্দো-প্যাসিফিক করিডরের স্বপ্নই ভেঙে পড়তে পারে।
পাকিস্তানকে ‘চিরকালীন সংকটে থাকা দেশ’ বলা হয়তো কঠিন শোনায়, কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটিই বাস্তবতা। সেখানে বারবার বেসামরিক সরকারকে দুর্বল করা হয়েছে। যেমন, ২০২২ সালে ইমরান খানের নির্বাচিত সরকার সেনাবাহিনীর ইশারায় ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। রাজনীতি রক্তক্ষয়ী খেলায় পরিণত হলে চরমপন্থীরা মাথা তোলে, আর নাজুক অর্থনীতি সেই প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানে সেটিই দেখা গেছে।
আরও পড়ুননেপালের গণ–অভ্যুত্থান ভারতের মাথাব্যথা বাড়াল১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ভারতের দৃষ্টিতে পাকিস্তানের এই সংকট শুধু অভ্যন্তরীণ নয়। এগুলো প্রায়ই কাশ্মীর সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাস ছড়ায়, আঞ্চলিক শান্তির সম্ভাবনা নষ্ট করে, এমনকি পারমাণবিক সংঘাতের শঙ্কাও তৈরি করে। ভারত যখন বাইরের দিকে তাকাতে চায়, এই স্থায়ী অস্থিতিশীলতা তখন ভারতকে উপমহাদেশের দাবার ছকে আটকে রাখে। এর সঙ্গে পাকিস্তান-চীন জোট মিলে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। এটি নিকট ভবিষ্যতে বদলানোর সম্ভাবনা কম।
এসব ঘটনা মিলিয়ে যে বড় প্রবণতা স্পষ্ট হচ্ছে, তা হলো: ভারতের চারপাশে গণতন্ত্র পিছিয়ে পড়েছে। প্রতিবেশি দেশগুলোতে সংবিধান বারবার বদলানো হচ্ছে এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আদালতকে ব্যবহার হচ্ছে। দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক সেনাপ্রধান রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছেন। রাজনৈতিক নেতাদের কখনো কারাগারে পাঠানো হচ্ছে, কখনো নির্বাসনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র হিসেবে ভারতের জন্য এ প্রবণতা মোকাবিলা করা জরুরি। আর এখন আরও দৃঢ় আঞ্চলিক কৌশল ছাড়া উপায় নেই। বাস্তবে পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে সংকট দেখা দিলে ভারতই প্রথম ভরসা। তবে যখন কোনো দেশ মনে করে তাদের ভারতের সাহায্য দরকার নেই, তখন তারা ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগকেও গুরুত্ব দেয় না।
আরও পড়ুননেপালের অভ্যুত্থান নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া যেভাবে মিথ্যা বয়ান হাজির করছে১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ভারতের চারপাশের অশান্ত পরিস্থিতিই যথেষ্ট কঠিন। তার ওপর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট আরও অনিশ্চয়তা যোগ করছে। ট্রাম্পের দক্ষিণ এশিয়া নীতি এতটাই খামখেয়ালি যে, ছোট দেশগুলো এখন নিরাপদ থাকতে বিকল্প পথ খুঁজছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় পর্যন্ত প্রশ্ন উঠছে—চীন যখন শক্তি প্রদর্শন করছে আর মার্কিন নিরাপত্তার ছাতার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে, তখন কি তাদের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে হাঁটা উচিত না?
ভারত যদিও এ ঝড়ের মুখে দৃঢ় থেকেছে, তবুও আঞ্চলিক টানাপোড়েন আর ট্রাম্পসৃষ্ট অস্থিরতা ভারতের বহুদিনের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ধরে রাখাকে কঠিন করে তুলছে। এখন ভারতের কাজ শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করা নয়, বরং সম্পর্কের কৌশলগত, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক মূল ভিত্তি ধরে রাখা। পাশাপাশি আচমকা মার্কিন নীতি পরিবর্তনের ধাক্কা সামলানোর প্রস্তুতি নেওয়াও দরকার।
ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য চায় না। তার লক্ষ্য হলো এমন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, নীতিনির্ভর ও সংযুক্ত অঞ্চল গড়ে তোলা যেখানে অতীতের বারবারের সংকট সরে যাবে এবং সে জায়গায় ভবিষ্যতের দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
নিরুপমা রাও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত
সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ