বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে পারস্পরিক নির্ভরতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে উভয় দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা ও অভিন্ন সীমান্ত এই অংশীদারিকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। সম্প্রতি উভয় পক্ষের কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। বিশেষত অশুল্ক বাধা আরোপের ফলে যে নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে, তা কেবল ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, বরং আস্থার পরিবেশ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে ফেলছে।

ভারতের পক্ষ থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের কিছু ভোগ্যপণ্য যেমন ফলের রস, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, প্লাস্টিক সামগ্রী ও তৈরি পোশাক প্রবেশে হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশও ভারতীয় সুতা আমদানিতে নির্দিষ্ট স্থলবন্দর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে সরাসরি শুল্ক বাড়ানো না হলেও কার্যত আমদানি-রপ্তানির বাস্তব পথ সংকুচিত করা হয়েছে। ফলে ব্যবসা পরিচালনায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহারের ঘটনা এই চাপ আরও বৃদ্ধি করেছে।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ভারতের মূল ভূখণ্ডসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশের জন্য লাভজনক বাজার। সেখানে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, খাদ্যপণ্য, প্লাস্টিক সামগ্রী ইত্যাদির চাহিদা রয়েছে এবং এ চাহিদা মেটাতে স্থলপথে পণ্য প্রবেশ দীর্ঘদিন ধরে স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। হঠাৎ করে এই প্রবেশাধিকার সীমিত হলে শুধু ব্যবসায়িক ব্যয় বাড়বে তা নয়, বরং ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সীমান্তবর্তী ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা, যাঁরা সরাসরি এই বাজারের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের মতো পণ্য, যা বাংলাদেশের রপ্তানির অন্যতম প্রধান খাত, তা যদি দূরবর্তী সমুদ্রবন্দর যেমন কলকাতা বা নব সেবা বন্দরনির্ভর হয়ে পড়ে, তাহলে পরিবহন খরচ, সময় ও প্রতিযোগিতার দিক থেকে পিছিয়ে পড়বে।

এদিকে বাংলাদেশও ভারত থেকে আমদানি করা সুতার ওপর নির্ভরশীল; এটি দেশের বস্ত্র ও পোশাক খাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল। এই আমদানিতে কোনো বাধা সৃষ্টিও অভ্যন্তরীণ শিল্প খাতের ব্যয় বৃদ্ধি ও উৎপাদন ব্যাহত করে। কাজেই এ ধরনের একতরফা এবং হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরস্পর নির্ভরশীল দুই দেশের শিল্প খাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘদিনের পারস্পরিক আস্থা ক্ষুণ্ন করে।

প্রতিটি দেশ তার অর্থনৈতিক সীমান্ত ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে সার্বভৌম, তারপরও নীতিনির্ধারণে স্থিতিশীলতা, আগাম অবহিতকরণ ও যৌক্তিক সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। হঠাৎ করে আরোপিত নীতিগত প্রতিবন্ধকতা শুধু ব্যবসায়ীদের জন্যই অনিশ্চয়তা তৈরি করে না, বরং আঞ্চলিক বাণিজ্য ব্যবস্থায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে যে সরবরাহ শৃঙ্খলা দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে উঠেছিল, তা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককেও অবিশ্বাস ও সংশয়ের পথে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি থাকে।

এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সমস্যাগুলোর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এসব সংকট পারস্পরিক প্রতিযোগিতা বা ‘শাস্তিমূলক প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে না দেখে বরং সহযোগিতার ভিত্তিতে সমাধানের পথ খুঁজে বের করাই সময়োপযোগী পদক্ষেপ। দুই দেশই আঞ্চলিক সংহতি, আন্তসীমান্ত বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির পক্ষে। তাই অশুল্ক বাধার মতো পদক্ষেপগুলোর প্রভাব নিরীক্ষা করে দ্রুত পুনর্বিবেচনার উদ্যোগ নিতে হবে।

ভবিষ্যতে এমন সংকট এড়াতে উভয় দেশের সরকার, নীতিনির্ধারক, বাণিজ্য সংগঠন ও বেসরকারি খাতের মধ্যে গঠনমূলক সংলাপ জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সহজ বাণিজ্য কাঠামো গড়ে তোলা দরকার, যেখানে অপ্রত্যাশিত নীতিগত বাধা কমে আসবে এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও মজবুত হবে।

সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ-ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক শুধু দুই দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থেই নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর সংহতি, স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পর্ক যেন অশুল্ক বাধা, সমন্বয়হীনতা কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল নীতির কবলে পড়ে দুর্বল না হয়ে পড়ে, সেদিকে সচেতন ও দায়িত্বশীল দৃষ্টি দেওয়া সময়ের দাবি। আলোচনার মাধ্যমে ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়াই এই অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধির সঠিক পথ।

সেলিম রায়হান: নির্বাহী পরিচালক, সানেম

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য ব যবস আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

স্থলপথে বাংলাদেশি কিছু পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করল ভারত

স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের তৈরি পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করেছে ভারত। শুধু ভারতের নবসেবা ও কলকাতা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে দেশটির আমদানিকারকেরা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারবেন।

পাশাপাশি ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন (এলসিএস)/ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট (আইসিপি) দিয়ে ফল এবং ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য ইত্যাদি রপ্তানি করা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্ধা ও ফুলবাড়ী শুল্কস্টেশনের জন্যও এটি প্রযোজ্য হবে।

আজ শনিবার ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে এ তথ্য জানানো হয়েছে। তাতে এ–ও বলা হয়েছে, ভারতের বন্দর ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এ বিধিনিষেধ প্রযোজ্য হবে না।

বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা বলছেন, এতে দেশের রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রায় ১৫৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যই বেশি। এ ছাড়া বিভিন্ন কোম্পানি প্লাস্টিক পণ্য ও আসবাব রপ্তানি করে।

ভারত মাছ, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি), ভোজ্যতেল ও ভাঙা পাথর নিষেধাজ্ঞার আওতায় রাখেনি।

বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকেরা এবং প্রাণ-আরএফএলসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ভারতে পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে। তাদের আশঙ্কা, এই বিধিনিষেধের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে।

জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (মার্কেটিং) কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রায় সব স্থলবন্দর ব্যবহার করে আমরা বিভিন্ন ধরনের পানীয় থেকে শুরু করে কনফেকশনারি সামগ্রী, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী ভারতের বাজারে রপ্তানি করি। ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় স্থলবন্দর ব্যবহার করে এসব সামগ্রী আমদানিতে যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, সেটি কার্যকর হলে আমাদের পণ্য রপ্তানি মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।’

এদিকে গত এপ্রিলে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে নিজ দেশের বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশের পণ্য যাওয়ার ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে ভারত। ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) এ সুবিধা বাতিল করে আদেশ জারি করেছিল। ২০২০ সালের ২৯ জুন এ-সংক্রান্ত এক আদেশে এই সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। তখন বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানিতে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের কলকাতা বন্দর, নবসেবা বন্দর ও কলকাতা বিমান কার্গো কমপ্লেক্স ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছিল সিবিআইসি। গত এপ্রিল থেকে সে সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয় ভারত।

এরপর গত ১৫ এপ্রিল বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) স্থলপথে ভারত থেকে সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করে।

এখন স্থলবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারতীয় আমদানিকারকদের জন্য বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মো. মাহবুবুর রহমান আজ রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে সুসম্পর্ক আশা করি বলে বিষয়টিকে আমরা গভীরভাবে দেখছি। এভাবে বিচ্ছিন্নতা বাড়লে উভয় পক্ষেরই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। আমরা এ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে দর-কষাকষি করব।’

এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের ব্যাপারে আলোচনা করতে ভারতের ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে কয়েক দিনের মধ্যেই অনুরোধ আসবে বলে মনে করছেন বাণিজ্যসচিব।

ভারতীয় পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এখন কী করবেন—এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব বলেন, কাল রোববার অনুষ্ঠেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় এ নিয়ে কথা হতে পারে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনসহ আরও কয়েকজন উপদেষ্টা এ নিয়ে আলাদা বৈঠকও করতে পারেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ব্যবসায়িক পর্যায়ে সমস্যা সমাধানের সুযোগ নেই
  • বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে নতুন করে অস্বস্তি
  • বাংলাবান্ধায় আটকে গেছে প্লাস্টিক পণ্যের ট্রাক
  • তৈরি পোশাকবোঝাই ৩৬টি ট্রাক বেনাপোল বন্দরে আটকে আছে
  • বেনাপোল বন্দরে আটকা গার্মেন্টস পণ্য বোঝাই ৩৬ ট্রাক
  • পোশাকের চালান এখন চট্টগ্রাম থেকে মুম্বাই বন্দরে যেতে হবে
  • স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করল ভারত
  • স্থলপথে বাংলাদেশি কিছু পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করল ভারত
  • স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের কিছু পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করল ভারত