পণ্য খালাসে হচ্ছে বিলম্ব, ভোগান্তিতে ব্যবসায়ীরা
Published: 25th, May 2025 GMT
চীনের শেকু বন্দর থেকে রওনা হওয়ার আট দিন পর ১৯ মে বন্দর জলসীমায় পৌঁছে এমভি সান পেদ্রো নামের ছোট্ট কনটেইনার জাহাজ। ছয় দিন ধরে সাগরে ভাসার পরও জাহাজটি জেটিতে ভিড়তে পারেনি। কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কলমবিরতির কারণে আমদানিতে যে অচলাবস্থা তৈরি হচ্ছে, তার শিকার এই জাহাজ।
জাহাজটিতে রয়েছে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান এশিয়ান গ্রুপের ‘চিটাগাং এশিয়ান অ্যাপারেলসের’ আমদানি করা কাপড়। এ কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরি করে রপ্তানি হবে ইউরোপ-আমেরিকায়। কিন্তু কখন পণ্য হাতে পাওয়া যাবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
জানতে চাইলে এশিয়ান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পোশাক তৈরিতে হাতে সময় থাকে বড়জোর ২০-২৫ দিন। সেখানে কাঁচামাল খালাসে এখন ১০-১২ দিন চলে যাচ্ছে। তাহলে কীভাবে এই পোশাক নির্ধারিত সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের ক্রেতার কাছে পৌঁছাব। নির্ধারিত সময়ে রপ্তানি করা না গেলে উড়োজাহাজে পাঠাতে হবে। সে ক্ষেত্রে উড়োজাহাজের ভাড়া দিতে হবে আমাদের।’
জাহাজটিতে দেশের ২৯৮ প্রতিষ্ঠানের আমদানি পণ্য রয়েছে, যার সিংহভাগই পোশাকশিল্পের কাঁচামাল। এই জাহাজের মতো ১৫টি জাহাজ বেশ কিছুদিন ধরে জেটিতে ভিড়তে না পেরে সাগরে ভাসছে। এসব জাহাজে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ নানা সরঞ্জাম রয়েছে। সব মিলিয়ে এসব জাহাজে চার হাজারের বেশি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান পণ্য আমদানি করেছে। এনবিআরের কর্মকর্তাদের কর্মসূচির কারণে এসব প্রতিষ্ঠান ভুক্তভোগী হচ্ছে। সর্বশেষ গত রাতে এনবিআরের আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। তবে ব্যবসায়ী ও বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, কর্মসূচি স্থগিত হলেও বন্দরে তার প্রভাব কাটতে কিছুটা সময় লাগবে।
এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি বিভাগ করে ১২ মে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এর প্রতিবাদে ১৪ মে আন্দোলন শুরু করেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর মধ্যে গত শনিবার থেকে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি পালন করছেন তাঁরা। কর্মসূচির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া পণ্যের ৯৫ শতাংশ এই কাস্টম হাউসে শুল্কায়নের মাধ্যমে খালাস হয়। আবার সারা দেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৭৯ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা-নেওয়া হয়। ফলে কাস্টমস কর্মকর্তাদের কর্মবিরতির কারণে বন্দরেও অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর মকর ত ব যবস আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
হজের ইতিহাসে আক্রমণ ও ডাকাতি
রাজনৈতিক সংঘাত, মহামারি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও আগ্রাসী আক্রমণ এবং হজযাত্রীদের লুণ্ঠন হজের আয়োজনকে ব্যাহত করেছে। এই তৃতীয় পর্বে আমরা মঙ্গোল ও ক্রুসেডারদের আক্রমণ, সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণ এবং হজের পথে ডাকাতির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
মঙ্গোল ও ক্রুসেডারদের আক্রমণ
মঙ্গোল ও ক্রুসেডারদের আক্রমণ মুসলিম অঞ্চলগুলোতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে হজের পথকে বিপজ্জনক করে তুলেছিল। মঙ্গোলদের আক্রমণ ৬১৫ হিজরি (১২১৮ খ্রি.) সনে শুরু হয়, যখন তারা মঙ্গোলিয়া ও উত্তর চীন থেকে খোয়ারিজমীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। এই আক্রমণ ইরান, ইরাক এবং মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধ্বংস করে দেয়। আবু শামা মাকদিসি (মৃ. ৬৬৫ হি.) তাঁর আয-যাইল আলা আর-রাওযাতাইন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে ৬১৭ হিজরি (১২২০ খ্রি.) সনে খোরাসান ও পারস্য অঞ্চল থেকে কেউ হজে যেতে পারেননি, কারণ মঙ্গোলদের ভয়ে পথ অনিরাপদ হয়ে পড়েছিল।
৬৩০ হিজরি (১২৩৩ খ্রি.) থেকে মঙ্গোলদের আক্রমণ ইরাকের দিকে মোড় নেয়, যা আব্বাসি খিলাফতের কেন্দ্র বাগদাদকে হুমকির মুখে ফেলে। ইমাম জাহাবি (মৃ. ৭৪৮ হি.) তাঁর তারিখ আল-ইসলাম গ্রন্থে বলেছেন যে এই সময়ে ইরাক থেকে হজ বন্ধ হয়ে যায়, কারণ মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে যুদ্ধে অংশ নিতে হয়। আব্বাসি খলিফা মুস্তানসির বিল্লাহ (মৃ. ৬৪০ হি.) হজ ত্যাগ করে মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ফতোয়া পান। এই সিদ্ধান্ত হজ বন্ধের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল। ৬৫৬ হিজরি (১২৫৮ খ্রি.) সনে মঙ্গোলরা বাগদাদ দখল করে আব্বাসি খিলাফতের পতন ঘটায়, যা ইরাক থেকে হজ বন্ধের সময়কালকে আরও দীর্ঘায়িত করে।
ক্রুসেডারদের আক্রমণও হজের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। ৪৯২ হিজরি (১০৯৯ খ্রি.) সনে ক্রুসেডাররা ফিলিস্তিন ও শামের উপকূলীয় অঞ্চল দখল করে। ইবনে কাসির (মৃ. ৭৭৪ হি.) তাঁর আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে ৬২৪-৬২৭ হিজরি (১২২৮-১২৩১ খ্রি.) সনে শামের হাজিরা তিন বছর ধরে হজে যেতে পারেননি। ক্রুসেডারদের উপস্থিতি ও আইয়ুবি শাসনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব পথের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে। এই আক্রমণগুলো হজের পথে ভয় ও অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয়, যা হাজিদের যাত্রাকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছিল।
আরও পড়ুনহজের ইতিহাসে মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ২৪ মে ২০২৫কখনো কখনো শাসকেরাও লুটেরাদের সঙ্গে সমঝোতা করতেন। ৩৮৫ হিজরি সনে বদর ইবনে হাসানওয়াইহ কুর্দি (মৃ. ৪০৫ হি.) আসফার আরাবিকে ৫ হাজার দিনার প্রদান করেন, যাতে হাজিরা নিরাপদে যাত্রা করতে পারেন।সামাজিক-অর্থনৈতিক বাধা
হজ পালনের জন্য অর্থনৈতিক সামর্থ্য এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফাতেমি ও আব্বাসিদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সময় মিসর ও ইরাকে অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। ইবনে জাওজি (মৃ. ৫৯৭ হি.) তাঁর আল-মুনতাজাম গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে ৪১১ হিজরি (১০২১ খ্রি.) সনে দক্ষিণ ইরাকের ওয়াসিতে যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের কারণে হজে গমন বন্ধ হয়ে যায়। এই অর্থনৈতিক সংকট হাজিদের জন্য পথের খরচ বহন করা অসম্ভব করে তুলেছিল।
৪৪১ হিজরি (১০৫০ খ্রি.) সনে বাগদাদে সুন্নি-শিয়া দাঙ্গা হয়, যা ইবনে কাসিরের বর্ণনা অনুযায়ী হজে যাতায়াত বন্ধের কারণ হয়। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সংঘাত হাজিদের মধ্যে ভয় ও অনাস্থা সৃষ্টি করে, যার ফলে তাঁরা হজে যাওয়া থেকে বিরত থাকতেন।
ডাকাতি ও লুটপাট
আরব উপদ্বীপের মরুভূমি এবং অন্যান্য অঞ্চলের পথে বেদুইন ও অন্যান্য লুটেরা গোষ্ঠী হাজিদের কাফেলার ওপর হামলা চালাত। ইবনে আসির (মৃ.৬৩০ হি.) তাঁর আল-কামিল গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে ৩৮৪ হিজরি (৯৯৫ খ্রি.) সনে আসফার আরাবিকে নামক একজন বেদুইন নেতা হাজিদের পথ রোধ করে এবং তাদের সম্পদ দাবি করে। আলোচনার পর হাজিরা সময়ের অভাবে ফিরে আসেন এবং হজ পালন করতে পারেননি।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল ৪২৪ হিজরি (১০৩৪ খ্রি.) সনে। ফাসি (মৃ. ৮৩২ হি.) তাঁর শিফা আল-গারাম গ্রন্থে বলেছেন যে এই বছরে ইরাক ও মিসর থেকে হাজিরা বেদুইনদের ভয়ে হজে যেতে পারেননি। যাঁরা বসরা থেকে যাত্রা করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও লুটেরারা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁদের সম্পদ লুট করে।
কখনো কখনো শাসকেরাও লুটেরাদের সঙ্গে সমঝোতা করতেন। উদাহরণস্বরূপ, ৩৮৫ হিজরি (৯৯৬ খ্রি.) সনে বদর ইবনে হাসানওয়াইহ কুর্দি (মৃ.৪০৫ হি.) আসফার আরাবিকে ৫ হাজার দিনার প্রদান করেন, যাতে হাজিরা নিরাপদে যাত্রা করতে পারেন। ইবনে তাগরিবারদি (মৃ. ৮৭৪ হি.) এ ঘটনার উল্লেখ করে বলেছেন যে এটি একটি নিয়মিত রীতিতে পরিণত হয়েছিল।
আরও পড়ুনমদিনার হজ কার্যালয় যেন 'বাংলাদেশ'২২ জুন ২০২৪৬৫৬ হিজরি (১২৫৮ খ্রি.) সনে মঙ্গোলরা বাগদাদ দখল করে আব্বাসি খিলাফতের পতন ঘটায়, যা ইরাক থেকে হজ বন্ধের সময়কালকে আরও দীর্ঘায়িত করে।ফিকহের দৃষ্টিকোণে ডাকাতির প্রভাব
হজের পথে ডাকাতি ও লুটপাট ফিকহের আলোচনায়ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে। ইমাম কাসানি (মৃ. ৫৮৭ হি.) তাঁর বাদাইউস সানাই গ্রন্থে বলেছেন যে পথে নিরাপত্তার অভাব হজের ফরজ হওয়াকে বাতিল করে। মালিকি ফকিহরা দীর্ঘ পথে ডাকাতির ঝুঁকির কারণে হজের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করার ফতোয়া দিয়েছিলেন। ইবনে রুশদ (জাদ্দ) (মৃ. ৫২০ হি.) ও তুরতুশি (মৃ. ৫২০ হি.) বলেছেন যে পথের ঝুঁকি হজকে নিষিদ্ধ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
আল–জাজিরা ডট নেট অবলম্বনে
পর্ব-২: হজের ইতিহাসে মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ
পর্ব-১: হজের ইতিহাসে রাজনৈতিক ঘটনাচক্র
আরও পড়ুনসহজ ওমরাহ ৩০ জানুয়ারি ২০২৫