পাকিস্তানের বক্তব্যের জবাবে ভারতের আসাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা দাবি করেছেন, চীন ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহ কমিয়ে দিলে ভারতের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। বার্ষিক বন্যার হাত থেকে আসাম মুক্তি পাবে। জনজীবন ব্যাহত হবে না। সম্পত্তির ক্ষতি হবে না।

কেন ক্ষতি হবে না, সেই ব্যখ্যাও দিয়েছেন বিজেপিদলীয় মুখ্যমন্ত্রী। এক্সে দীর্ঘ পোস্টে তিনি বলেছেন, ব্রহ্মপুত্র একটি মাত্র প্রবাহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। ওই নদের মোট পানি প্রবাহের বড় জোর ৩০–৩৫ শতাংশ চীনের অবদান। বাকি ৭০ শতাংশ পানি প্রবাহের কৃতিত্ব অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, নাগাল্যান্ড ও মেঘালয়ের। ভারতের তীব্র বর্ষা টইটুম্বুর করে রাখে ব্রহ্মপুত্রকে। কৃষ্ণাই, দিগারু ও কুলসির মতো খাসি, গারো ও জয়ন্তিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা নদীগুলোর পানিও ব্রহ্মপুত্রে এসে মেশে। ফলে সুবনসিঁড়ি, লোহিত, কামেঙ্গ, মানস, ধানসিঁড়ি, জিয়া ভরালি ও কোপিলির মতো শাখা নদীগুলোয় পানির অভাব হয় না।

হিমন্ত এই তথ্য হাজির করে পাকিস্তানের দেখানো ‘জুজুর’ ভয় উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, চীনে নয়, ব্রহ্মপুত্র ফুলে ফেঁপে ওঠে ভারতে। চীন পানি প্রবাহ কমালে ভারত তাই মোটেই হাঁসফাঁস করে মরবে না।

পেহেলগামে সশস্ত্রগোষ্ঠীর হামলার পর ভারত সিন্ধু চুক্তি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করে। চিন্তিত পাকিস্তান দ্বারস্থ হয় তার মিত্র চীনের। গত ৩১ মে বেজিংয়ের সেন্টার ফর চায়না অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ঝিকাইগাঁও ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহ কমিয়ে দেওয়ার এক প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেন।

ইন্ডিয়া টুডে–কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঝিকাই বলেন, যে ব্যবহার নিজের ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত ও অপছন্দের, তা অন্য কারও সঙ্গে করা উচিত নয়। তিনি সরাসরি জানিয়েছিলেন, চীনের বন্ধু পাকিস্তানের প্রাপ্য পানি ভারত যদি বন্ধ করে দেয়, তাহলে চীনও ভারতে প্রবাহিত পানি বন্ধ করে দিতে পারে।

ওই সাক্ষাৎকারের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রানা ইহসান আফজল এএনআইকে বলেছিলেন, সিন্ধু পানি চুক্তি যেমন স্থগিত রাখা হয়েছে, তেমন চীনও তার নদীর প্রবাহে রাশ টানতে পারে।

পাকিস্তানের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বক্তব্যের জবাবে হিমন্ত বলেছেন, এই গালগল্প নস্যাৎ করা দরকার। ভয়ে ভয়ে নয়, তথ্য দিয়ে। সত্য এই, ব্রহ্মপুত্র ভারতেই ফুলে ফেঁপে ওঠে। শুকিয়ে যায় না। কারণ, মোট পানি প্রবাহের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ ভারতেরই অবদান।

হিমন্ত বলেছেন, এই নদের পানির উৎস উজানে নয়। এই নদ বৃষ্টি নির্ভর। অরুণাচল প্রদেশ দিয়ে ভারতে প্রবেশের পর থেকে রাজ্যের বৃষ্টির পানিতে তা ভরপুর হয়ে ওঠে।

হিমন্ত ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে লিখেছেন, টিউটিংয়ে চীন–ভারত সীমান্তে ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে ২ থেকে ৩ হাজার কিউবিক মিটার। প্রতি মৌসুমে সেই প্রবাহ গুয়াহাটির মতো জায়গায় বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ থেকে ২০ হাজার কিউবিক মিটার।

পাকিস্তানের উদ্দেশে হিমন্ত বলেন, ‘ওদের জানা দরকার, চীন পানি প্রবাহ কমিয়ে দিলে (মনে হয় না তারা তা করবে, কারণ, সেই হুমকি কোনো সরকারি মহল থেকে এখনো কেউ দেয়নি) বরং তা ভারতের উপকারই করবে। কারণ, বন্যা হবে না। লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হবেন না। সম্পত্তি নষ্ট হবে না।’

বার্তাটি হিমন্ত শেষ করেছেন পাকিস্তানকে এই কথা মনে করিয়ে দিয়ে যে, একটি মাত্র প্রবাহ ব্রহ্মপুত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে না। এই নদের জীবনশক্তি হলো ভারতের ভৌগোলিক আধার, মৌসুম ও ভারতীয় সভ্যতার প্রাণোচ্ছলতা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হ মন ত ব বল ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ