‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়, বন্ধ করার এখনই সময়’-এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসে বাংলাদেশ সরকারের এই স্লোগান যেন প্লাস্টিক দূষণের বাস্তবতা। প্রতিদিন হাজার হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্যে সয়লাব হয়ে পড়ছে শহর-বন্দর, নদী-নালা ও সমুদ্র উপকূল। পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি বাড়ছে মানুষের দৈনন্দিন দুর্ভোগ।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য। বাকি প্রায় ৫ লাখ টন বর্জ্য থেকে যাচ্ছে প্রকৃতিতে, যা শত বছরেও নষ্ট হয় না। এই দীর্ঘস্থায়ী দূষণ মাটি, পানি ও বায়ুর সঙ্গে মিশে ইকোসিস্টেম ধ্বংস করছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

প্লাস্টিক বর্জ্যের বড় অংশজুড়ে রয়েছে একবার ব্যবহারযোগ্য পানির বোতল, পলিথিন, প্রসাধনী ও ঘরোয়া সামগ্রী।এগুলো নর্দমা ও ল্যান্ডফিলে গিয়ে বর্ষার পানিতে বাধা সৃষ্টি করে শহরে জলাবদ্ধতার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।বর্ষা মৌসুমে ঢাকা শহরে বৃষ্টি হলেই যে জলাবদ্ধতা তৈরি হয় সেটা এসব প্লাস্টিকের কারণেই হয় বলে মনে করেন অনেকে।

আরো পড়ুন:

কারখানায় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে দাম দিতে হবে : উপদেষ্টা  

কিশোরগঞ্জে পানি উঠছে না নলকূপে, খাবার পানির তীব্র সংকট

দেশের প্রধান তিন নদী-পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায় প্রতিদিন পড়ছে প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক ও পলিথিন। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) জানায়, দেশের নদীগুলোর পানিতে প্রতিদিন ১৫ হাজার ৩৪৫ টন প্লাস্টিক গিয়ে পড়ে, যা সরাসরি বঙ্গোপসাগরে জমা হচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রের তলদেশে প্লাস্টিকের স্তর তৈরি হচ্ছে, মারা যাচ্ছে সামুদ্রিক প্রাণী, ধ্বংস হচ্ছে সামুদ্রিক প্রাণিবৈচিত্র্য।

ঢাকায় প্লাস্টিক দূষণ সবচেয়ে ভয়াবহ। দেশের মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের ৩০ শতাংশের বেশি উৎপন্ন হয় রাজধানীতে। প্রতিদিন গড়ে ৬৮১ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার ৮০ শতাংশই একবার ব্যবহারযোগ্য পণ্য। মাথাপিছু বছরে যেখানে গড়ে ৯ কেজি বর্জ্য উৎপন্ন হয়, ঢাকায় তা দ্বিগুণ-১৮ কেজি। নগর ব্যবস্থাপনার জন্য একক ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্লাস্টিক ব্যবহারকারী শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় আছে বাংলাদেশ। ২০০৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশের প্লাস্টিক ব্যবহার বেড়েছে তিনগুণের বেশি। ২০১৫ সালের গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশের শহরগুলোতে প্রতিদিনের বর্জ্য ৫০ হাজার টনে পৌঁছাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিনের প্যাকেটসহ সিঙ্গেল ইউজ প্রোডাক্টের কারণে শহর ব্যবস্থাপনায় ধস নেমেছে। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য নর্দমা ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়নে কংক্রিটের নিচে মাটি হারিয়ে ফেলায় পানির প্রাকৃতিক শোষণও হচ্ছে না। ফলে প্লাস্টিক বর্জ্যে আটকে থাকা ড্রেন ও খালে সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন দরিদ্র ও বস্তিবাসী মানুষ।

রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, “পরিবেশ দূষণের জন্য প্লাস্টিক ও পলিথিন অন্যতম দায়ী।বিশেষ করে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক, প্যাকেট ও পলিথিন সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ। গত তিন মাসে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ১০৮ কিলোমিটর খাল পরিষ্কার করা হয়েছে যার অধিকাংশই প্লাস্টিকে ভরপুর ছিল। সোর্স থেকে প্লাস্টিক না কমালে শুধু পরিষ্কার করে কোন লাভ হচ্ছে না।”

এই বাস্তবতায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদিও অন্তর্বর্তী সরকার পরিবেশ দূষণ রোধ করতে সব সরকারি অফিসে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছেন।কিন্তু সার্বিকভাবে প্লাস্টিক দূষণের ফলে পরিবেশকে বিপর্যয় থেকে মুক্ত করতে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি টেকসই, বাস্তবসম্মত এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। পাশাপাশি জনসচেতনতা ও সরকারি নজরদারি বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।

ঢাকা/এসবি

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব শ ব প ন দ বস পর ব শ প ল স ট ক বর জ য টন প ল স ট ক ব যবস থ পল থ ন পর ব শ সরক র সবচ য়

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ