সে কালের নিভৃত পল্লীর মুসলিম সমাজ ও ‘বকরি’ ঈদ
Published: 7th, June 2025 GMT
ইংরেজ আমলের দীর্ঘকাল পর্যন্ত সবার ধারণা ছিল বাংলার অধিকাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মের অনুসারী। কিন্তু ১৮৭২ সালে প্রদেশটির প্রথম আনুষ্ঠানিক আদমশুমারিতে দেখা যায় সমগ্র বাংলায় প্রায় অর্ধেক এবং পূর্ব বাংলায় অর্ধেকের বেশি মানুষ মুসলমান। অনেক এলাকায় তাদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তাছাড়া আরবদের পর বাঙালিরাই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী। ইসলামের সূতিকাগার আরব দুনিয়া থেকে অনেক দূরে অবস্থিত বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কীভাবে মুসলিম হয়েছিল, এ নিয়ে নানা জনের নানা মত আছে।
তৎকালীন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সরকারী কর্মকর্তা জেমস ওয়াইজ লেখেন যে, ‘১৮৭২ সালের আদমশুমারীতে উদঘাটিত সব চাইতে কৌতুহলোদ্দীপক তথ্যটি হলো পুরনো রাজধানীগুলোর চারদিকে জড়ো হয়ে নয়, বরং বদ্বীপের পাললিক সমতলের নিভৃত পল্লীতে বিপুল সংখ্যক মুসলমান বসবাস করে’। এ বিষয়ে প্রথম উত্তপ্ত বিতর্কের সূত্রপাত ঘটান আদমশুমারির প্রতিবেদনের সঙ্কলক হেনরি বেভারলি। তিনি যুক্তি দেখান, বাংলায় মুসলিম শাসক ও তাদের সাথে আগত লোকদের বংশস্তিারের কারণে এটা ঘটেনি, বরং স্থানীয়দের ধর্মান্তরের কারণেই এটা ঘটেছে।
১৮৮১ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, বাইরের থেকে যেসব রাজাবর্গ ও তাদের সাথে যারা এসেছে তাদের বংশধরদের মাধ্যমে মুসলমান জনগোষ্ঠী কোন ভাবেই এত বেশি হওয়া সম্ভব নয়। স্থানীয় দরিদ্র কৃষকদের ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে এটা ঘটেছে।
এই বিতর্ক যখন চরমে যে, বাংলার মুসলমানদের প্রায় সবাই নিম্ন বর্ণের ও বর্ণ বহির্ভূত অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর লোক থেকে এসেছে, তখন আবু এ.
এমন বিতর্কের মধ্যে ১৯০১ সালে ভারতে আবার আদমশুমারী হয়। যার প্রতিবেদনে ই.এ. গেইট উপসংহার টানেন যে, নিজেদের সম্প্রদায়গত পরিচয় জানতে চাওয়া হলে বাঙালি মুসলিম কৃষকের দশ ভাগের নয় ভাগই স্থানীয় বংশোদ্ভুত বলে উল্লেখ করেন। তিনি সিধান্ত দেন অভিবাসন আদৌ ঘটেছিল কি না সে বিষয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন। মুসলিম অভিবাসীরা সাধারণত পুরনো রাজধানীগুলোর আশেপাশে বাস করত তারা কোনদিন নোয়াখালী, বগুড়া, বাকেরগঞ্জের মত জেলাগুলোতে ধানচাষ করতে বা ঘড়বাড়ি বানাতে যেতো না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মুসলিমরা পূর্ব বাংলায় কীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো এ বিতর্কের এখনও শেষ হয়নি। নানা জন নানা ব্যাখ্যা আছে । তবে বাজারে প্রচলিত সব গৎবাঁধা ব্যাখ্যাগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক রিচার্ড ম্যাক্সওয়েল ইটন। যিনি রিচার্ড এম ইটন নামে পরিচিত। দীর্ঘ গবেষণার পর ১৯৯৩ সালে ‘রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দা বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার-১২০৪-১৭৬০’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কীভাবে মুসলমান হয়েছিল তিনি তার গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি হচ্ছেন প্রথম ঐতিহাসিক, যিনি একটি তাত্ত্বিক কাঠামোর (paradigm) মধ্যে মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস বিশ্লেষণ করেছেন।
বাংলার সঙ্গে আরবদের সম্পর্ক অত্যন্ত প্রাচীন, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা:) এর ইসলাম প্রচারের (৬১০) অনেক পূর্বেই আরব বণিকরা বাংলায় এসেছিলেন। মহানবির জীবদ্দশায় এমনকি, সম্ভবত হিজরতের আগে বাংলায় বিশেষ করে উপকূল অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম এসে পৌঁছায়। ২য় খলিফা হজরত উমরের (রা.) খিলাফতকালে (৬৩৫-৪৫) একদল ইমাম প্রচারক বাংলায় আসেন। পরবর্তীতে উপকূল অঞ্চলে আরব ও পারসিক বণিকদের বসবাস বেড়ে যায়। বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক বাংলার অংশবিশেষ অধিকার করার পর এদেশে মুসলমানদের আগমন এবং তাদের এদেশে বসতি স্থাপন করা আরও বেড়ে যায়। ইবনে বতুতার Travels in Asia and Africa গ্রন্থ থেকে ধারণা করা হয় চতুর্দশ শতাব্দীতেও পূর্ব বাংলায় কোনো গণ-ধর্মান্তর ঘটেনি। ধর্ম প্রচারক শাহজালালের সাথে দেখা করে সিলেট থেকে ফেরার পথে তিনি মেঘনা নদী দিয়ে পনেরো দিনব্যাপী ভ্রমণ করেছিলেন। তখন পূর্ব বাংলায় তেমন মুসলমান দেখেননি বলে তিনি বর্ণনা করেছেন।
রিচার্ড এম ইটন তার গ্রন্থে উল্লেখ করছেন, মুসলিম শাসকরা প্রায় ৫০০ বছর বাংলা শাসন করলেও প্রথম ৪০০ বছরে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল খুবই অল্প । পূর্ব বাংলায় মুসলিম জনসংখ্যা বেড়েছে শেষ ১০০ বছরে। মোঘলদের বাংলা জয়ের পর বিশেষ করে সম্রাট আকবারের (১৫৭৫ সালের পর) সময় থেকে মুসলিম জনসংখ্যা হুহু করে বাড়তে থাকে।
বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে চারটি তত্ত্ব প্রচলিত আছে। তবে রিচার্ড এম ইটন সেগুলো উড়িয়ে দিয়ে নতুন এক তত্ত্ব দিয়েছেন যেটা সীমান্ত তত্ত্ব নামে পরিচিত।
অনেকের মতে, ভারতে তথা বাংলায় ইসলাম এসেছে তরবারির মাধ্যমে যাকে তরবারি তত্ত্ব বলা হয়। এটাকে নাকচ করে দিয়ে ইটন বলেন, তরবারি দিয়ে মানুষের ধর্মকে পরিবর্তন করা যায় না আর এই ধরনের ঘটনা ভারত তথা বাংলায় ঘটেনি। সেনা অভিযানের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চল করায়ত্ত করার সময় বল প্রয়োগের ঘটনা দুই একটি ঘটতে পারে বা অন্য ধর্মের দুই একটি উপাসনালয় ধ্বংসের ঘটনাও ঘটতে পারে তবে মুসলিম শাসকরা এটাকে কোন সময় নীতি হিসাবে গ্রহণ করেনি। ইসলাম যদি ভারতে তরবারির মাধ্যমে আসত তাহলে দিল্লি-আগ্রার আশপাশের অঞ্চল মুসলমান অধ্যুষিত হত, কেননা মুসলিম শাসকরা সেখানে বসে শত শত বছর শাসন করেছে, তাদের তরবারি ছিল সেখানে অনেক শক্তিশালী। অথচ দিল্লি-আগ্রার আশপাশের অঞ্চলগুলোসহ মূল ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা কোন সময় ১৫ শতাংশের বেশি ছিল না। অন্যদিকে, পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত, জলাভূমি বা বনজঙ্গলে আচ্ছন্ন অঞ্চলে সেই অর্থে সেনা অভিযানের তেমন ঘটনা ঘটেনি; যেখানে তরবারি ছিল অনেক দুর্বল। অথচ সেখানে মুসলমানের সংখ্যা বেশি।
অনেকের মতে, মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় (যাকে বলা হয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা তত্ত্ব) ইসলাম ধর্ম সম্প্রসারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিশেষ করে চাকরি বা কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক ভূমিকা পালন করে। রিচার্ড এম ইটন এমন ধারণাও মানতে নারাজ। তার মতে, বাংলায় উলটো ঘটেছে। বাংলার প্রত্যন্ত এলাকায় রাষ্ট্রের কোন সুযোগ-সুবিধা ছিল না। ইবনে বতুতা উল্লেখ করেছেন, স্থানীয়দের মধ্যে কেউ নও-মুসলিম হিসেবে অতি উৎসাহী হয়ে সুলতানদের সাথে দেখা করলে পুরস্কার হিসেবে তাদের মর্যাদা অনুসারে আলখেল্লা পেত। অর্থাৎ বাংলার নব্য মুসলিমরা তাদের ধর্মের শাসকদের কাছ থেকে চাকরি বা অন্য কোন আর্থিক সুবিধা পেত তার তেমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
অনেকের মতে, জাতিভেদ প্রথার কারণে নিম্নবর্ণের লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে যাকে বলা হয় সামাজিক মুক্তির তত্ত্ব। রিচার্ড এম ইটন এ ধারণা ও মানতে নারাজ। তার মতে, বাংলায় ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে যে সব জনগোষ্ঠী তারা ব্রাহ্মণিক সংস্কৃতির সংস্পর্শ পেয়েছিল খুব কমই। যেহেতু ব্রাহ্মণদের কর্তৃত্বই ছিল না সেখানে কঠোর জাতিভেদ প্রথার কথা উল্লেখ করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তিনি বিভিন্ন গ্রন্থের রেফারেন্স দিয়ে বলছেন, বাংলা কোন সময় ব্রাহ্মণদের এলাকা বা দেশ ছিল না। প্রথম দিকের তাদের ধর্মের গ্রন্থসমূহে ব্রাহ্মণদের পূর্ব দিকের সীমানা দিল্লির পাশে যমুনা নদী পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। পরবর্তীতে পূর্ব দিকের সীমানা বিহার পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। বাংলায় মূলত অনার্যরা বাস করত। এদের নিদিষ্ট কোনো ধর্ম ছিল না। তার মতে, ঐ সময়ে স্থানীয়দের মধ্যে শোষণহীন অন্য সমাজ সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা ছিল না।
ইটন এটাই দেখাচ্ছেন, বর্ণবাদের কারণে নতুন ধর্ম গ্রহণ করলে উপমহাদেশের অন্যান্য অংশে ইসলামের প্রসার অধিকতর লক্ষণীয় হত। তাছাড়া এমনটা ঘটলে সেটা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার (বখতিয়ার খিলজী) পরপরই হওয়ার কথা ছিল। তবে তখন সেটা ঘটেনি।
অভিবাসী তত্ত্ব-অনেকের মতে, পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান হয়েছে অভিবাসনের কারণে। অর্থাৎ ইরান, তুরান (মধ্য এশিয়া) ও আরব থেকে এসে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছে। কেননা গানে আছে না ইরান, তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি। তবে ইটনের মতে, রাজাবর্গ ও তাদের সাথে যারা এসেছে বা ধর্ম প্রচারকদের বংশধরদের মাধ্যমে মুসলমান জনগোষ্ঠী বেড়েছে ঠিকই তবে তা কোনোভাবেই ৫ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়। স্থানীয়দের কারণে সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। যেসব বহিরাগত মুসলিমরা এসেছিল তারা ছিল মূলত নগরকেন্দ্রিক। পুরোনো রাজধানীগুলোর চারদিকে জড়ো হয়ে বসবাস করত। প্রত্যন্ত গ্রামে তারা যেত না এবং পেশা হিসাবে কৃষি ছিল তাদের অপছন্দের। আবার একটা বড় অংশ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি করে ফিরে যেত।
রিচার্ড এম ইটন এক্ষেত্রে প্রান্ত বা সীমান্ত তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। তার মতে, ভারতের পূর্ব সীমানার শেষ প্রান্তে থাকায় বাংলায় মোঘলদের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যে কারণে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এক শ্রেণির লোক এখানে বসতি স্থাপন করে, যাদেরকে আমরা সুফি-সাধক, পীর, আউলিয়া ও ধর্ম প্রচারক বলে থাকি। মোঘলরা ভূমি ব্যবস্থাপনা ও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার কারণে এমনটি ঘটেছে, আর এক্ষেত্রে সাহায্য করেছে প্রকৃতি। স্থানীয় লোকেরা কৃষি কাজের সাথে সংযুক্ত হতে এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইসলাম ধর্মে জড়িয়ে পড়ে।
রিচার্ড এম ইটন পীর, সুফি বা ইসলাম প্রচারকদের উদ্যোক্তা, কৃষির কারিগর, কৃষির অগ্রদূত ও বনজঙ্গল পরিষ্কারক হিসেবে দেখেন। তবে তাদের কারিশমা ছিল বলে তিনি স্বীকার করেন। তাদের সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপন, দানশীলতা, পরোপকারবোধ, উদার ও সহমর্মী মনোভাবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে তিনি মনে করেন।
তাছাড়া, সম্প্রতিকালে হাড়গোড় ও অন্যান্য আধুনিক নৃতাত্ত্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা স্থানীয় অধিকাংশ বাঙালি মুসলিমদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য তাদের প্রতিবেশী হিন্দু ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাথে সিংহভাগ মিল। ইরান, তুরান (মধ্য এশিয়া) ও আরবের জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের খুবই কম মিল রয়েছে। অতএব বাঙালী মুসলিমরা এই বদ্বীপেরই ভূমিপুত্র।
ইটন দেখানোর চেষ্টা করেছেন, সে সময়ে যারা মুসলিম হয়েছিল তারা ছিল নিভৃত পল্লীর দরিদ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর লোক এবং তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ ছিল। তারা ছিল গরিবের গরিব।
বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে ‘শুনে মুসলমান’। আসলে সেই সময় পল্লীর জনগোষ্ঠীর ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান খুবই কম ছিল। নব্য মুসলিমরা ধর্মের সঠিক নিয়মকানুন জানত না। যে কারণে অন্যের কাছ থেকে শুনে বা প্রভাবিত হয়ে ধর্মকর্ম পালন করত।
ইটনের মতে, ইংরেজ আমলে ভারতে বাষ্প ইঞ্জিন আসে, জাহাজে চড়ে মানুষ হজে যাওয়া শুরু করে এবং আরব ও অন্যান্য দেশের মুসলিমদের সংস্পর্শে এসে ইসলামের আদর্শ ও নিয়মনীতি জানতে পারে। এক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন ওহাবি ও সংস্কার আন্দোলনের কথা তুলে ধরেছেন। উনিশ ও বিশ শতকে ফরায়েজী ও তারিখে মোহাম্মাদির মত সংস্কার আন্দোলনে বাঙালি পল্লীসমাজ ভেসে যায়। হাজী শরিয়াতুল্লাহ (মৃত্যু ১৮৪০) পূর্বের ফাতিয়া পাঠ, প্রথা ও কবর পূজার মত অনেক কিছু বন্ধ করেন। সংস্কারক কেরামত আলী (মৃত্যু ১৮৯৪) কারণে বিভিন্ন পীরের অনুসারীরা ইসলামের সঠিক পথে চলতে শুরু করে।
এ সম্পর্কে জেমস ওয়াইজ ১৮৯৪ সালে লেখেন, ‘ফরায়েজী আন্দোলনের কারণে বাংলার কৃষকদল তাদের পূর্বের আবরণ ছুড়ে ফেলেছে, যা তাদের ধর্মকে বিকৃত করেছিল’।
মুসলিমদের সবচেয়ে বড় দুইটি ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে- ঈদ-উল ফিতর ও ঈদ-উল আযহা। ইতিহাসবিদদের মতে, বর্তমানে ঈদ-উল আযহা যেভাবে ব্যাপক জাঁকজমকের সাথে পালিত হয়, মোঘল ও ইংরেজ আমলে স্থানীয়রা সেভাবে পালন করত না। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র হবার পর জাঁকজমক হওয়া শুরু করে ও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার এর প্রবণতা বাড়তে থাকে। বর্তমানে ছোট-বড় সব শহর ও গ্রামে কোরবানির পশুর হাট বসে। শুধু হাট নয়, ঢাকা শহরের পাড়া-মহল্লার মোড়ে ও অলি-গলিতে পশু কেনাবেচার ধুম পড়ে যায়। হৃষ্টপুষ্ট, নানা ধরনের বাহারি গরু ও অন্যান্য পশু দেখা যায় । লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হয় পশু, কখনো বা বসে নিলাম। কে কত দামে বড় গরু কিনছে তারও এক ধরনের প্রতিযোগিতা দেখা যায়। এখন অনলাইনেও পশু কেনাবেচা হয়। এই সময় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
জেমস ওয়াইজের বিবরণ থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে গ্রামাঞ্চলে ঈদের উদযাপন একেবারে কম ছিল - এমনকি অনেকে ঈদের নামাজ কিভাবে পড়তে হয়, তাও অনেকে জানত না। অনেকের মতে, ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহর সময় বাংলায় বর্তমান সময়ের আঙ্গিকে ঈদ উদযাপনের প্রচলন শুরু হয়।
মোঘল আমলে শহরগুলোতে অভিজাত শ্রেণীর মুসলিমরা জাঁকজমকভাবেই কোরবানির ঈদ পালন করত। এক সময় দিল্লির অনুকরণে ঢাকায় ঈদের মিছিল হতো। তবে আর্থিক কারণে গ্রামাঞ্চলে তেমন জাঁকজমক ছিলনা।
মোঘল ও ইংরেজ আমলে গ্রামাঞ্চলের স্থানীয় মুসলিমরা ঈদ-উল আযহা কে বলত বকরি ঈদ। কেননা সেই সময় প্রায় সবাই বকরি বা খাসি কোরবানি করত। প্রথমত: ধর্মমত অনুসারে, হজরত ইব্রাহিম (আ.) দুম্বা কোরবানি দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশে দুম্বা পাওয়া যায় না। তবে দুম্বার সমগোত্রীয় পশু বকরি বা ভেড়া কোরবানি দেওয়াকে অনেকে উত্তম মনে করে।
দ্বিতীয়ত: অতি প্রাচীন কাল থেকে এ দেশের গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি পরিবার ছাগল পালন করে আসছে। আর বকরি কোরবানি করা ছিল তাদের সামর্থের মধ্যে। নিভৃত পল্লীর মুসলিমদের আর্থিক অবস্থা সেই সময় এতই খারাপ ছিল যে গরু বা অন্য বড় পশু কিনে কোরবানি দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। অনেক ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেন, ইংরেজ আমলে গরু কোরবানি দেওয়া জমিদারের তরফ থেকে একটা চাপ ছিল। যে কারণে বকরি কোরবানি দেওয়া আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আবুল মনসুর আহমদ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “বক্রা ঈদে গরু কোরবানি কেউ করিত না। খাশি-বকরি কোরবানি করা চলিত। লোকেরা করিতও তা প্রচুর”। ইতিহাসবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তার বাংলাদেশের উৎসব (১৯৯৪) বইয়েও এমনটা পাওয়া যায়।
নব্বই দশক পর্যন্তও অনেক বাড়িতে ফ্রিজ ছিল না, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। যে কারণে প্রতিদিন চুলায় গরম করে মাংস বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করত। আবার অনেকে হলুদ, লবণ, মরিচ দিয়ে রোদে মাংস শুকায়ে সংরক্ষণ করত।
সে কালের হজ
আগেকার দিনে হজ করাও ছিল অনেক কষ্টের ও জীবনের ঝুঁকি ছিল। মোঘল আমলে উট বা অশ্ব চড়ে বা পায়ে হেঁটে হজে যেত । ইংরেজ আমলে জাহাজে করে বোম্বাই, করাচি ও কলকাতা থেকে জেদ্দা পর্যন্ত যেতো। ব্রিটিশ কিছু কোম্পানি এই জাহাজগুলো পরিচালনা করত। হজ মৌসুমে অতিরিক্ত মুনাফা লাভের জন্য ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী বহন করে হজযাত্রীদের অবর্ণনীয় সমস্যাই ফেলত। অনেকে রওনা হলেও হজ করার সৌভাগ্য হত না। বোম্বাই বা অন্য কোন স্থান থেকে ফিরে আসত এবং তাদেরকে বোম্বাই হাজি বলা হত। হজে যাওয়ার আগে সবাই আত্নীয়-স্বজন ও পরিচিত জনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেত। তিন মাসের অধিক সময় লাগত হজ সমাপ্ত করে দেশে ফিরতে।
১৯২০ সালে হজে গমনকারী খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লার ডায়েরি থেকে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা জানা যায়। তিনি লিখেছেন, “অদ্য সমুদ্রে ভয়ানক তুফান ছিল। যাত্রীগণ হঠাৎ অস্থির ও বিচলিত হইয়া পড়িল। ...জিনিসপত্র পড়িয়া ভাঙ্গিতে লাগিল। সকলেরই আহার-বিহার বন্ধ রহিল। প্রতি মুহূর্তে জাহাজখানি সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হইবে, সকলের মনে এই আতঙ্ক ছিল।...
খারার-দাবার ও পানির সুব্যবস্থা ছিল না। সৌদির লোকদের বর্ষার জমানো পানি চড়া দামে কিনতে হত। জেদ্দা থেকে এক মাসের চালডাল নিয়ে দল বেঁধে উঠের পিঠে চড়ে মক্কা- মদিনায় যেত হত । মরুভূমির প্রচণ্ড তাপের মধ্যে নিজেদের রান্না করে খেতে হত। পথে ছিল ডাকাতের লুটপাটের ভয়।
খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লার ডায়েরিতে লিখছেন, “সমস্ত দেহ সূর্য্যতাপে দগ্ধ হইবার উপক্রম হইল। শরীর অবসন্ন হইয়া পড়িল, স্বাস্থ্যভঙ্গ হইল। বলিতে কি, প্রাণ ওষ্ঠাগত হইল। অদ্য তিনটি যাত্রীর দাফন-কাফন হইল। পথিমধ্যে রাত্রিকালে বন্দুকের আওয়াজ শুনা গিয়াছিল। জনৈক ইরাকী আরোহীর রসদ ও তিনশত টাকা লুট হইয়াছিল। শত্রুদের সহিত সংঘর্ষ হইয়াছিলও ফলে দুইটি লোক হত হইয়াছিল”।
ঢাকা/লিপি
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ও অন য ন য ই র জ আমল জনগ ষ ঠ র এক ষ ত র ব শ ষ কর ম সলম ন ইসল ম র ব তর ক ক রব ন পল ল র আর থ ক ত র মত অন স র গ রন থ কর ছ ন তত ত ব ইটন এ ন সময় প রথম তরব র ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
সেকালের ‘বকরি ঈদ’: সমাজ, সাহিত্য ও সাময়িকীতে প্রতিধ্বনি
‘আসিয়াছে ফের দুনিয়ার বুকে
খুসির বকরি ঈদ
সারাটি রজনী কাসেমের আজ
আসেনি নয়নে নিদ।’
কবিতার পঙ্ক্তিতে (এম. করিম–এর ‘কার ঈদ’) এমনিভাবে প্রকাশ পেয়েছে বকরি ঈদের জন্য বাঙালি মুসলমানের উন্মুখ প্রতীক্ষা। ‘ঈদুজ্জোহা’, ‘ঈদ-উল-বকর’ বা ‘ঈদ-উল-আযহা’ তথা কোরবানির ঈদ সামাজিক ইতিহাসের পরতে পরতে ‘বকরি ঈদ’ নামে অভিহিত। ‘বকরিদ’ বা ‘বকর ঈদ’ নামেও পরিচিত এই ঈদ। পত্রিকা, সাময়িকী ও সরকারি নথিপত্রে ‘ঈদ-উল-আদহা’ নামেও আখ্যায়িত হয়েছে কোরবানির ঈদ। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আরব বণিকেরা যখন এ দেশে আসতে শুরু করলেন তখন ঈদুল আজহার সময় তাঁরা বকরি (ছাগল) কোরবানি দিতেন বলে ‘ঈদুল আজহা’, ‘বকরি ঈদ’ নামেই সর্বাধিক পরিচিত পায়।
জেমস টেলরের বিবরণ অনুযায়ী, ১৮৩৮ সালে ঢাকা শহরের বণিকদের মধ্যে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন; মুসলমান ও খ্রিষ্টান ছিলেন মাত্র চার-পাঁচজন করে। সে সময় আজকের মতো প্রতিটি ঘরে কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য মুসলমান সমাজে ছিল না। অধ্যাপক আবদুল গফুর তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘আমার কালের কথা’য় লিখেছেন, ‘কোরবানির ঈদ বা অন্য কোন বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া সাধারণত গরু বা বকরি জবাই করা হতো না। হাট–বাজারে গরু বা ছাগলের মাংসও এভাবে বিক্রি হতো না তখন। বাড়িতে মেহমান এলে সাধারণত মুরগী জবাই করেই তাদের আপ্যায়ন করা হতো।’
হিন্দু জমিদারপ্রধান এই অঞ্চলে গরু কোরবানি নিয়ে একটি বৈরী মনোভাব বিদ্যমান ছিল। ফলে মুসলমানদের প্রায়ই ছাগল (বকরি) কোরবানির দিকেই ঝুঁকতে হতো। রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব তখন ততটা গুরুত্ব পেত না। তার একটি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ১৮৯০ সালের ঢাকা প্রকাশ-এ ছাপা সরকারি ছুটির তালিকায়—যেখানে হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিষ্টান—এই তিন সম্প্রদায়ের জন্য ঘোষিত মোট ১৮ দিনের ছুটির মধ্যে মুসলমানদের ভাগে এসেছিল মাত্র ৩ দিন: মহররম উপলক্ষে দুই দিন এবং ঈদুল আজহা উপলক্ষে এক দিন।
সাপ্তাহিক ঢাকা প্রকাশ পত্রিকা, ০২ ফেব্রুয়ারি ১৮৯০