‘প্রতিবার ঈদ আইলে আমার ছেলেডা ঢাকা থেইকা বাড়ি আসত। আমাগো সবার জন্য কাপড়চোপড় আনত। মায়ের হাতের সেমাই-খিচুড়ি খাইতে খুব পছন্দ ওর। আন্দোলনে গিয়া পুলিশের গুলিতে মইরা গেল সে। তাঁর লাশটা এহনো খুঁইজা পাইলাম না। হুনছি, বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন অইছে। তাঁর মরণের পর আমাগো সব শেষ। ছেলে নাই, এহন আমাগো ঈদ-চাঁনও নাই।’

কান্নাভেজা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন সবুজ ব্যাপারী। তিনি গত বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে নিহত পারভেজের (২৩) বাবা। গত জুলাইয়ে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন পারভেজ (২৩)। আজ শুক্রবার দুপুরে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে এসব কষ্ট ও হতাশার কথা জানান সবুজ ব্যাপারী।

পারভেজের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার পূর্ব ফতেপুর ইউনিয়নের বারহাতিয়া গ্রামে। তিনি রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় একটি আসবাবের দোকানে মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন। কাজের সুবাদে সেখানে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে পারভেজ বড়। সবুজ ব্যাপারী আগে লঞ্চে শ্রমিকের কাজ করতেন। এখন গ্রামে ছোট্ট চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন।

গত বছরের ১৯ জুলাই দুপুরে পারভেজের এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিবারের সদস্যেরা জানতে পারেন যে তিনি পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গেও তাঁর মরদেহটি পাননি। সেখান থেকে জানানো হয়, পারভেজের লাশটি শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর কবর এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। আক্ষেপ করে সবুজ ব্যাপারী জানান, ছেলের লাশটিও দেখতে পারলেন না। তাঁর আয়েই সংসারের পাশাপাশি ছোট দুই মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চলত। এখন সব শেষ।

ঈদ এলেও পারভেজের পরিবারের কারও মনে কোনো আনন্দ নেই বলে জানান সবুজ ব্যাপারী। তাঁর ভাষ্য, ঈদের সময় বাড়িতে ফিরে বাজার পারভেজই করতেন। ঈদের দিন সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করত। তাঁর মৃত্যুর পর এখন সবকিছুই স্মৃতি। ছেলেকে ছাড়া তাঁদের ঈদের আনন্দই মাটি। ছেলে বেঁচে নেই, ঈদ-চান দিয়ে কী হবে। ছেলেকে ছাড়া ঈদের সেমাই মুখে তুলবেন কীভাবে?

পারভেজের কলেজপড়ুয়া বোন ঝুমুর আক্তার বলেন, ‘ভাই ছাড়া ঈদ কল্পনাও করতে পারি না। আগে ঈদের সব আনন্দ ছিল ভাইকে কেন্দ্র করেই। এখন ভাই নাই, আমাগো ঈদও নাই। সব ফিকে, সব মাটি।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সব জ ব য প র

এছাড়াও পড়ুন:

রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে আরাকান আর্মি: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও গুরুতর নিপীড়ন চালাচ্ছে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) সোমবার এ কথা বলেছে।

এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এইচআরডব্লিউ বলেছে, রাখাইনে আরাকান আর্মির দখল করা এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গাদের চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। বাড়িঘর লুটপাট, নির্বিচারে আটক ও খারাপ আচরণ, বাধ্যতামূলক শ্রম এবং জোর করে বাহিনীতে ভর্তি করানোর মতো নানা নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। অন্যদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালিয়ে আসছে। জাতিবিদ্বেষের মতো চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধ এরই অংশ।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেছেন, ‘রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর যে ধরনের নিপীড়ন চালিয়ে আসছে, আরাকান আর্মিও ঠিক সে রকম দমননীতি অনুসরণ করছে। তাদের উচিত, এই বৈষম্যমূলক ও নিপীড়নমূলক আচরণ বন্ধ করে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা।’

২০২৩ সালের নভেম্বরে নতুন করে সংঘর্ষ শুরুর পর মিয়ানমারের জান্তা সরকারের কাছ থেকে কিছু এলাকা দখল করে নেয় আরাকান আর্মি। মানবাধিকার সংস্থাটি বলছে, তখন আরাকান আর্মি সেসব অঞ্চলে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে রোহিঙ্গারা বলেছে, তাদের জীবন এখনো কঠিন ও শৃঙ্খলিত। আরাকান আর্মি ও তাদের রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান বৈষম্যমূলক নীতি-বিধি ও চর্চা অব্যাহত রেখেছে।

‘অনুমতি ছাড়া আমাদের কাজ করা, মাছ ধরা, চাষাবাদ এমনকি চলাচলও নিষেধ ছিল। আমরা খাবারের তীব্র সংকটে ছিলাম। এ সময় অধিকাংশ মানুষ একে অপরের কাছে ভিক্ষা করে বেঁচে ছিলেন।’জুন মাসে বাংলাদেশে আসা ৬২ বছর বয়সী একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী

মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্যের বুথিডং উপজেলা থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১২ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। গত এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে এসব সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

জুন মাসে বাংলাদেশে আসা ৬২ বছর বয়সী একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী বলেছেন, ‘আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে জীবন অসম্ভব রকম কড়াকড়ির মধ্যে ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনুমতি ছাড়া আমাদের কাজ করা, মাছ ধরা, চাষাবাদ এমনকি চলাচলও নিষেধ ছিল। আমরা খাবারের তীব্র সংকটে ছিলাম। এ সময় অধিকাংশ মানুষ একে অপরের কাছে ভিক্ষা করে বেঁচে ছিলেন।’

এইচআরডব্লিউ বলছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির সংঘাতের মধ্যে আটকে পড়েছেন রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা। দুই পক্ষই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও বেআইনিভাবে বাহিনীতে ঢোকানোর মতো গুরুতর নির্যাতন চালিয়েছে।

২০২৩ সালের শেষ ভাগ থেকে রাখাইন ও চিন রাজ্যে চার লাখের বেশি মানুষ দেশের মধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আর এ সময় প্রায় ২ লাখ মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।

রোহিঙ্গা গ্রামবাসীরা সংস্থাটিকে বলেছেন, আরাকান আর্মি তাঁদের কৃষিজমি, বাড়িঘর, গবাদিপশু, মাছ ধরার সরঞ্জাম, জ্বালানির কাঠ এমনকি কবরস্থান পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে।

বুথিডংয়ের কিন টং গ্রামের দুই বাসিন্দা বলেন, মে মাসে তাঁদের কবরস্থানটি ধ্বংস করে দেয় আরাকান আর্মি। তাঁদের বলে, এখন থেকে ধানক্ষেতে মরদেহ দাফন করতে হবে।

এইচআরডব্লিউর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হয়ে লড়াই করার পর আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও অন্যান্য রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী আবারও রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়িয়েছে।

বুথিডংয়ের কিন টং গ্রামের দুই বাসিন্দা বলেন, মে মাসে তাঁদের কবরস্থানটি ধ্বংস করে দেয় আরাকান আর্মি। তাঁদের বলে, এখন থেকে ধানক্ষেতে মরদেহ দাফন করতে হবে।

মানবাধিকার সংস্থাটি মনে করে, যুদ্ধ এবং রোহিঙ্গা গ্রামবাসীদের জোর করে বাহিনীতে ভর্তি করানোর ফলে মুসলিম রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধ রাখাইনদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আরও তীব্র হয়েছে।

সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০২৪ সালের মে থেকে এখন পর্যন্ত কক্সবাজারের রোহিঙ্গাশিবিরে নতুন করে অন্তত ১ লাখ ২০ হাজার শরণার্থী নিবন্ধিত হয়েছেন। সম্প্রতি আসা রোহিঙ্গারা কোনো সরকারি ত্রাণ বা সহায়তা না পাওয়ার কথা বলেছেন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ মনে করে, সংকট সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো। তবে জাতিসংঘ ও উদ্বিগ্ন দেশগুলোর উচিত জোর দিয়ে বলা যে নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের কোনো পরিবেশ এখন নেই।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে আরাকান আর্মি: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
  • ফেনীতে ট্রাকের পেছনে মাইক্রোবাসের ধাক্কা, দর্জি নিহত