ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য গঠিত জাতিসংঘের সহায়তা সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ মনে করে, ‘গাজায় মানবিক সহায়তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল। এতে ভয় ও দুর্দশা বাড়ছে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের। চলমান ত্রাণ ব্যবস্থায় অরাজকতা ও সম্পদের অপচয় হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।

গাজায় সম্পূর্ণ অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে জাতিসংঘকে আবারও সম্পূর্ণরূপে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার অনুরোধও করেছে ইউএনআরডব্লিউএ। এর মধ্যেই আবারও গাজায় নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচারে গুলি ও গোলাবর্ষণ শুরু করেছে ইসরায়েল।  খাবার ও ওষুধ সংগ্রহ করতে আসা মানুষদের লক্ষ্য করে শনিবার চালানো হামলায় প্রাণ গেছে অন্তত ২৩ জনের। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। 

স্থানীয় সূত্রের বরাতে সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই জানিয়েছে, গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) খাবার ও ওষুধ বিতরণ কেন্দ্রে জড়ো হওয়া মানুষের ওপর গুলি চালায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। 

জাতিসংঘের মানবিক বিষয় সমন্বয় কার্যালয়ের (ওসিএইচএ) মুখপাত্র জেনস লার্কে বলেন, ‘জিএইচএফ যা করার কথা ছিল, তা করতে পারছে না। কারণ, মানবিক কার্যক্রম মানে হচ্ছে, নিরাপদ পরিবেশে অভাবগ্রস্ত মানুষকে খাবার ও ওষুধ দেওয়া।’

এদিকে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রান্সেস্কা আলবানিজ বলেছেন, ‘গাজায় যা হচ্ছে তা সম্পূর্ণরূপে গণহত্যার সমান। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল গাজার বেশির ভাগ অংশকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে এবং এটি ফিলিস্তিনি জনগণকে সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করার পরিকল্পনার অংশ।’ তিনি আরও লেখেন, ‘প্রতি মুহূর্তে নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে, যাদের বেশির ভাগই শিশু।’ 
আলবানিজ সমালোচনা করে বলেন, আন্তর্জাতিক মহল এই অভিযানকে ‘যুদ্ধ’ বলছে, যা সম্পূর্ণ ‘অগ্রহণযোগ্য’।

শুক্রবার ইরানের ওপর ইসরায়েল ব্যাপক হামলার পর জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোহান ওয়েডেফুলের মধ্যপ্রাচ্য সফরসূচিতে পরিবর্তন এসেছে। এ ছাড়া জাতিসংঘ ও সৌদি সরকারের উদ্যোগে প্যারিসে অনুষ্ঠেয় ফিলিস্তিনবিষয়ক সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। কারণ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। 

তবে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের অগ্রগতিতে  ফ্রান্সের অঙ্গীকার অটুট রয়েছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল ইসর য় ল

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল

যখন কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, তখন তা শুধু ক্ষুধার নয়, বরং সমাজের ভাঙনেরও প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এ অবস্থায় মানুষ আবর্জনার স্তূপ থেকে খাবার খুঁজে আনে। কেউ গোপনে রান্না করে; কেউ আত্মীয়দের থেকে খাবার লুকিয়ে রাখে, কোনো পরিবার হয়তো খাবারের জন্য তাদের দাদিমার গয়না বিক্রি করে দেয়।

দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মুখে কোনো অনুভূতি থাকে না। তাদের চোখে থাকে ফাঁপা দৃষ্টি। মানুষ পশুর মতো খাবারের জন্য লড়াই করে। এটিই হলো সামাজিক অবক্ষয় ও অপমানের চরম রূপ। এটিই হলো মানবিক মর্যাদার বিলোপ। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজকের গাজাবাসী যাচ্ছে। 

গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফ নামে একটি নতুন সংস্থা (যেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে মে মাসে যাত্রা শুরু করে) নিজেদের কার্যক্রমকে একুশ শতকের আধুনিক ও সহানুভূতিশীল সংস্থা বলে দাবি করছে। তারা বলছে, তাদের চারটি ‘নিরাপদ বিতরণ কেন্দ্র’ থেকে তারা প্রতিদিন ২০ লাখের বেশি প্যাকেট খাবার বিতরণ করছে। সেখানকার ছবিতে দেখা যায়, বাচ্চাদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন সংস্থার কর্মীরা।

আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি। 

ইসরায়েলি মুখপাত্ররা বলছেন, জাতিসংঘের ট্রাকগুলো গাজার সীমানার ভেতরে আছে কিন্তু জাতিসংঘ নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বিতরণ করছে না। কিন্তু এ বক্তব্য খুব সহজ বিশ্লেষণেই ভেঙে পড়ে। 

প্রথমত, সংখ্যা ঠিক মিলছে না। গত এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা হিসাব করে জানায়, ১৮ মাসের অবরোধ ও যুদ্ধের পর এবং দুই মাসের পূর্ণ ইসরায়েলি অবরোধের ফলে মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে গাজায় জীবন বাঁচানোর জন্য যে পরিমাণ খাবার দরকার, তার অর্ধেকের নিচে নেমে যাবে। অর্থাৎ গাজার সব মানুষের খাদ্যের পুরো চাহিদা পূরণ করতে হবে এই ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিদিনের ২০ লাখ প্যাকেট খাবার গাজার প্রয়োজনের অর্ধেকও নয়। 

আরও পড়ুনইসরায়েল কেন গাজায় অস্ত্রধারী গুন্ডা পোষে ১১ জুন ২০২৫

দ্বিতীয়ত, শুধু সংখ্যায় খাবার পৌঁছালেই দুর্ভিক্ষ বন্ধ হয় না; দুর্ভিক্ষ আঘাত করে সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলোর ওপর। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, যখন ২০ শতাংশ পরিবার মারাত্মক খাদ্যসংকটে পড়ে, তখন সেটিকে ‘দুর্ভিক্ষ’ বলা যায়। এ অবস্থায় নারীরা, বিশেষ করে যাঁদের স্বামী নেই এবং যাঁদের অনেক শিশু বা বয়স্ক অভিভাবক আছেন, তাঁরাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন। সেসব পরিবারকে চিনে ত্রাণ পৌঁছানোই আসল কাজ। 

জিএইচএফ গাজায় চারটি বিতরণ কেন্দ্র চালায়—তিনটি রাফার ধ্বংসস্তূপে, আরেকটি গাজার মাঝখানে। সব কটিই সামরিক এলাকায়। এরা খুব অল্প সময়ের জন্য এবং খাবার বিতরণের খুব অল্প আগে সবাইকে জানিয়ে খোলে। মানুষ ধ্বংসস্তূপে শিবির করে বসে থাকে, কখন দরজা খুলবে সেই আশায়। তারা জানে, ইসরায়েলি সেনারা ভিড় সামলাতে গুলি চালাতে দ্বিধা করে না। যেসব দুর্বল মা, বয়স্ক মানুষ বা প্রতিবন্ধী এই দৌড়ে অংশ নিতে পারেন না, তাঁরা কীভাবে খাবার পাবেন? 

আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১২ এপ্রিল ২০২৫

তৃতীয়ত, মানুষের বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী ত্রাণ দেওয়া দরকার। যেমন অপুষ্ট শিশুদের জন্য দরকার বিশেষ ধরনের খাবার (যেমন ‘প্লাম্পিনাট’, যা সাধারণ খাবার খেতে না পারা শিশুর জন্য তৈরি) দেওয়া দরকার। কিন্তু জিএইচএফের বক্সে থাকে ময়দা, পাস্তা, তেল, চাল, ডাল, তাহিনি (তিলবীজ থেকে তৈরি একধরনের মাখনবিশেষ)। জিএইচএফের ত্রাণের মধ্যে কোনো শিশুখাদ্য বা প্লাম্পিনাট নেই। কোনো প্রশিক্ষিত নার্স বা পুষ্টিবিদও নেই, যাঁরা অপুষ্ট শিশুদের সেবা দিতে পারেন। 

আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি। 

অ্যালেক্স ডি ওয়াল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক

দ্য গার্ডিয়ান, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ত্রাণ বিতরণে ইসরায়েলের ওপরই ভরসা ট্রাম্পের
  • গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল