ইসরায়েলের হামলার জবাবে ইরান শক্ত হামলা অব্যাহত রেখেছে। দেশটি ইসরায়েলে ঝাঁকে ঝাঁকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন পাঠাচ্ছে। এতে হতাহত হচ্ছে ইসরায়েলিরা। তেল আবিবেও এখন গাজার মতো পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। ইরানের এ অনড় অবস্থানে ইসরায়েলের সামনে যুদ্ধ থেকে বের হওয়ার পথ নেই। এ অবস্থায় সংঘাত অবসানের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে বলা যায়। ফলে অন্তহীন এক যুদ্ধের ঝুঁকিতে পড়ে গেছে ইসরায়েল। সিএনএনের এক বিশ্লেষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে।    

ইরানের ওপর ইসরায়েলের প্রথম ধাপের হামলায় ব্যাপক সাফল্য আসে। ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করতে সমর্থ হয় তারা। কিন্তু সপ্তাহ শেষে যুদ্ধের চিত্র খানিকটা বদলে গেছে। ইরানের তীব্র প্রতিরোধের মুখে ইসরায়েল উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য অর্জনে সফল হবে কিনা, সেই চিন্তা এখন তাদের বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে ইরান না থামলে কিংবা পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে চুক্তি না হলে যুদ্ধ চালিয়েই যেতে হবে।
যুদ্ধক্ষেত্রে ইসরায়েল এখনও অপ্রতিরোধ্য। প্রথম ধাপে তারা বিনা বাধায় ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানে। তবে ইরানের পাল্টা হামলায় ইতোমধ্যে কয়েক ডজন ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অসংখ্য নাগরিক। দুই পক্ষই নিরন্তর হামলা অব্যাহত রেখেছে।  

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে রক্ষায় সহায়তা দিলেও এখনও সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েল আরও আতঙ্কের মধ্যে পড়ে গেছে। তেহরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের চূড়ান্ত ফল কী হবে, সে বিষয়টি এখন পুনর্মূল্যায়ন করতে হচ্ছে তাদের।   
ইসরায়েলি একটি সূত্র সিএনএনকে জানিয়েছে, নাগরিকরা মনে করেন, সামরিক নয়, যুদ্ধ শেষ হবে কূটনৈতিক পদক্ষেপে। তারা আশা করছে, চলমান সামরিক পদক্ষেপ ইরানকে ভবিষ্যতে পারমাণবিক আলোচনায় বসতে বাধ্য করবে। তারা পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে নমনীয় হবে; ঠিক যেমনি গাজায় চাপের মুখে পড়েছে হামাস। 

ইসরায়েলি এক কর্মকর্তা বলেন, ইসরায়েল শুরু থেকে কয়েকটি লক্ষ্য সামনে রেখে হামলা করছে। নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা হলো, ইরানকে পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে পিছু হটানো। তা ছাড়া ইরানি সরকারের পরিবর্তন ঘটানোও যুদ্ধের একটা বড় লক্ষ্য। একইভাবে ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকি স্থায়ীভাবে অপসারণ করার লক্ষ্যও রয়েছে তেল আবিবের। এগুলো পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। 
ইসরায়েল যুদ্ধের মাত্রা বাড়াতে চায়। এজন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পেতে চাইছে। এ বিষয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে তারা আলোচনা করেছে। কিন্তু ট্রাম্প এখনই মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধে জড়াতে অনীহা দেখিয়েছেন। সহিংসতা থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন।

এক মার্কিন কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেছেন, ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার ইসরায়েলি পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, সংঘাতে জড়ানো নয়, ওয়াশিংটন সংঘাতের অবসান ঘটাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। 

ট্রাম্প গত রোববার ট্রুথ সোশ্যালে পোস্ট করেন, ‘ইরান ও ইসরায়েলকে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো উচিত। যেমন আমি ভারত-পাকিস্তানকে করতে বলেছিলাম।’ কিন্তু কূটনৈতিক পদক্ষেপের চেয়ে ইসরায়েলের এখন সরাসরি মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ বেশি দরকার। কারণ ইসরায়েল বুঝে গেছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির স্থায়ী ক্ষতি করা খুবই কঠিন। উত্তর ইরানের ফোরডো পারমাণবিক স্থাপনাটি খুবই সুরক্ষিত। এটি আধামাইল মাটির নিচে, পাহাড়ের তলদেশে অবস্থিত। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া ইসরায়েল এই স্থাপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।  
ইসরায়েলি কৌশলের আরও একটি ত্রুটি রয়েছে। তা হলো প্রতিটি পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করা হলেও পুনরায় নির্মাণের প্রযুক্তিগত জ্ঞান ইরানের হাতে রয়েছে। এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ইরান যদি টিকে থাকতে পারে, তাহলে পারমাণবিক সক্ষমতায় দেশটি নতুন গতিশক্তি লাভ করবে। ভবিষ্যতের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে তেহরান আরও বেশি টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জন করবে। এ বিষয়টিও নেতানিয়াহুকে ভাবিয়ে তুলেছে। এজন্য বারবার ইরানে সরকার পরিবর্তনের কথা বলছেন তিনি।  

তবে ইসরায়েলের এ পরিকল্পনা বাস্তবে দেখা যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। কারণ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সরকারবিরোধী অনেক ইরানি এখন ইসরায়েলকে আরও বেশি ঘৃণা করে। হামলা করায় তারা ইসরায়েলের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ। এর পরও ইসরায়েল স্বপ্ন দেখছে, ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ জেগে উঠবে। তারা পারমাণবিক আলোচনায় ট্রাম্পের শর্ত মানতে সরকারকে বাধ্য করবে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। এই অবস্থায় যুদ্ধের সমাপ্তি কত দূরে, তা জানা নেই কারও।      

লেখক: ম্যাথিউ চান্স, সিএনএনের গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স করেসপন্ডেন্ট 
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল ইসর য় ল র লক ষ য সরক র অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা রক্ষা বাঁধের আরও ২০০ মিটার বিলীন

পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা রক্ষা বাঁধের আরও ২০০ মিটার অংশ পদ্মায় বিলীন হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল শুক্রবার বাঁধটির ওই অংশ নদীতে বিলীন হয়। এ সময় নদীগর্ভে চলে গেছে বাঁধের পাশে থাকা ২০টি বসতবাড়ি। আর ভাঙন আতঙ্কে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ৫০টি বাড়ির বসতঘর ও বিভিন্ন স্থাপনা। এ নিয়ে ৬ দফায় বাঁধটির ৮০০ মিটার পদ্মায় বিলীন হয়ে গেল।

ভাঙন রোধে গত তিন মাসে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উদ্যোগে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১ লাখ ৫৫ হাজার বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছিল। ভাঙনের কারণে তা–ও নদীতে তলিয়ে গেছে। বাঁধের ওই ৮০০ মিটার অংশের পাশে থাকা ৩৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ৫০টি বসতবাড়ি গত দুই মাসে বিলীন হয়েছে। ভাঙন বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনটি গ্রামের ৬০০ পরিবার এবং মঙ্গল মাঝি-সাত্তার মাদবর ঘাট ও বাজারের ২৪০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ঝুঁকিতে পড়েছে।

শরীয়তপুর পাউবো ও স্থানীয় সূত্র জানা যায়, শরীয়তপুরের পদ্মা নদীর অংশ জাজিরার নাওডোবা এলাকা থেকে শুরু হয়েছে। পদ্মা সেতু নাওডোবার ওপর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে পদ্মা নদীর ৫০০ মিটারের মধ্যে সার্ভিস এরিয়া ২, সেনানিবাস, পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এসব অবকাঠামো নির্মাণের জন্য যখন জমি অধিগ্রহণ করা হয়, তখন ২০১২ সালের দিকে নাওডোবা এলাকায় পদ্মার ভাঙন শুরু হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা নদীভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য তখন সেতু থেকে ভাটির দিকে (পূর্ব দিকে) দুই কিলোমিটার এলাকায় ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। ওই বাঁধের পাশে (দক্ষিণ দিকে) আলাম খাঁরকান্দি, ওছিম উদ্দিন মাদবরকান্দি, উকিল উদ্দিন মুন্সিকান্দি এবং মঙ্গল মাঝি-সাত্তার মাদবর ঘাট ও বাজার অবস্থিত।

পাউবো সূত্র বলছে, গত বছর নভেম্বর মাসে জাজিরার নাওডোবা জিরো পয়েন্ট এলাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা রক্ষা বাঁধের ১০০ মিটার অংশে ভাঙন দেখা দেয়। এরপর এ বছর ৭ জুন আবার বাঁধের ১০০ মিটার, ৭ জুলাই ২০০ মিটার, ৯ জুলাই ১০০ মিটার, ২৩ জুলাই ১০০ মিটার অংশ ভেঙে নদীতে ধসে পড়ে। বৃহস্পতি ও শুক্রবার ওই বাঁধের আরও ২০০ মিটার অংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন ঠেকাতে অস্থায়ী ভিত্তিতে ৬০০ মিটার অংশে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলছে পাউবো। এ পর্যন্ত ওই এলাকায় ১ লাখ ৫৫ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। তাতে ব্যয় হয়েছে ৭ কোটি টাকা। তাও কোনো কাজে লাগেনি। ভাঙনের কারণে ওই জিও ব্যাগগুলো নদীতে তলিয়ে গেছে। ওই এলাকা দিয়ে নদী অন্তত ১০০ মিটার হতে ১৫০ মিটার ভেতরে (দক্ষিণ দিকে) প্রবেশ করেছে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে পদ্মার ভাঙনে আলম খাঁরকান্দি এলাকার আবুল বাশার মাদবরের দুটি ঘরসহ বসতবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। ঘরের অবশিষ্ট জিনিসপত্র তিনি সড়কের পাশে স্তূপ করে রেখেছেন। আবুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মা তীরে বাড়ি হওয়ায় তিন দফা ভাঙনের কবলে পড়েছি। পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় বাড়ির সঙ্গে বাঁধটি হওয়ায় ভেবেছিলাম আর কখনো ভাঙনে নিঃস্ব হতে হবে না। কিন্তু তা আর হলো না, আমার সব শেষ। এখন বেঁচে থাকার জন্য আর কিছুই রইল না। উদ্বাস্তু হয়ে রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছি।’

ভাঙন আতঙ্কে গতকাল শুক্র ও আজ শনিবার তিনটি গ্রামের ৫০টি বসতবাড়ির বিভিন্ন স্থাপনা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আলী হোসেন মাদবর নামের একজন শনিবার সকাল থেকে দুটি বসতঘর ভেঙে মালামাল সরাচ্ছিলেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ভাঙনের কারণে একটু দুশ্চিন্তায় ছিলাম। রাতে আতঙ্কে ঘুমাতে পারতাম না। এখন আর পদ্মা পারে থাকতেই পারলাম না। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ফেলে ঘর নিয়ে চলে যাচ্ছি। জানি না কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেব।’

শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তারেক হাসান প্রথম আলোকে জানান, নদীতে অনেক স্রোত। ভাঙন ঠেকাতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে, তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। ভাঙনের কারণে বালুভর্তি জিও ব্যাগ নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে। জাজিরার ওই স্থানে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করা হবে। সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক তাহসিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদীভাঙনের শিকার হয়ে মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে, এটা কষ্টদায়ক। আমরা ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর নির্মাণের জন্য টিন, নগদ টাকা ও খাদ্য সহায়তা দিয়েছি। যাঁরা ভিটেমাটি হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়েছেন, তাঁদের পুনর্বাসন করার জন্য খাসজমি খোঁজা হচ্ছে। সেই জমিতে তাঁদের ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হবে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ