শরণার্থীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে জাতিসংঘ ২০০১ সাল থেকে প্রতিবছর ২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালন করছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সলিডারিটি উইথ রিফিউজিস তথা শরণার্থীদের সঙ্গে সংহতি’। এটি শরণার্থীদের অধিকার, মর্যাদা, জীবিকা ও প্রত্যাবাসন বিষয়কে গুরুত্ব দেয়। শরণার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৫১ সালে জাতিসংঘ রিফিউজি কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়, যদিও তখনকার উদ্যোগ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়া ইউরোপীয় শরণার্থীদের স্বার্থকেন্দ্রিক। ১৯৬৭ সালে একটি প্রটোকল স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই কনভেনশনকে সর্বজনীন করা হয়।
কনভেনশন অনুসারে শরণার্থীরা ১০টি অধিকারভোগী– বহিষ্কৃত না হওয়া; অনুপ্রবেশের জন্য শাস্তিভোগ না করা; কাজ করার অধিকার; আশ্রয়, শিক্ষা, ত্রাণ ও সহযোগিতাপ্রাপ্তি; ধর্ম পালনের স্বাধীনতা; আইনগত সুবিধা; দেশের অভ্যন্তরে অবাধ চলাচল সুবিধা এবং পরিচিতি ও ভ্রমণ দলিলপ্রাপ্তি। বাংলাদেশ রিফিউজি কনভেনশন ও প্রটোকলে স্বাক্ষর করেনি বিধায় এর কিছু শর্ত মানতে বাধ্য নয়।
বিশ্বের সর্বাধিক শরণার্থী আশ্রয়দাতা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ইরান (৩৫ লাখ), তুরস্ক (২৯ লাখ), কলম্বিয়া (২৮ লাখ), জার্মানি (২৭ লাখ) ও উগান্ডা (১৮ লাখ)। বাংলাদেশও ২০১৬-১৭ থেকে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে অনুপ্রবেশকারী ৭ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে, যারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্প এবং ভাসানচরে অবস্থান করছে। এ ছাড়া ১৯৯১-৯২ সময়ে অনুপ্রবেশকারী ২ লাখ ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা একটা উল্লেখ্যযোগ্য অংশ এখনও ক্যাম্পে অবস্থান করছে। এর সঙ্গে প্রতিবছর গড়ে ৩৫ হাজার নতুন জন্মসহ সব মিলিয়ে রোহিঙ্গার বর্তমান সংখ্যা ১৩ লক্ষাধিক বলে উল্লেখ করা হয়।
শরণার্থীরা এক মানবেতর জীবন বয়ে চলে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক কার্যক্রম এবং পাকিস্তানের কোয়েটায় আফগান শরণার্থী ক্যাম্পে আমার কাজের অভিজ্ঞতায় শরণার্থীদের দুরবস্থা কাছে থেকে অনুধাবন করেছি। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবর্জিত ও মনো-সামাজিক অধিকারবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের অলস ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আমার মতো অনেককেই ব্যতীত করেছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ দ্বদ্ব ও দুর্যোগ পরিস্থিতিতে তহবিল সংকটের কারণে শিশুসহ সব বয়সের শরণার্থীর পুষ্টি চাহিদা পূরণ বাস্তবিক কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে স্বীকৃত। ইউএনএইচসিআর বলছে, গত এক দশকে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ। অথচ সংস্থাটির মানবিক তহবিল এখনও ২০১৫ সালের মতো রয়ে গেছে। ফলে চলমান ব্যয় সংকোচন শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুতদের আরও ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
শরণার্থীদের আশ্রয় দানকারী দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাও এক বাস্তবতা। পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, স্থানীয়-বহিরাগত দ্বন্দ্ব, এমন অনেক ঘটনা ঘটে। রোহিঙ্গা অবস্থানের ফলে বাংলাদেশও এমন অনেক অভিজ্ঞতার শিকার। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ও বাইরে প্রায়ই সহিংসতা ও সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। ক্যাম্পের বাইরে স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘাত, চোরাচালানে সহযোগিতা, অবৈধভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দুর্নাম ঘটাচ্ছে। জানা যায়, ৩৩টি ক্যাম্পে অন্তত ১২টি রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপ রয়েছে। বুধবার প্রকাশিত আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের এসব সশস্ত্র গ্রুপ আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধ করতে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে সদস্য সংগ্রহ করছে। এ উদ্যোগ চলমান থাকলে ক্যাম্পের নিরাপত্তা পরিবেশ বিঘ্নিত হবে এবং স্থানীয় পরিবেশ অশান্ত করবে। কেননা, ধরে নেওয়া যায় এর সঙ্গে স্থানীয় স্বার্থান্বেষী মহলও সম্পৃক্ত হবে। অন্যদিকে তহবিল সংকটের কারণে রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য ক্রমশ সীমিত হচ্ছে। ৯ জুন ইউনিসেফ সংবাদ সম্মেলনে জানায়, তহবিল সংকটের কারণে ১ হাজার ১৭৯ জন স্থানীয় শিক্ষককে বাদ দেওয়া হচ্ছে। ফলে ৪ সহস্রাধিক লার্নিং সেন্টার বন্ধ হয়ে যাবে এবং ২ লাখ ৩০ হাজার শিশু শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
শরণার্থী দিবসের প্রাক্কালে জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেছেন, ‘আমরা এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক অস্থির সময়ে বাস করছি, যেখানে আধুনিক যুদ্ধ এক ভঙ্গুর ও মর্মান্তিক মানবিক সংকট তৈরি করেছে। শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য শান্তিপূর্ণ ও টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে আমাদের আরও বেশি প্রচেষ্টা দরকার।’
গ্রান্ডির এই আহ্বান প্রসারিত না হতেই শুরু হয়েছে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ। ইতোমধ্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট তেহরানের জনগণকে রাজধানী ছাড়তে বলেছেন। ইরানও তেল আবিব এবং হাইফারের বেসামরিক জনগণকে নিরাপদ স্থানে সরতে বলেছে। এ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী ও বিধ্বংসী হলে শরণার্থীর সংখ্যা কোথায় দাঁড়াবে, অনুমান করা কঠিন নয়।
যুদ্ধ কোনো সমাধান বয়ে আনে না– এ অমর সত্য বিশ্বের সব পক্ষ বিশ্বাস করলেও যুদ্ধকে জিইয়ে রাখতে যেন চেষ্টার অন্ত নেই। কারণ যুদ্ধ যত প্রলম্বিত হবে যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে বাণিজ্য তত রমরমা হবে। পাশাপাশি সংলাপের নামে মারণাস্ত্র উৎপাদকদের দৌড়ঝাঁপ চলবে। তাই বিশ্বে যুদ্ধ যেমন থামছে না, তেমনি শরণার্থী সমস্যাও রয়ে যাচ্ছে সমাধানের অন্তরালে। ইউএনএইচসিআর বলছে, গত এক দশকে প্রতিবছর শরণার্থী বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার প্রধান কারণ বিভিন্ন দেশে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ও সংঘাত এবং তা থামাতে বৈশ্বিক ব্যর্থতা। তাই তো গেল শতকের নব্বই দশক থেকে শুনছি আফগান শরণার্থীর করুণ কাহিনি। আফ্রিকার শরণার্থী প্রসঙ্গ তারও আগে থেকে। আর এ শতকে শান্ত মধ্যপ্রাচ্যেও শরণার্থীর ভিড় কেবলই বাড়ছে। সব রাষ্ট্রের অভিভাবক জাতিসংঘ অথবা আঞ্চলিক জোটগুলো (ইইউ, আরব লিগ, আফ্রিকান জোট, আসিয়ান ইত্যাদি) যেন শুধু প্রস্তাব পাস আর বিবিৃতি দিয়েই তাদের দায়িত্ব পালন করছে। তাই প্রয়োজন এখন সত্যিকার ভূরাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর সংলাপ এবং আন্তর্জাতিক আইন অথবা কনভেনশন প্রতিপালনে দৃঢ় অঙ্গীকার। তবেই সম্ভব হবে বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সমস্যার সমাধান এবং তাদের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করা, যা কিনা বিশ্ব শরণার্থী দিবসের তাৎপর্য।
এম এ হালিম: সাবেক পরিচালক,
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: দ বস শরণ র থ দ র র শরণ র থ শরণ র থ র কনভ নশন ন করছ তহব ল
এছাড়াও পড়ুন:
সত্য আড়াল করার চেষ্টা ছিল
সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে—এ সত্য আড়াল করার চেষ্টা ছিল পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) বেশির ভাগ গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। এর পরিবর্তে ছাত্র-জনতাকে ‘স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী’ এবং আন্দোলনকে ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা ছিল।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোর ভাষায় ‘উসকানি’, ‘দুষ্কৃতকারী’ ও ‘বিরোধী চক্রান্ত’—এ ধরনের শব্দ বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার যেসব যুক্তি দিত এবং যে ভাষায় কথা বলত, তার প্রতিফলন দেখা গেছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোতে।
গণ-অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক এসবির ১৬টি প্রতিবেদন নানা মাধ্যমে পেয়েছে প্রথম আলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি এসবির প্রতিবেদনে সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) নেতা-কর্মীদের মারমুখী ভূমিকা ও অস্ত্রবাজির বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। উল্টো আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে তৎকালীন সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এর পাশাপাশি সরকারের পক্ষে যাতে সংবাদমাধ্যমগুলো জনমত তৈরি করে—এমন পরামর্শও দিয়েছিলেন এসবির গোয়েন্দারা।
যেমন গত বছরের ৪ আগস্ট এসবির গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের দলবদ্ধভাবে ও অধিক সংখ্যায় অবস্থান নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। ৩১ জুলাইয়ের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের মাঠে সরব উপস্থিতি নিশ্চিত করার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
এসবির মাধ্যমেই পুলিশ দেশের সামগ্রিক চিত্র, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ধরনের গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে। এসবির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনগুলো প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে যায়। এ জন্য সরকার অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পাশাপাশি এসবির গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
ওই সময়কার গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো গত জুন ও জুলাই মাসের শুরুর দিকে বিশ্লেষণ করেছে এসবির বর্তমান প্রশাসন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসবির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে রাজনৈতিক ইন্ধনপ্রাপ্ত, বিএনপি-জামায়াতের সরকার পতনের ষড়যন্ত্র—এভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আন্দোলনের মূল দাবির জায়গা বা ছাত্রসমাজের ন্যায্য ক্ষোভের যৌক্তিকতার চেয়ে নাশকতা-সহিংসতার আশঙ্কা, সরকারি স্থাপনায় আক্রমণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের নিরাপত্তা—এসবে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে।
এসবির বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়েছে, সংলাপ, আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বা দাবির ন্যায্যতা তুলনামূলকভাবে কম এসেছে ওই সময়ের গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোতে। কিছু ক্ষেত্রে আলোচনাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হলেও সেটি আন্দোলন দমন বা নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে এসেছে। এ ছাড়া প্রতিবেদনগুলোতে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকারের গুরুত্ব, জনগণের ক্ষোভ বা সমবেদনার জায়গা উপেক্ষিত হয়েছে।
এসবির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, ওই সময়কার গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোতে আন্দোলন চলাকালে বিপরীত বয়ান (কাউন্টার ন্যারেটিভ) তৈরির পরামর্শও দেওয়া হতো। ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’ গড়ে তোলার জন্য তৎকালীন সরকার যাতে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে, সে সুপারিশ ছিল।
এসবির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে ওই সময়ের গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোতে প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করায় বাস্তব পরিস্থিতি মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছিলেন তৎকালীন কর্মকর্তারা। পেশাদারত্বের সঙ্গে নির্মোহভাবে কাজ না করলে তা কারও জন্যই সুফল বয়ে আনে না।’
এসবির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, ওই সময়কার প্রতিবেদনগুলোতে মাঠের বাস্তবতা উপেক্ষিত হয়েছে।
শেষ দিকে শঙ্কায় ছিলেন গোয়েন্দারাএসবির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, তৎকালীন সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দমননীতির কারণে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দ্রুত ব্যাপকতা লাভ করে। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি, পেশাজীবী, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সর্বস্তরের মানুষ তাতে যুক্ত হন। পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দ্রুতই আন্দোলনে নতুন নতুন শ্রেণি ও শক্তি যুক্ত হয়।
কিন্তু তৎকালীন গোয়েন্দারা আন্দোলনের ব্যাপকতার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে আন্দোলনকারীদের ‘বহিরাগত’, ‘রাজনৈতিক অপশক্তি’ এবং ‘স্বার্থান্বেষী মহল’ হিসেবে দেখার চেষ্টা করেছে।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে ‘গণভবন, বঙ্গভবন, সচিবালয়, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ইত্যাদি দখলের চেষ্টা হতে পারে’—এমন ইঙ্গিত ছিল ওই সময়কার গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।
গত বছরের ৫ জুন থেকে ২০ জুলাইয়ের প্রতিবেদনগুলো আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করেছে এসবির বর্তমান প্রশাসন। এতে দেখা যায়, ওই সময় গোয়েন্দাদের পর্যবেক্ষণ ছিল, আন্দোলন দমন না করলে এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি সুযোগ নিতে পারে। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ভূমিকা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন তখনকার গোয়েন্দারা।
গত বছরের ২১ জুলাই থেকে ৪ আগস্টের প্রতিবেদনগুলোতে গণগ্রেপ্তার ও দমননীতির বিষয়গুলো উঠে এসেছে। তবে ওই সময়ের প্রতিবেদনে পরিস্থিতি দ্রুত ‘গণ-অভ্যুত্থানে’ রূপ নিতে পারে, সরকার পতনের চেষ্টা হতে পারে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোবল ভেঙে যেতে পারে—এসব বিষয় স্পষ্টভাবে লেখা হয়েছে। শেষ দিকের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ক্রমে সরকারের পতনের এক দফা দাবিতে পরিণত হবে—এমন আভাস দেওয়া হয়েছিল।
একপেশে প্রতিবেদন, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বএসবির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, অধিকাংশ প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ, হতাহতের ঘটনা, গণগ্রেপ্তার, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া—এসব বিষয় খুব কমই গুরুত্ব পেয়েছে। আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীদের প্রতি প্রতিবেদনগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্পষ্টতই একপেশে।
এসবির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, অনেক প্রতিবেদনে আন্দোলনের প্রকৃত উৎস বা সাধারণ ছাত্রদের ক্ষোভকে সেভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। শুধু তা–ই নয়, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী, বিভিন্ন পেশাজীবী ও সাধারণ অভিভাবক—এসব গোষ্ঠীর ন্যায্য অংশগ্রহণকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। প্রকৃত সমস্যাকে আড়াল করার প্রবণতা থাকায় স্বতঃস্ফূর্ত গণ-আন্দোলনকে পুরোপুরি অনুধাবন করা যায়নি বলেও এসবির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের কোনো বিকল্প নেই। নিয়মনীতি মেনে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুলিশ বর্তমানে সচেষ্ট রয়েছে।’