অস্ত্র ঠেকিয়ে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন এমপি শিমুলের বেয়াই
Published: 8th, July 2025 GMT
নাটোরের সাবেক এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের এক আত্মীয়ের বিরুদ্ধে এক ব্যবসায়ীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মাহিদুর রহমান গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজশাহীর একটি রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলন করে এ অভিযোগ করেন।
মাহিদুর রহমানের অভিযোগ, সাবেক এমপি শিমুলের বেয়াই মীর হাবিবুল আলম বখতিয়ার নামের ওই ঠিকাদার পাথর নিয়ে তাঁকে প্রায় চার কোটি টাকা দিচ্ছেন না।
মাহিদুরের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সোনামসজিদে। তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম মেসার্স নয়ন এন্টারপ্রাইজ। সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে পাথর আমদানি করে ঠিকাদারদের কাছে সরবরাহ করতেন।
অভিযোগ থেকে জানা গেছে, মীর হাবিবুর কনস্ট্রাকশনের নির্বাহী পরিচালক মীর হাবিবুর আলম বখতিয়ারকে মাহিদুর রহমান ১৯ কোটি ৩৪ লাখ ১২ হাজার ৩৭৯ টাকার পাথর সরবরাহ করেন। লেনদেনের এক পর্যায়ে বখতিয়ার ৩ কোটি ৯৫ লাখ ১২ হাজার ৩৭৯ টাকা আর পরিশোধ করেননি।
টাকা চাইলে তাঁকে নাটোরে তাঁর কার্যালয়ে ডেকে নেন। সেখানে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে জিম্মি করেন। এর পর তিন-চারজন মিলে ভয় দেখিয়ে একটি ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। মাহিদুর সাধারণত যে স্বাক্ষর দিয়ে থাকেন, তা না দিয়ে শুধু নিজের নাম লিখে দিয়ে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসেন। পরে ওই স্ট্যাম্পে লেখা হয় যে, মাহিদুর তাঁর সব পাওনা বুঝে পেয়েছেন।
ওই ঘটনার পর মাহিদুর টাকার জন্য মোবাইল ফোনে বখতিয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। তিনি টাকা দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টাকা দেননি। মামলা করলে টাকা আদায়ে বিলম্ব হবে, তাই মামলা না করে মাহিদুর আপসে টাকা আদায়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে সেনাবাহিনী, রাজপাড়া থানা, সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের রাজশাহী অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর কাছেও অভিযোগ করেন। এদিকে ঠিকাদার বখতিয়ার আত্মগোপনে থেকে এখনও রাজশাহী সওজ থেকে কোটি কোটি টাকার কাজের বিল তুলে যাচ্ছেন। কিন্তু টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। এ সময় মাহিদুর বখতিয়ারকে ধরিয়ে দিতে ১ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে মাহিদুরের স্ত্রী ময়েদা বেগম ও ভাগনে জিল্লুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। ময়েদা বেগম বলেন, পাওনা টাকা না পেয়ে তারা ব্যাংক ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। এলাকায়ও অনেক পাওনাদার তৈরি হয়েছে। টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তাদের মাঠের জমিও দখল নিয়েছেন পাওনাদাররা।
এ বিষয়ে মীর হাবিবুর আলম বখতিয়ারকে ফোন করলে তিনি বলেন, মাহিদুর রহমানের সব টাকা চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে। তিনি
শেষে এসে ১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা পেতেন। কিন্তু দাবি করছেন ৪ কোটি টাকা। হিসাব করে পরে ৫০ লাখ করে চারটি চেকের মাধ্যমে ২ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এতদিন পরে এসে মিথ্যা অভিযোগ আনছেন।
সাবেক এমপি শিমুলের প্রভাব খাটানোর বিষয়ে তিনি বলেন, শিমুল আমার বড় ভাইয়ের শ্যালক। এ ঘটনা যখন ঘটে তখন তিনি দেশেই ছিলেন না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম হ দ র রহম ন বখত য় র
এছাড়াও পড়ুন:
রেকর্ড উৎপাদন, বেড়েছে মজুত, তবুও চালের বাজারে উত্তাপ
ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারি গুদামে উপচে পড়ছে চালের মজুত। বাজারে সরবরাহেও ঘাটতি নেই। তারপরও চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৪ থেকে ৫ টাকা। প্রশ্ন উঠেছে সরবরাহ ও মজুত থাকার পরও হঠাৎ চালের মূল্য বৃদ্ধির নেপথ্যে কারা?
চাষির ঘাম, সিন্ডিকেটের ফায়দা
সরকারি তথ্য বলছে, চলতি বোরো মৌসুমে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ১৪ লাখ টন। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আগের বছরের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে ১৫ লাখ টন। অথচ এই অর্জনের ফল ভোগ করছেন না প্রকৃত উৎপাদক।
নোয়াখালী জেলার কৃষক কালাম হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘ধান বিক্রি করছি মণপ্রতি ১১০০ টাকা। অথচ সেই ধানের চাল এখন কিনতে হচ্ছে ৮৫ টাকায়! আমরা দাম পাই না, আবার বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। লাভ করছে কারা?’’
আরো পড়ুন:
প্রশিক্ষণ শুধু পেশাগত জ্ঞান নয়, দায়িত্ববোধও বাড়ায়
খাদ্য বান্ধব কর্মসূচি শুরু হলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে: আলী ইমাম
ঝালকাঠির কৃষক জহর আলীরও একই প্রশ্ন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘‘ফসল ফলাই আমরা, কিন্তু বাজার চালায় অন্যেরা। আমাদের কথা কেউ শোনে না, ভাবেও না।’’
কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘সরবরাহে ঘাটতি নেই, বরং এবার সংগ্রহ অভিযানও নির্ধারিত সময়ের আগেই শুরু হয়েছে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এক ধরনের সিন্ডিকেট কাজ করছে। সরকারকে এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’’
গুদামে রেকর্ড মজুত
খাদ্য অধিদপ্তরের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সরকারি গুদামে বর্তমানে ১৫ লাখ ৭২ হাজার টন চাল মজুত রয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ৩ লাখ টন বেশি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘‘মজুত পরিস্থিতি সন্তোষজনক। সরকার বাজারে নজরদারি বাড়িয়েছে। কেউ সিন্ডিকেট করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
দাম বৃদ্ধি মিলগেটেই
অধিকাংশ জায়গায় চালের মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে মিলগেট থেকেই। জেলা খাদ্য কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,‘‘গুদামে চাল আছে, বাজারেও সরবরাহ আছে। কিন্তু মিল পর্যায় থেকেই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে। যেহেতু ৮৫ শতাংশ চালকলের দীর্ঘমেয়াদি মজুত ক্ষমতা নেই, তাই দায় বর্তায় করপোরেট চালকলগুলোর ওপর। এসব প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে বিপুল ধান কিনে বাজারে প্রভাব ফেলে।’’
নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘‘প্যাকেটিং, পরিবহন, শ্রমিক মজুরিসহসব খাতে খরচ বেড়েছে। কম দামে চাল বিক্রি করা কঠিন।’’ তবে বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির প্রচার সম্পাদক জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘‘বড় করপোরেট মিলগুলোই মাঠ পর্যায় থেকে আগাম টাকা দিয়ে ধান কিনে নেয়। এতে স্থানীয় ছোট মিলগুলো পিছিয়ে পড়ে।’’
চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বলেন, ‘‘এক শ্রেণির কোম্পানি একসঙ্গে বিপুল ধান কিনে বাজারে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করছে।’’
অভিযান শুধুই খুচরা বাজারে
মূল নিয়ন্ত্রকরা যেখানে ধরাছোঁয়ার বাইরে, সেখানে অভিযান চলছে কেবল খুচরা বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাজারে অভিযান চালানো হলেও মিল পর্যায়ে কোনো দৃশ্যমান তদারকি নেই।’’
কুষ্টিয়ায় চালের বস্তায় ২০০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি
খাজানগর মোকামে সরু চালের ২৫ কেজির বস্তা ঈদের আগে বিক্রি হয়েছে ১৭২০ টাকায়, যা এখন ১৯২০ টাকা। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা একে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বলে আখ্যা দিয়েছেন।
কুষ্টিয়া চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘‘এটা অস্বাভাবিক। দাম বৃদ্ধির পেছনে গভীর সিন্ডিকেট তৎপরতা থাকতে পারে। তদন্ত হওয়া দরকার।’’
ভোক্তার কষ্ট
রবিবার রাজধানীর কাপ্তান বাজারে মিনিকেট কিনতে আসা চাকরিজীবী মনির আহমেদ বলেন, ‘‘আগে মিনিকেট কিনতাম ৭৫-৭৮ টাকায়। এখন কিনছি ৮০-৮৩ টাকায়। প্রতিদিনের খরচের হিসাব কষেই বাজারে যেতে হয়।’’
সাম্প্রতিক চালের বাজার পরিস্থিতি বলছে, খাদ্য উৎপাদন নয় বাজার ব্যবস্থাপনাই এখন প্রধান সংকট। কৃষক ও ভোক্তা দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। লাভবান গুটিকয়েক মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীর। এই ব্যবস্থার সংস্কার না হলে বাম্পার ফলনেও জনগণের কষ্ট কমবে না।
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘যখন ফসল কৃষকের হাতে থাকে, তখন দাম পড়ে। আর ফসল যখন যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে, তখনই মূল্য বাড়ে। পুরো ব্যবস্থাই এক ধরনের জিম্মি দশায় আছে।’’
খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘‘দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত রয়েছে। খুব দ্রুতই চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসবে। চলতি মৌসুমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে।’’
তারপরও বাজারে চালের দাম কমছে না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে খাদ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘‘চালের দাম বাড়াতে বাজারে কোনো সিন্ডিকেট থাকলে তা ভেঙে দিতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। দক্ষিণাঞ্চলে সরু জাতের ধান চাষের কারণে ধান সংগ্রহে কিছু সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে। সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে এবং সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে।’’
তারা//