গাজীপুরে টঙ্গীতে অভিযানে গিয়ে আসামির বাসা থেকে ব্যাংক চেক বই নেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) ঢাকা বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (এডি) মারফিয়া আফরোজ ও তাঁর দল। তবে সেই চেক বই জব্দ তালিকায় দেখানো হয়নি। এ নিয়ে মারফিয়া আফরোজ ও তাঁর আভিযানিক দলের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে ডিএনসি। এরই অংশ হিসেবে মঙ্গলবার ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় তাঁর কার্যালয়টি সিলগালা করা হয়। এ ছাড়া পরদিন মারফিয়াসহ চারজনকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে (স্ট্যান্ড রিলিজ) দেওয়া হয়েছে। অন্য তিনজন হলেন– এসআই জান্নাতুল ফেরদাউস, এএসআই আতাউল হক ও সিপাহী সোহেল রানা। তাদের প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২২ জুন মারফিয়া আফরোজের নেতৃত্বে একটি দল টঙ্গীতে মাদকবিরোধী অভিযানে যায়। টঙ্গী সরকারি কলেজ এলাকা থেকে রমিজ উদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে ইয়াবাসহ আটক করেন তারা। পরে দুপুরে তাঁকে নিয়ে দক্ষিণ খাঁপাড়ায় ৭৩/৪ নম্বর বাড়ির তিনতলায় রমিজ উদ্দিনের ভাড়া বাসায় যায় আভিযানিক দলটি। যদিও এ ঘটনায় পরদিন টঙ্গী পশ্চিম থানায় করা মামলায় রমিজকে বাসা থেকে গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
 
এজাহারে বলা হয়, বাসায় রমিজ উদ্দিনের লুঙ্গির কোচরে থেকে পাঁচ হাজার পিস এবং ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ার থেকে ১০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এই মামলার বাদী সহকারী পরিচালক মারফিয়া আফরোজ। অভিযানে তিনিসহ মোট ৯ জন অংশ নেন। অপর আটজন হলেন– বিভাগীয় পরিদর্শক শাহরিয়ার শারমিন, এসআই আবদুল আল মামুন ও জান্নাতুল ফেরদাউস, এএসআই আতাউল, সিপাহি সোহেল, আব্দুর রহমান, সাইমুম হাসান খান ও লুৎফর রহমান।
 
সূত্র জানিয়েছে, আসামি রমিজের বাসা থেকে তাঁর সই করা ব্যাংক হিসাবের চেক আনার অভিযোগ ওঠে সহকারী পরিচালক মারফিয়া আফরোজের বিরুদ্ধে। সেটি কত টাকার চেক– নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ডিএনসির প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ আসার পর পরিচালক (অপারেশনস্) বশির আহমেদ, অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ বদরুদ্দীন তদন্ত শুরু করেন। তারা গত মঙ্গলবার গেণ্ডারিয়া গোয়েন্দা কার্যালয়ে যান। তদন্তের স্বার্থে মারফিয়া আফরোজের অফিস কক্ষ সিলগালা করে দেন তারা। 

বুধবার তারা আবারও তদন্তের জন্য গেণ্ডারিয়া যান। মারফিয়া আফরোজকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তারা। এর পর দুপুরে চারতলায় গিয়ে অচেতন হয়ে পড়ে যান তিনি। তাঁকে দয়াগঞ্জে আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আভিযানিক দলে থাকা আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তদন্তের প্রয়োজনে সহকারী পরিচালকের কক্ষের সিলগালা ভেঙে পরিচালক ও অতিরিক্ত পরিচালক ভেতরে তল্লাশি করেন। পরে বিকেলে আবারও অফিস কক্ষটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। অফিস কক্ষ থেকে বেশ কিছু আলামত জব্দ করা হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছিল গোয়েন্দা বিভাগের এসআই জান্নাতুল ফেরদৌসকে। কিন্তু অভিযোগের পর তাঁকে প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করায় পরে ঢাকা দক্ষিণের পরিদর্শক লোকমান হোসেনকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। 

মারফিয়া আফরোজ চেক বইয়ের কথা স্বীকার করে বৃহস্পতিবার রাতে সমকালকে বলেন, ‘টঙ্গীতে রমিজের বাসায় অভিযানের সময় কিছু ডকুমেন্ট পাওয়া যায়। সেগুলো এনে আমার কাছে রাখি। জব্দ তালিকায় দেখানো হয়নি। কাজের চাপে ডকুমেন্টগুলো আর দেখাও হয়নি। বৃহস্পতিবার সিপাহি সোহেল রানা ডকুমেন্ট খুলে দেখেন, তার মধ্যে একটি চেক বই। ২-৩টা চেকের পাতায় সই করা। তখন আমি সোহেলকে চেক বইটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জান্নাতুল ফেরদৌসকে দিয়ে দিতে বলি। কিন্তু সে আমার ড্রয়ারে রেখে দেয়। পাঁচ দিন ছুটি নিয়ে আমি শুক্রবার সুনামগঞ্জে যাই। মঙ্গলবার জানতে পারি, আমার অফিস সিলগালা করেছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পরে সোহেল রানা ফোন দিয়ে বলে, ম্যাডাম, ভুল করে ফেলেছি। চেক বইটা তো আপনার ড্রয়ারে রয়েছে। তখন আমি চিন্তিত হয়ে পড়ি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাকে আসতে বলেন। বুধবার দুপুর ১২টায় আমি অফিসে আসি। আমাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়।’

মারফিয়া আফরোজ আরও বলেন, ‘আমি জেনে-বুঝে চেক নিয়ে আসিনি। ডকুমেন্টসের মধ্যে সিডিআর (মোবাইল কললিস্ট) পাওয়া যায়। চেক বই দিয়ে কোনো অর্থ লেনদেন করা হয়নি।’

ডিএনসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘ব্যক্তির অপরাধের দায়ভার প্রতিষ্ঠান নেবে না। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এডি মারফিয়া আফরোজের কার্যালয়ে পরিদর্শনে গিয়ে পরিস্থিতি সন্তোষজনক মনে না করায় সিলগালা করে দেন।’

কার্যালয় সিলগালা এবং মারফিয়া আফরোজ ও তাঁর টিমের তিনজনকে স্ট্যান্ড রিলিজের কারণ জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘এটা প্রশাসনিক কার্যক্রম।’

মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে ডিএনসির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আসামি বা তার স্বজনের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ নতুন নয়। প্রায়ই এমন অভিযোগ ওঠে কোনো কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। গত ১৮ জুন টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর পৌরসভার সাবেক সংরক্ষিত কাউন্সিলর ছালেহা বেগমের বাড়িতে অভিযানে গিয়ে বাসা থেকে সাড়ে আট লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে ডিএনসির টাঙ্গাইল জেলা কর্যালয়ের কর্মকর্তা-সিপাহিদের বিরুদ্ধে। এ অভিযোগে তিন কর্মকর্তাকে সোমবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই অভিযোগে বুধবার এএসআই শামীম আল আজাদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

ঢাকা বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ খোরশিদ আলমকে কয়েকবার ফোন করা হয় তাঁর অধীন এডির কার্যালয় সিলগালা ও টঙ্গীর অভিযান সম্পর্কে মন্তব্য নেওয়ার জন্য। তবে তিনি ফোন ধরেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে এ ব্যাপারে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো জবাব দেননি তিনি।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: অভ য ন কর মকর ত র ন কর মকর ত ড এনস র তদন ত র আফর জ র চ ক বই সহক র

এছাড়াও পড়ুন:

বাদীর কাছে এসআইয়ের ঘুষ দাবির অডিও ফাঁস

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার এক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবি, মিথ্যা প্রতিবেদনে ফাঁসানোর চেষ্টা এবং আসামি পক্ষকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় এক কৃষক। এ ঘটনায় মঙ্গলবার অভিযোগ দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী কৃষকের ছোট ভাই।

চুনারুঘাট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফয়সাল আমিনের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তুলেছেন উপজেলার বাসিন্দা সাহাব উদ্দিন। পরে তার পক্ষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন তার ছোট ভাই আলাউদ্দিন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রমাণ হিসেবে সামনে এসেছে ফাঁস হওয়া একটি অডিও ক্লিপ। সম্প্রতি ঘুষের টাকা নিয়ে এসআই ফয়সাল ও ওই ভুক্তভোগীর কথোপকথন হিসেবে দাবি করা ওই অডিও ক্লিপ ফাঁস হওয়ার পর থেকে এলাকায় নানা গুঞ্জন চলছে।

অডিওতে এসআই ফয়সলকে বলতে শোনা যায়, ‘নিয়ম হলো রিপোর্ট দিয়ে টাকা নেওয়া। আগে যেহেতু টাকা নিয়ে ফেলছি, এখন দায় সার অবস্থায় পড়ে গেছি। আমি টাকা ছাড়া কোনো কথা বলি না। একজন মাত্র ৭ হাজার টাকা দিয়ে গেছে। আপনার টাকাটা নিয়েই এখন বিপদে পড়ছি, সবাই জেনে গেছে।’ 

জবাবে ভুক্তভোগী সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘সে আমার আসামি। ২০ হাজার না ৩০ লাখ টাকা দিলেও আপনি খাইবেন, কিন্তু আমার বিষয়টা যেন ঘুরিয়ে না দেন। ধান বিক্রি করে, ঋণ করে টাকা দিয়েছি।'

মঙ্গলবার সাহাব উদ্দিনের ছোট ভাই আলাউদ্দিন এই ঘটনায় সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও এসআই ফয়সলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির দাবিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), হবিগঞ্জের পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে এর অনুলিপি পাঠানো হয়েছে।

অভিযোগে বলা হয়, প্রায় ৯ মাস আগে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ তুলে সাহাব উদ্দিন তার প্রতিবেশী সুরুক মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন এসআই ফয়সল আমিন। লেখার খরচ ও তদন্ত রিপোর্ট দ্রুত দেওয়ার জন্য এসআই ফয়সল ভুক্তভোগী সাহাব উদ্দিনের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ঘুষ নেন। পরবর্তীতে আরও ২০ হাজার টাকা দাবি করলে পরিবারটি তা দিতে না পারায়, তিনি আসামি পক্ষের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে মিথ্যা প্রতিবেদন দাখিল করেন। এছাড়া পুলিশ কর্মকর্তা ফয়সলের ইন্ধনে গত ২৯ মে সাহাব উদ্দিনের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় আসামিপক্ষ। এতে তার একটি হাত ও পায়ের হাড় ভেঙে যায়। সে অবস্থায় তিনি সিলেট এম.এ.জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৮ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন, যার মধ্যে তিন দিন আইসিইউতে।

এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে এসআই ফয়াসল আমিন সাহাব উদ্দিনকে বলেন, ‘তোমরা তো ১৫ হাজার টাকা দিয়েছো, এরপর যোগাযোগ করোনি, তাই আগের রিপোর্টই পাঠিয়ে দিয়েছি।’ এ সময় থানায় বাদীপক্ষের হুমকির মুখেও পড়েছিলেন বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। 

ভুক্তভোগী সাহাব উদ্দিন বলেন, দ্বিতীয়বার টাকা দাবি করলে তিনি মোবাইলে ভিডিও ধারণ করেন। বিষয়টি টের পেয়ে তিনি এসআই তার মোবাইল থেকে ভিডিও ডিলিট করে দেন। পরে তিনি তা পুনরুদ্ধার করেন।

ভুক্তভোগী সাহাব উদ্দিনের ভাই আলাউদ্দিন বলেন, এসআই ফয়সলের ঘুষ বাণিজ্যের কারণে তারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত। পুলিশের সদস্য হয়েও সে দুর্নীতির চর্চা করে। 

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, এসআই ফয়সলের কর্মকাণ্ড নিয়ে এলাকায় নানা প্রশ্ন রয়েছে। অভিযানে গিয়ে জুয়ার বোর্ড থেকে টাকা আত্মসাৎ, পক্ষপাতমূলক তদন্ত এবং ঘুষ নিয়ে মামলা পরিচালনার অভিযোগ একাধিক।

ফরিদপুর জেলার বাসিন্দা ফয়সাল আমিন ২০২০ সালে বাংলাদেশ পুলিশে নিয়োগ পান। ২০২৪ সালের ৯ অক্টোবর চুনারুঘাট থানায় যোগ দেন।

মাধবপুর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) এ কে এম সালিমুল হক বলেন, ঘটনার বিষয়ে ভুক্তভোগীর ভাই তাকে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন। লিখিত অভিযোগ পেলে বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অভিযুক্ত এসআই ফয়সাল আমিন ঘটনা স্বীকার করে বলেন, ভুল হয়েছে, বিষয়টি যেন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হয়। ভবিষ্যতে ভুল শুধরে নিয়ে সঠিকভাবে দায়িত্বপালনের কথাও বলেন তিনি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আসামির বাসা থেকে আনা চেক বই তোলা হয়নি জব্দ তালিকায়
  • বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসা থেকে ব্যাংক কর্মীর অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার
  • বনানীতে ট্রেনে কাটা পড়ে নারীর মৃত্যু
  • সিদ্ধিরগঞ্জে হেরোইন ও ইয়াবাসহ দুই মাদক কারবারি গ্রেপ্তার
  • বাদীর কাছে এসআইয়ের ঘুষ দাবির অডিও ফাঁস
  • চকরিয়ায় পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সেই আসামি গ্রেপ্তার
  • মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ, তিনজন বরখাস্ত
  • ধর্ষণচেষ্টা মামলা তুলে নিতে বাদীকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ