চিড়া–বাদাম বেচেন কুদ্দুস, বাড়িতে হাজারো বই আর অডিও
Published: 11th, July 2025 GMT
আবদুল কুদ্দুস শিকদারের বয়স ৭৩ ছুঁই ছুঁই। এখনো বাড়িতে ভাজা চিড়া, বাদাম আর বুট নিজেই বাইসাইকেল চালিয়ে দোকানে দোকানে বিক্রি করেন। সামান্য আয়ে সংসার চালিয়ে প্রতি মাসে কিছু টাকা বাঁচান, যা দিয়ে সাহিত্যের মোটা মোটা বই কেনেন। এভাবে তিনি সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের হাজারখানেক বই। যদিও তিনি নিরক্ষর। পুত্রবধূকে দিয়ে বই পড়িয়ে পাশে বসে শুনে সাহিত্যের রস আস্বাদন করেন তিনি।
শুধু সাহিত্যের বই নয়, আধ্যাত্মিক বা গভীর অনুভূতির প্রকাশ ঘটানো সংগীত বা ভাবসংগীতের সংগ্রাহকও তিনি। তাঁর বাড়ির একটি টিনের ঘরে আড়াই হাজার অডিও রেকর্ডিংয়ের সংগ্রহ বা ক্যাসেট রয়েছে। এতে ধারণ করা আছে অন্তত ১০ হাজার ভাবসংগীত। ক্যাসেট বাজানোর জন্য ১৪টি ক্যাসেট প্লেয়ার সেটও রয়েছে। প্রায় প্রতি রাতে তিনি গান শুনতে শুনতে ঘুমাতে যান। মাঝেমধ্যে ঘরেই বসান ভাবসংগীতের আসর। সাধুসঙ্গে গানের পাশাপাশি গানের কথা ও ভাব নিয়ে আলোচনাও হয়।
গল্পে গল্পে আবদুল কুদ্দুস জানান, জীবনে এক দিনের জন্যও স্কুলে যাওয়া হয়নি তাঁর। পরে অবশ্য নিজের চেষ্টায় কিছুটা অক্ষর চিনেছেন। তবে গড়গড়িয়ে পড়ার মতো শিখতে পারেননি। লিখতেও পারেন না। বইয়ে লেখকের ছবি দেখে তিনি মূলত বই চিনতে পারেন।যশোর শহরের পালবাড়ি রায়পাড়া এলাকায় আবদুল কুদ্দুসের বাড়ি। ১৩ শতক জমির বাড়িতে স্ত্রী, চার ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনি নিয়ে তাঁর বসবাস। নিজে সাহিত্য পড়তে বা গান গাইতে না পারলেও তিনি সাহিত্য ও ভাবসংগীতের অনুরাগী। গানে তাল লয় সুর তোলার জন্য একতারা, দোতারা ও মন্দিরা রয়েছে তাঁর ঘরে।
গত ২৯ মে কুদ্দুস শিকদারের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, টিনের চালার একটি ঘরে তাঁর বসবাস। অন্য আরও ঘর রয়েছে। স্ত্রী-সন্তানেরা সেগুলোতে থাকেন। কুদ্দুসের ঘরের এক প্রান্তে একটি চৌকির মতো খাট। খাটে সব সময় মশারি টাঙানো থাকে। মশারির মধ্যে বালিশের দুই পাশে দুটি ক্যাসেট প্লেয়ার ও অসংখ্য ক্যাসেট। সেগুলো এখনো সচল। পাশবালিশের মতো করে একটি দোতারা রাখা আছে মশারির ভেতরে।
আবদুল কুদ্দুস বলেন, দানা গুড়ের ঠিলেয় ঝোল রাখা হয় কেন জানেন? দানা বাঁচিয়ে রাখার জন্য। আমি হলাম সেই ঝোল। নিজে দানা হতে না পারলেও দানা বাঁচিয়ে রাখার কাজটা ঝোল হিসেবে করে যাচ্ছি।ঘরের অন্য প্রান্তে রাখা দুটি আলমারি। যেগুলো মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, ড.
গল্পে গল্পে আবদুল কুদ্দুস জানান, জীবনে এক দিনের জন্যও স্কুলে যাওয়া হয়নি তাঁর। পরে অবশ্য নিজের চেষ্টায় কিছুটা অক্ষর চিনেছেন। তবে গড়গড়িয়ে পড়ার মতো শিখতে পারেননি। লিখতেও পারেন না। বইয়ে লেখকের ছবি দেখে তিনি মূলত বই চিনতে পারেন। সাহিত্যের প্রতি তাঁর প্রবল অনুরাগ। প্রতি মাসে তিনি দু-একখানা করে লেখকের রচনাসমগ্র কেনেন। বই কেনার এমন নেশা যে সুদে টাকা নিয়েও তিনি বই কিনেছেন। কাউকে পেলেই তাঁকে দিয়ে বই পড়িয়ে নিজে বসে বসে শুনেছেন।
পরিবারের সদস্যরা জানান, এখন অবসর সময়ে পুত্রবধূ সাবিহা খাতুনকে ডেকে বই পড়তে বলেন আবদুল কুদ্দুস। সাবিহা বই পড়ার সময় প্রবল আগ্রহ নিয়ে পাশে বসে তা শোনেন তিনি। সাহিত্যের প্রতি শ্বশুরের এমন আগ্রহ সাবিহা খাতুনও উপভোগ করেন। পড়াশোনা বিদ্যালয়ের গণ্ডি পর্যন্ত পড়াশোনা করা সাবিহা বলেন, ‘আমার শ্বশুর অন্যদের চেয়ে একদমই আলাদা। শিশুর মতো তাঁর মন। সাহিত্য আর বাউলগানের প্রতি তাঁর বেশি আগ্রহ। প্রায়ই আমাকে ডেকে সাহিত্যের বই পড়তে বলেন। আমি পড়ে শোনাই। এতে আমারও বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। আমার স্বামীও এতে উৎসাহ দেন।’
সাহিত্যের প্রতি এমন আগ্রহ কীভাবে এল—জবাবে আবদুল কুদ্দুস বলেন, ‘আমার ঠাকুর দাদা করম আলী ফকিরের বাউলগান ও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ছিল। তাঁকে দেখেছি। দাদার বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায়। পরে অভাবের কারণে বাবা আনিসুর রহমান আমাদের নিয়ে যশোরে চলে আসেন। বাবা রিকশা চালাতেন। আমাকে লেখাপড়া শেখানোর কেউ ছিল না। আমি বুট ভেজে বিক্রির কাজে নেমে পড়লাম। কিন্তু দাদার কাছ থেকে বিভিন্ন কবি–সাহিত্যিকের কথা শুনেছি।’
প্রতি মাসে তিনি দু-একখানা করে লেখকের রচনাসমগ্র কেনেন। বই কেনার এমন নেশা যে সুদে টাকা নিয়েও তিনি বই কিনেছেন। কাউকে পেলেই তাঁকে দিয়ে বই পড়িয়ে নিজে বসে বসে শুনেছেন।আবদুল কুদ্দুস বলেন, ‘কোনো বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে একেকজন একেক রকম করে বলত। তাই আমি নিজেই তখন বইপুস্তক কিনে নিজে খোঁজার চেষ্টা করতাম। আশির দশকে বাণী চিরন্তনী নামের বইটি প্রথম কিনেছিলাম। তারপর ভাবগানের বিভিন্ন আসরে গিয়ে সাহিত্য ও গানের প্রতি আগ্রহ বাড়ে।’
আবদুল কুদ্দুসের ওই টিনের ছাপরা ঘুরে গেছেন লোকসংস্কৃতি-গবেষক সাইমন জাকারিয়া। পরে ২০১৩ সালে প্রকাশিত সাইমন জাকারিয়ার বাংলাদেশের লোকসংগীত গ্রন্থের ১৬০ পৃষ্ঠায় যশোর অঞ্চলের ভাবসংগীতের সংগ্রাহক হিসেবে আবদুল কুদ্দুসের ছবি ছাপানো হয়।
আবদুল কুদ্দুসকে আমরা কুদু ভাই নামেই চিনি। তাঁর মধ্যে প্রখর জীবনবোধ ও জীবনদর্শন রয়েছে। একজন নিরক্ষর মানুষের মধ্যে এতটা সাহিত্যানুরাগ আমি আর কারও মধ্যে দেখিনি।চিত্রশিল্পী ও লেখক অধ্যাপক মফিজুর রহমানযশোরের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ও লেখক অধ্যাপক মফিজুর রহমানের (রুননু) একক প্রদর্শনীতে জায়গা পেয়েছিল আবদুল কুদ্দুসকে নিয়ে তাঁর আঁকা একটি ছবিও। মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবদুল কুদ্দুসকে আমরা কুদু ভাই নামেই চিনি। তাঁর মধ্যে প্রখর জীবনবোধ ও জীবনদর্শন রয়েছে। একজন নিরক্ষর মানুষের মধ্যে এতটা সাহিত্যানুরাগ আমি আর কারও মধ্যে দেখিনি। তিনি একজন সুচিন্তক মানুষ।’ ৭৩ বছর বয়সেও নিজে ভাজা বুট দোকানে দোকানে বিক্রি করে বেড়ালেও আবদুল কুদ্দুস কারও মুখাপেক্ষী হতে চান না বলে জানান তিনি।
সাহিত্যচর্চা তাঁকে নানা খারাপ বাসনা থেকে দূরে রেখেছে বলে মনে করেন আবদুল কুদ্দুস। তিনি তেমন বেশি মানুষের সঙ্গে মেশেন না। তাঁর সঙ্গীসাথি সব বাউল সাধকেরা। তাঁর গুরু ছিলেন কুষ্টিয়ার প্রয়াত বাউল সাধক করিম শাহ। তাঁর কাছে জীবনে তিনি গুনে গুনে ৫৬ বার গেছেন। নিজের কাজের বিষয়ে আবদুল কুদ্দুস বলেন, ‘দানা গুড়ের ঠিলেয় ঝোল রাখা হয় কেন জানেন? দানা বাঁচিয়ে রাখার জন্য। আমি হলাম সেই ঝোল। নিজে দানা হতে না পারলেও দানা বাঁচিয়ে রাখার কাজটা ঝোল হিসেবে করে যাচ্ছি।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ভ বস গ ত র ন র জন য র রহম ন বই ক ন গ রহ ব
এছাড়াও পড়ুন:
শ্রীনগরে চার যুবকের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণের ভিডিও ভাইরাল
মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে চার যুবকের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণের একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওটি শ্রীনগর ইউনিয়নের শ্রীনগর কলেজ এলাকার বলে ধারণা করছে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, ভিডিওটি গত মে মাসের। ভিডিওতে থাকা যুবকেরা ‘রাসেল-ফয়সাল বাহিনী’ নামের একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য এবং শ্রীনগর উপজেলার চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তাঁদের নাম ফয়সাল, রাসেল, অর্পণ, আহির। তাঁদের সবার বয়স ২৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
ছড়িয়ে পড়া ১ মিনিট ৮ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, জনশূন্য একটি স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন চার যুবক। তাঁদের মধ্যে দুজনের হাতে দুটি পিস্তল। একজনকে পিস্তল দেখিয়ে বলতে শোনা যায়, ‘দামি কিন্তু এইডা, দুইডা দিয়া শট করমু।’ জবাবে অন্যজন বলেন, ‘দুইডা দিয়া শট করা যাইব না, একটা দিয়া শট করতে হইব। গুল্লি রেয়ার, পাওয়া যায় না।’ একজন বলেন, ‘লকটা খুলে টিপ দিলেই গুলি বের হইব।’ এ সময় পিস্তল হাতে নিয়ে আকাশের দিকে গুলি করার চেষ্টা করেন একজন। কীভাবে গুলি করতে হবে, পাশ থেকে বলছিলেন আরেক যুবক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভিডিওতে থাকা যুবকদের মধ্যে রাসেলের বাড়ি উপজেলার বাঘরা এলাকায়। ফয়সালের বাড়ি কামারখোলা। আর সাদা টি–শার্ট, কালো প্যান্ট ও টুপি পরা আহিরের বাড়ি শ্রীনগর ইউনিয়নের মথুরা পাড়ায় এবং অন্যজন একই এলাকার কালো পাঞ্জাবি পরা অর্পণ।
শ্রীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমূল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ভিডিওটি গত মে মাসের। এটি শ্রীনগর কলেজের পেছনের পুকুরপাড় এলাকা বলে ধারণা করা হচ্ছে। শ্রীনগরের পরিবেশ এখন শান্ত। পরিবেশ ঘোলাটে করতে পাঁচ মাস আগের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাড়া হয়েছে। তিনি বলেন, ভিডিওতে থাকা ব্যক্তিদের ইতিমধ্যে পুলিশ শনাক্ত করেছে। তাঁরা সবাই চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তাঁদের সবার বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলা আছে। সবাই আত্মগোপনে আছেন। তাঁদের মধ্যে রাসেলের দুটি চোখ প্রতিপক্ষের লোকজন উপড়ে ফেলেছেন। তাঁদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।