জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপন করতে দেব না: হেফাজত
Published: 11th, July 2025 GMT
জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের আঞ্চলিক কার্যালয় ঢাকায় স্থাপনের সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে হেফাজতে বাংলাদেশের নেতারা বলেছেন, “এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে স্পষ্ট হুমকি। আমরা এই মানবাধিকার কার্যালয় ঢাকায় স্থাপন করতে দেব না।”
সরকার সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসলে কঠোর কর্মসূচির হুমকি দেন নেতারা।
ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনের প্রতিবাদে শুক্রবার (১১ জুলাই) জুমার নামাজের পর রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগর আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে তারা এ হুঁশিয়ারি দেন।
আরো পড়ুন:
সমকামীকে দূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত রিভিউ দাবি
ইসলামী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনে ইসলামপন্থিরাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসবে: রেজাউল করীম
সভায় সভাপতিত্ব করেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি আল্লামা মাওলানা মামুনুল হক।
মাওলানা মামুনুল হক বলেন, “জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল, তা বাস্তবায়নের পরিবর্তে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যা জনআকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী ও স্বাধীনতার মৌলিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। গত ১৬ বছরে ঘটে যাওয়া বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও খুনের বিচার নিশ্চিত না করে এখন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য দরজা খুলে দেওয়া মানে অপরাধীদের দায়মুক্তি ও জনগণের প্রতি অবিচার।”
“ড.
তিনি বলেন, “আজ আমরা শুধু প্রাথমিক প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু সরকার যদি এই সিদ্ধান্ত থেকে অবিলম্বে সরে না আসে, তাহলে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ সারা দেশে তীব্র আন্দোলনের ডাক দিতে বাধ্য হবে।”
তিনি বলেন, “হেফাজতের দৃষ্টিতে জাতিসংঘ বা কোনো বিদেশি সংস্থার মাধ্যমে মানবাধিকার ইস্যুতে হস্তক্ষেপ দেশের সংবিধান ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী। এ ধরনের কার্যালয় স্থাপন সরকারের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতার প্রতিফলন। দেশিয় ইসলামী মূল্যবোধ, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এটি দীর্ঘমেয়াদে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।”
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, নায়েবে আমির মাওলানা মুহিউদ্দীন রাব্বানী, মাওলানা আহমাদ আলী কাসেমী, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরীর সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মাওলানা জালালুদ্দীন, মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, মুফতি মুনির হুসাইন কাসেমী, মাওলানা আজহারুল ইসলাম, মাওলানা রাশেদ বিন নূর, মাওলানা এনামুল হক মুসা, মুফতী শরীফুল্লাহ, মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান, মাওলানা এহসানুল হক, মাওলানা ইমরানুল বারী সিরাজী, মাওলানা জোবায়ের রশীদ, মাওলানা এহতেশামুল হক সাকী প্রমুখ।
সমাবেশ থেকে চারটি দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হলো
১. ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
২. দেশের অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেশের স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকেই কার্যকর ভূমিকা রাখতে দিতে হবে।
৩. বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম-খুনের নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
নেতারা বলেন, “বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।এর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না। ঈমানি দায়িত্ব ও জাতীয় কর্তব্য থেকে হেফাজতে ইসলাম এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলবে, প্রয়োজনে আরো বৃহত্তর কর্মসূচি দেবে।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/এসবি
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ ত স ঘ ম নব ধ ক র সরক র ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
পিআর পদ্ধতি কি রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হবে
প্রপোশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন বা পদ্ধতি বাংলাদেশে বর্তমানে আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ছোট-বড় প্রায় সব রাজনৈতিক দলের মধ্যেই পিআর পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান ও জনমত গঠনের প্রচেষ্টা চোখে পড়ার মতো।
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে আলোচনা যত পুরোনো, ততই নতুন করে বারবার আলোচনার টেবিলে ফিরে আসে পিআর পদ্ধতির প্রস্তাব। তবে আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে এবারই সর্বোচ্চ আলোচনায় রয়েছে পিআর পদ্ধতি।
দেশের একশ্রেণির রাজনীতিবিদের দাবি, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন সংখ্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে ছোট দলগুলোকেও প্রতিনিধিত্বের সুযোগ তৈরি করে দেবে এবং নির্বাচনী রাজনীতিকে আরও যুগোপযোগী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলবে। তাঁদের দাবি, দলীয় স্বৈরতন্ত্রের লাগাম টেনে ধরে প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনকাঠামোর বিকল্প নেই।
আরও পড়ুনবাংলাদেশের জন্য পিআর পদ্ধতির নির্বাচন কতটা যৌক্তিক২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫অন্যদিকে আরেক শ্রেণির বিশ্লেষক এটিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জোটের সংকট ও শাসন অদক্ষতার উৎস হিসেবে বিবেচনা করছেন। তাঁদের দাবি, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থায় একধরনের ‘নড়বড়ে’ সরকার গঠিত হবে, যা দিন শেষে রাজনৈতিক ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে শেষ হবে।
তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, গণপ্রতিনিধিত্বের এই গাণিতিক মডেল কি সত্যিই বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠবে, নাকি নতুন করে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সূত্রপাত হবে?
এ প্রশ্নের উত্তর ব্যাপক ও বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। প্রথমেই পিআর পদ্ধতির মূল ধারণা ও এর প্রতি কেন বিশেষ কিছু রাজনৈতিক দলের এত আকর্ষণ, তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
বস্তুত, এটি এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা, যেখানে একটি দলের প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার অনুযায়ী সংসদে তাদের আসন বরাদ্দ হয়। অর্থাৎ একটি দল যদি জাতীয়ভাবে ২০ শতাংশ ভোট পায়, তবে সংসদে তারা ২০ শতাংশ আসন পাবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই ভোটে একটি দল সংসদে ৩০০-এর মধ্যে ৬০টি আসন পাবে।
অর্থাৎ এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে সম্পূর্ণ আধিপত্যের সুযোগ না দিয়ে সংখ্যালঘু দলগুলোকেও যথোপযুক্ত প্রতিনিধিত্বের সুযোগ করে দেয়। তাত্ত্বিকভাবে এটি গণতান্ত্রিক ন্যায়বিচারের নিখুঁত উদাহরণ, তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
২.আধুনিক বিশ্বে ১৮৯৯ সালে প্রথম বেলজিয়ামে পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ইউরোপের অনেক দেশ—বিশেষ করে জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডসসহ নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন ও লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশে এ ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে এই পদ্ধতিতে সাফল্যের সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা করে আসছে।
সেই উদাহরণ টেনেই বর্তমানে বাংলাদেশেও পিআর বাস্তবায়নের জোর আহ্বান জানিয়ে আসছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি ছোট রাজনৈতিক দল। অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তার সহযোগী দলগুলো বর্তমান প্রচলিত পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে।
বাস্তবতা হলো, ইউরোপ বা লাতিন আমেরিকার উন্নত দেশগুলোর রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিপক্ব, তাদের দলীয় শৃঙ্খলা দৃঢ় এবং প্রশাসনিক কাঠামোও তুলনামূলকভাবে উন্নত ও নিরপেক্ষ। ফলে পিআর পদ্ধতি সেখানে গণতান্ত্রিক বৈচিত্র্য ও প্রতিনিধিত্বের ভারসাম্য বজায় রাখতে পেরেছে। এটি বাংলাদেশের জন্য কতটুকু উপযুক্ত—সেটিই প্রধান প্রশ্ন।
আরও পড়ুনআনুপাতিক সংসদীয় আসনব্যবস্থার জন্য আমরা কি প্রস্তুত২৮ অক্টোবর ২০২৪বাংলাদেশে বর্তমানে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ পদ্ধতিতে একজন ভোটার শুধু তাঁর নির্বাচনী আসনের একজন প্রার্থীকেই ভোট দিতে পারেন।
প্রচলিত এই ব্যবস্থায় পুরো দেশকে মোট ৩০০টি পৃথক নির্বাচনী আসনে ভাগ করা হয়। প্রতিটি আসনে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত ব্যক্তিই নির্বাচিত বলে বিবেচিত হন।
একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। যেমন ঢাকা–১৯ আসনের কথাই বিবেচনা করা যাক। ধরা যাক, বর্তমান পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে এ আসনে তিনটি দল থেকে মনোনীত তিনজন ও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে মোট চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৮০ শতাংশ।
এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ প্রার্থী যথাক্রমে ২৫, ১৫ ও ১০ শতাংশ করে ভোট পেয়েছেন। আর তৃতীয় প্রার্থী পেলেন ৩০ শতাংশ ভোট। বর্তমান পদ্ধতি অনুযায়ী তৃতীয় প্রার্থী এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। আর ওই তিনজন প্রার্থীর মোট ৫০ শতাংশ ভোট কোনো কাজেই আসবে না। কারণ, বিধি মোতাবেক শুধু একজনই নির্বাচিত হতে পারবেন।
৩.বাংলাদেশে বহুদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রচলিত। এখানে অর্ধশতাধিক নিবন্ধিত দল রয়েছে। তবে বাস্তবতার নিরিখে দেখা যায়, হাতে গোনা চার-পাঁচটি রাজনৈতিক দল সক্রিয় এবং কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত তাদের ভোটব্যাংক রয়েছে। বাকি দলগুলোর এ ক্ষেত্রে নানা সংকট বিদ্যমান।
তাই বিচ্ছিন্নভাবে ৩০০টি আসনে কমবেশি ভোট পেলেও অধিকাংশ দলই সংসদের সীমিতসংখ্যক এমনকি কিছু ক্ষেত্রে কোনো আসনেও জিতে আসতে পারে না। এ জন্য বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি নিয়ে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
ছোট দলগুলো জনগণের ভোট পেলেও সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকে না। এই বঞ্চনা পিআর পদ্ধতি দূর করতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। অর্থাৎ ৩০০ আসন মিলিয়ে প্রতি ১ শতাংশ ভোটের বিনিময়ে তিনটি করে আসন পাবে দলগুলো।
বিদ্যমান ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে একটি দল তুলনামূলকভাবে কম ভোট পেয়েও সংসদে বিপুল আসন পেয়ে যায়। আবার কাছাকাছি সংখ্যক ভোট পেয়েও কিছু কিছু দল নগণ্যসংখ্যক আসন পেয়ে থাকে।
গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসা। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে ভোটাররা কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে নয়, বরং একটি রাজনৈতিক দল বা প্রতীককে ভোট দেন। এতে স্বভাবতই গণতান্ত্রিক জবাবদিহির সংকট তৈরি হয়। কারণ, এই কাঠামোয় জনগণের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিত্বের সম্পর্কটি পুরোপুরি ভেঙে যায়।এমন পটভূমিতে পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশের অনেক বিশ্লেষকের কাছে রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তির একটি বিকল্প উপায় বলে মনে হয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, বাংলাদেশের মতো সংকীর্ণ কিংবা অধীন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দলীয়করণে নিমজ্জিত রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোয় এই গাণিতিক মডেল বাস্তবে কতটুকু কাজ করবে?
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো গণতান্ত্রিক সহনশীলতার পর্যায়ে পৌঁছায়নি। রাজনীতিতে সমঝোতার পরিবর্তে শত্রুতার মনোভাব প্রবল।
বিদ্যমান বাস্তবতায় পিআর পদ্ধতিতে কোনো দলেরই এককভাবে ক্ষমতায় যেতে না পারার সম্ভাবনাই বেশি। ফলে বাধ্য হয়েই জোট সরকার গঠন করতে হবে। তবে জোট সংস্কৃতি সহযোগিতার ভিত্তিতে না হলে রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক কালো অধ্যায়ের সূচনা হবে। বিশেষত বাংলাদেশের মতো সংঘাতমুখী রাজনীতিতে এটি স্থিতিশীলতার বদলে অবিরাম রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি করবে। তা ছাড়া পিআর ব্যবস্থায় দলীয় নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়।
কারণ, সংসদ সদস্যরা সাধারণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হয়ে দলীয় তালিকা থেকে মনোনীত হন। এতে দলীয় প্রধানের একনায়কত্ব আরও মজবুত হয়, যা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক।
অন্যদিকে প্রশাসনিক দুর্বলতা, দুর্নীতি এবং স্বচ্ছতার ঘাটতি—এ বাস্তবতায় পিআর ব্যবস্থা সহজেই রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সূত্রপাত করবে।
আরও পড়ুনআনুপাতিক উচ্চকক্ষই এখন সংস্কারের প্রধান চাওয়া এবং কেন?১২ জুন ২০২৫৪.গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসা। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে ভোটাররা কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে নয়, বরং একটি রাজনৈতিক দল বা প্রতীককে ভোট দেন। এতে স্বভাবতই গণতান্ত্রিক জবাবদিহির সংকট তৈরি হয়। কারণ, এই কাঠামোয় জনগণের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিত্বের সম্পর্কটি পুরোপুরি ভেঙে যায়।
একজন সাধারণ ভোটার জানেন না, তাঁর দেওয়া ভোটে কে সংসদে যাচ্ছেন, বা সেই নির্বাচিত ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের পথ কী, সেটাও অজানা। ফলে সংসদ সদস্যের দায়বদ্ধতা জনগণের প্রতি নয়, বরং দলের প্রতি তৈরি হয়, যা গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার মূল দর্শনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
বাংলাদেশে সংসদ সদস্যরা দায়বদ্ধতা থেকেই নিজের নির্বাচনী এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা স্থানীয় চাহিদা পূরণে যথেষ্ট সোচ্চার থাকেন। কেননা পরবর্তী নির্বাচনে ওই এলাকার জনগণের ভোটের ব্যাপার থেকে যায়।
কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে সেই তৃণমূল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী এলাকার মানুষকে নয়, বরং দলীয় হাইকমান্ডকে খুশি রাখতে ব্যস্ত থাকবেন। কেননা পুনরায় সংসদে যাওয়ার টিকিট তখন নির্ধারণ করবে সংশ্লিষ্ট দল, জনগণ নয়।
আবার পিআর বাস্তবায়নের আগে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতাও বিবেচনায় রাখা আবশ্যক। পিআর ব্যবস্থায় সংসদে ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ নিয়ে বহু দল একত্রে বসবে। স্বার্থের ভিন্নতা ও দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা সংসদকে বিশৃঙ্খল করে তুলবে। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হবে এবং নীতি বাস্তবায়ন আরও জটিল হবে।
আরও পড়ুনএমপিদের ‘জমিদারি’ ঠেকানোর উপায় আনুপাতিক নির্বাচন২৩ ডিসেম্বর ২০২৪৫.একটি অস্থিতিশীল ও নড়বড়ে সরকার গঠিত হবে, যা সহজেই জোট রাজনীতির জাঁতাকলে পড়ে যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে। বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো বিশাল জনগোষ্ঠীর বহুমুখী এমন অস্থিতিশীলতার চাপ সহ্য করতে ব্যর্থ হবে, যা একটি ব্যর্থ সরকার এমনকি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে।
তাই বাংলাদেশের মতো দেশে স্থিতিশীল সরকার গঠন ও নীতির ধারাবাহিকতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যা পিআর পদ্ধতির অধীনে প্রায় অসম্ভব।
অবশ্য সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্পষ্টভাবে বলেছেন, তর্কবিতর্ক চললেও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন সংবিধানে নেই। ফলে কমিশন এর বাইরে যেতে পারবে না। তা ছাড়া বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি চালু হলে সংসদ হবে একটি খণ্ডিত রাজনৈতিক অঙ্গন, যেখানে একাধিক দল একে অপরের সঙ্গে দর-কষাকষিতে ব্যস্ত থাকবে।
আরও পড়ুনঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার নির্বাচন নাকি আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা, কোনটা?১৫ নভেম্বর ২০২৪এতে সরকার গঠন যেমন কঠিন হবে, তেমনি দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন রাজনীতির বিলোপ ঘটবে। বিরোধী দলগুলোর জন্য এটি স্বল্প মেয়াদে কিছু প্রতিনিধিত্বের সুযোগ আনতে পারে, তা সত্য, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে গণতন্ত্রকে আরও অনিশ্চিত করে তুলবে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
পিআর পদ্ধতি একটি গাণিতিক ধারণা। তবে তা হঠাৎ করেই আসন্ন সংসদ নির্বাচনে প্রচলন করার সুযোগ নেই। কারণ, গণতন্ত্র শুধু সংখ্যার খেলা নয়; এটি আমাদের দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি, নেতৃত্বের জবাবদিহি ও ন্যায্যতার অনুশীলন।
আমাদের দেশের গণতন্ত্রের বিদ্যমান সংকট পদ্ধতিগত নয় বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নিবদ্ধ। যত দিন পর্যন্ত নিরপেক্ষ প্রশাসন ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নিশ্চিত না করা যাবে, আর রাজনীতির চর্চা সহনশীলতা ও সমঝোতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত না হবে, তত দিন কোনো নির্বাচনী মডেলই সফল হবে না।
সে জন্য এসব সংকট সমাধানে নজর দিতে হবে। পিআর পদ্ধতি হয়তো ভোটের ভারসাম্য আনবে, কিন্তু রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করবে। তাই আজকের বাংলাদেশে এটি কোনো সমাধান নয়, বরং এর মাধ্যমে নতুন এক রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সূত্রপাত হতে পারে।
ড. মো. শামছুল আলম অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ; ডিন (ভারপ্রাপ্ত) সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
*মতামত লেখকের নিজস্ব