এখন প্রায় দিন কোনো না কোনো পত্রিকাতে সরকারি পে স্কেল নিয়ে প্রতিবেদন বা মতামতমূলক লেখা থাকে। এরই মধ্যে আমরা জেনে গেছি, এই সরকার পে কমিশন বাস্তবায়ন করবে না।

আমরা জানি, সরকারি অনেক তথ্যই গোপন রাখতে হয়। কিন্তু এই একটা কমিশনের কাজ মনে হচ্ছে সবাইকে জানিয়ে করা হচ্ছে, যাতে সরকার চাপে থাকে। সংবাদমাধ্যম সূত্রে এবার বেতন বাড়ার প্রস্তাবনা থাকবে ৮০-১০০ শতাংশ। কিন্তু এভাবে সনাতন পদ্ধতিতে বেতন বাড়ালে এই ব্যবস্থা কি টেকসই হবে?

সিটিজি এবং পারফরম্যান্সভিত্তিক কেন হচ্ছে না

বেসিকভিত্তিক বেতনকাঠামো এখন কোনো দেশে নেই। আমাদের সরকারি কর্মচারীদের বেতন জিজ্ঞেস করলেই বলবেন, আমাদের বেসিক বেতন এত, এই টাকাতে কীভাবে চলি? আসলেই বেসিক কম দেখায়। কিন্তু ওই টাকার সঙ্গে যে ভাতা পান, তা কি বেতন না?

বিশ্বজুড়েই বেতনকাঠামো করা হচ্ছে সিটিসি বা কস্ট টু কোম্পানি কনসেপ্টে। এখানে হবে সিটিজি মানে কস্ট টু গভর্নমেন্ট। যেমন কোম্পানিতে সিটিসি, তেমনি সরকারে সরকারের মোট ব্যয় হিসাব। একজন চাকরিজীবী সারা বছর মোট যে পরিমাণ বেতন–ভাতা এবং সুবিধা পান, তা এক মাসে নিয়ে আসা। আমি নিচে একটা ড্রাফট উদাহরণ দিচ্ছি।

১.

মূল বেতন—মাসিক বেতনের মূল অংশ, যার ওপর অন্য ভাতাগুলো নির্ভর করে।

২. বাসাভাড়া ভাতা—সাধারণত মূল বেতনের ৩০%-৫০% পর্যন্ত হতে পারে।

৩. চিকিৎসা ভাতা—নির্দিষ্ট পরিমাণ বা প্রকৃত খরচ অনুযায়ী প্রদান করা হয়।

৪. যাতায়াত ভাতা—অফিসে আসা-যাওয়ার খরচের জন্য।

৫. বিশেষ ভাতা—অফিস নীতিমালা অনুযায়ী বিভিন্ন অতিরিক্ত সুবিধা। মহার্ঘ ভাতার মতো সব ভাতাও এর মধ্যে আসবে।

৬. প্রভিডেন্ট ফান্ড, সাধারণত বেতনের ১০% কর্মী ও ১০% প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে জমা হয়। কোম্পানির অংশটি সিটিসির অন্তর্ভুক্ত।

৭. গ্র্যাচুইটি, নির্দিষ্ট সময় চাকরি শেষে কর্মীকে প্রদেয় এককালীন সুবিধা মাস হিসাবে ভাগ করে ধরা হয়।

৮. বোনাস, সাধারণত বছরে দুইবার (ঈদ/বছর শেষ) বোনাস মোট পরিমাণকে ১২ দিয়ে ভাগ করে দেওয়া হয়। সরকারি ক্ষেত্রে বৈশাখী বোনাস যুক্ত হবে।

৯. ইনস্যুরেন্স, কর্মীর জন্য কোম্পানি যেকোনো বিমা করলে, তার প্রিমিয়াম। এটা সরকারিতে না থাকলে ধরা উচিত।

১০. অব্যবহৃত ছুটি ভাতা, অব্যবহৃত ছুটির আর্থিক মূল্য হিসাবে যোগ হয়।

১১. পেনশনকে মাসের খরচে ভাগ করে দেওয়া হয়।

১২. অন্যান্য কোনো সুবিধা যেমন গাড়ির খরচ, খাওয়ার খরচ ইত্যাদি।

তাহলে একজনের যদি বেসিক ৪০ হাজার হয়, তাঁর পুরো বেতন যা সরকার দিচ্ছে বা আমরা ট্যাক্স থেকে দিচ্ছি, তার সিটিজি ৯০ হাজারের কাছাকাছি হবে। আমাদের প্রতিটি সরকারি কর্মচারীর পেছনে সরকারকে কত মাসে বাস্তবে কত দিতে হচ্ছে, তা অন্যান্য সব দেশের মতো আধুনিক করতে হবে। এর ফলে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে ও কর্মচারী তাঁর মোট প্রাপ্তি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাবেন, যা ‘বেসিক কম, ভাতা বেশি’ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে, যা আসলে পুরোটাই বেতন।

ভারতের সপ্তম পে কমিশন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হয়েছিল, কিন্তু সেখানে সিটিসি ফরম্যাটে স্বচ্ছ ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করা হয়। এবং এখনকার চাকরি চুক্তিভিত্তিক। পারফরম্যান্স যোগ্যতা ও দক্ষতা ধরে রাখতে না পারলে নতুন কেউ আসবে।

সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন নির্ধারণে পারফরম্যান্সভিত্তিক অ্যালাউন্স বা ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে, যা বাংলাদেশে নেই। ইনক্রিমেন্ট কখনো কারও জন্য আজীবনের জন্য নির্দিষ্ট হতে পারে না। হতে হবে পারফরম্যান্সের ওপর। এটা অনেক দেশেই হচ্ছে। শুধু আমরা ব্যতিক্রম। যুক্তরাজ্যের মতো স্যালারি ট্রান্সপারেন্সি পোর্টাল বানালে কেউ আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

বেতনের সংকুলানের চাপ আমাদের ওপর কেন আসবে

আমাদের এতগুলো সরকারি অফিস, কিন্তু বেশির ভাগই নিজের আয় নিজেরা না করে সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বেতন, ভাতা ও পেনশন খাতে বরাদ্দ প্রায় ১ দশমিক ৫৮ ট্রিলিয়ন টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ। আমাদের উচ্চ অপারেশন খরচ বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় প্রথম দিকে থাকবে। অপারেশন খরচের ভার বহন করতে গিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা, উন্নয়ন, পরিবেশ, শিক্ষা, নিরাপত্তাসহ প্রয়োজনীয় খাতগুলোতে আমরা খরচ জোগান দিতে পারছি না। ফলে সব ক্ষেত্রেই দেশের সূচক নেমে যাচ্ছে।

নিজেরা আয় না করাতে এই টাকা সরকারের নিজের আয় থেকে দিতে হচ্ছে। এমনকি অনেক সময় সরকারের ধার করে দিতে হচ্ছে। এমনকি এই বিশাল খরচ জোগানোর জন্য যে পরিকল্পনা হচ্ছে, তা–ও সরকারি তিনটা খাতের সংস্কার বা খরচ কমিয়ে জোগানের কথা বলেছে, যা আসলে অন্য খাতকে আটকে দিয়েই হবে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর সব জায়গাতে হাত পড়লেও হাত পড়ে না আমাদের সরকারি খাতে। সবার সম্পত্তির হিসাব নেওয়ার কথা উঠলেও তা যে সত্যি কি না, কোনো তৃতীয় পক্ষ থেকে তদন্ত করে দেখা হয়নি। ফলে সব আগের মতোই চলছে।খরচ না কমিয়ে বাড়ানো কেন

বিগত সরকারের সময় অর্থনীতিবিদদের থেকে প্রস্তাবনা ছিল পরিচালনা ব্যয় ২০ শতাংশ কমানোর। কিন্তু এই সরকার তা কমানোর চেষ্টা না করে বরং বাড়িয়েছে। এদিকে অপ্রয়োজনীয় অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা শুধু খরচই করে, সেগুলা বন্ধ করার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এদিকে যে যে প্রতিষ্ঠান নিজেরা আয় করতে সক্ষম, সেগুলোকে নিজেদের আয়ে চলার কোনো সিদ্ধান্তও নেওয়া হয় না। যেহেতু নিজেদের আয়ে চলতে হয় না, তাই সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান থাকে লোকসানে। এবং তাদের খরচ মেটানোর দায় আমাদেরই।

প্রস্তাবিত পে কমিশন এখন পর্যন্ত আলোচনা অনুযায়ী ১৫ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর জন্য বরাদ্দ বাড়বে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। তাই অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের আয়ে চলার দায়িত্ব দিতে হবে। তারা নিজেদের আয়ে পারফরম্যান্স মতো বেতন নিলেও আমাদের কষ্ট হবে না। বিদ্যুৎ আর পানির ভর্তুকির দায় সরকার আমাদের ওপর দিয়ে দিলে, তাদের লসের ভর্তুকির দায় আমরা কেন নেব?

দুর্নীতি কি কমছে

ডেইলি স্টারের জরিপ অনুযায়ী ৭২ শতাংশ মানুষ মনে করেন পে স্কেল বৃদ্ধির আগে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। দুদকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-২০২৪ সময়কালে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ এবং সরকারি খাতে ৬০ শতাংশের বেশি কেস। বাস্তবে এই হার আরও বেশি হবে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্যমতে, কানাডার বেগম পাড়াতে বেশির ভাগ বাড়ি সরকারি কর্মকর্তাদের। ঢাকা ট্রিবিউনের মতে, ৫৬ শতাংশ সরকারি কর্মচারী সম্পদের ঘোষণা করেন না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০২১ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার বিভিন্ন সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এই ব্যাপারে কি কোনো ব্যবস্থা দেখেছেন?

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর সব জায়গাতে হাত পড়লেও হাত পড়ে না আমাদের সরকারি খাতে। সবার সম্পত্তির হিসাব নেওয়ার কথা উঠলেও তা যে সত্যি কি না, কোনো তৃতীয় পক্ষ থেকে তদন্ত করে দেখা হয়নি। ফলে সব আগের মতোই চলছে।

হ্যাঁ! পে স্কেল দরকার আমাদের যাঁরা সৎ কর্মচারী আছেন তাঁদের। এখন সরকার ভয়ে অসৎদের জন্য কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে, প্রকারান্তরে সৎ যাঁরা থাকতে চান, তাঁদেরও অসততার পথে ঠেলে দিচ্ছে। বেতন স্কেল দেওয়ার আগে তাই সবার সম্পদের হিসাব তদন্ত করে দুর্নীতিগ্রস্তদের বাদ দিয়ে পে স্কেল করলে আর কারও ক্ষোভ থাকত না। এটা হলে সরকারের খরচও কমত এবং কাজও অনেক গতিশীল হতো।

২০১৫ সালে যখন শেষ পে স্কেল হয়, তখন বলা হয়েছিল আর পে স্কেল হবে না। দুর্নীতি কমবে। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে? দেশে যে বিশাল দুর্নীতির টাকা পাচার হয়েছে, তার একটা বিশাল অংশের দায় সরকারি চাকরিজীবীদের একটা অংশের।সর্বজনীন পেনশন কেন সরকারিদের জন্য সর্বজনীন না

পেনশন খাতে একাই ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়, যা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা—দুই খাতের সম্মিলিত বরাদ্দের প্রায় সমান। বিগত সরকার বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে পেনশন স্কিম করলেও তা সরকারি কেউই তা গ্রহণ করতে চাননি। কারণ, তাঁরা জানেন এই নিজেরাই শর্ষের ভেতর ভূত লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু এটা সংস্কার করে তা যদি সবার জন্য বাধ্যতামূলক করত, তাহলে অনেক খরচ বেঁচে যেত। শুধু সরকারের খরচই না, সামাজিক নিরাপত্তাও ভূমিকা রাখতে পারত।

ট্যাক্স হতে হবে সর্বজনীন

আমরা ৯৫ শতাংশ বেসরকারি খাতের মানুষজন, আয়কর দিচ্ছেন মূল বেতনসহ সব ভাতার ওপর। আর সরকারি চাকরিজীবীরা দিচ্ছেন শুধু বেসিক বা মূল বেতনের ওপর। এই কারণেই আসলে তাঁরা চান না বেতনকাঠামো বেসিক কাঠামো থেকে সরে আধুনিক হোক। কিন্তু এই আইন দেশে দ্বৈত আইনের উদাহরণ, যা সাংবিধানিকভাবে অবৈধ।

দায় নিতে হবে সরকারি চাকরিজীবীদের

২০১৫ সালে যখন শেষ পে স্কেল হয়, তখন বলা হয়েছিল আর পে স্কেল হবে না। দুর্নীতি কমবে। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে? দেশে যে বিশাল দুর্নীতির টাকা পাচার হয়েছে, তার একটা বিশাল অংশের দায় সরকারি চাকরিজীবীদের একটা অংশের।

তারপর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও তাদের ছিল। সেই দায় পালনে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ। যদি তারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, তাহলে নতুন পে স্কেলের দাবি আসত না। শুধু তা–ই নয়, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের চাহিদামতো তারা মূল্যস্ফীতির মিথ্যা ডেটা দেখিয়ে এসেছে। ২০১৫ থেকে যদি আমরা সরকারি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাঁদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট এবং বিভিন্ন মহার্ঘ ভাতার সমন্বয় করি, তাহলে তাঁদের বর্তমান বেতনের সঙ্গে তা গত বছরের মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পর কাগজে–কলমে সমন্বয় হয়ে যায়।

তাহলে পে স্কেলের দাবি কেন? এখন তাঁরা অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করেন। অন্য মধ্যম আয়ের দেশে যেখানে কর জিডিপি অনুপাত ১৫ শতাংশের ওপর, সেখানে গত বছর আমাদের ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। আয় বাড়ানোর দায়িত্ব কার? আপনারা নিজেরদের কাজে ব্যর্থ, সেখানে প্রাইভেট সেক্টর হলে চাকরি নিয়ে টানাটানি থাকত আর আপনারা বেতন বাড়াতে বলেন? হ্যাঁ! এই অযোগ্যতার বলি হচ্ছে সৎ পরিশ্রমী মানুষজন।

এখন নিজেরা কি নিজেদের ভুল বা ব্যর্থতা বুঝতে পারবেন? না বুঝলে তো প্রতিবছরই একই অবস্থা হবে। নিজেদের ভুল না বুঝলে সংশোধন কীভাবে হবে?

মূল্যস্ফীতি কমানো হওয়া উচিত মূল লক্ষ্য

এই দেশে প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য স্নাতক পাস শিক্ষার্থীর শুরুতে সর্বমোট বেতন ২৫ হাজারের বেশি খুব একটা হয় না। যেখানে সরকারি ৯ম গ্রেডে যোগ দিলে মোট সুবিধা প্রায় ৬০ হাজার টাকার সমতুল্য সিটিজি। এখন পে স্কেল হওয়ার পর মার্কেটে একটা এলোমেলো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। চাকরির বাজারে তো অবশ্যই, সঙ্গে বাজারে। আমাদের মূল্যস্ফীতি যেখানে ৫ শতাংশে চলে আসার কথা ছিল, তা এখনো ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। এখন এই নতুন পে স্কেল কি নতুনভাবে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ানোর কাজ করবে না? আসল কাজ হওয়া উচিত ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। তাঁরা এই কাজে ব্যর্থ শুধু না, এই ব্যর্থতাকে দেখিয়ে এখন আরও মূল্যস্ফীতি বাড়ানোরই কাজ করা হচ্ছে।

নিজেদের জন্য নিজেরাই যখন প্রস্তাবক

সরকারি অন্য কমিশনগুলা খুব ধীরগতিতে কাজ করলেও পে কমিশন প্রতিদিনই মিটিং করছে নিজেদের অংশীজনদের সঙ্গে। কিন্তু তারা সংস্কারের কাজ না করে, নিজেদের বলয়ের মধ্যে কথা বলছে। একটা জনমত জরিপের ফরম অনলাইনে ছাড়া হয়েছে, তা এমনভাবে করা হয়েছে, নিজেদের চাওয়া উত্তরগুলোই যেন আসে। কমিটিতে কোনো এইচআর বা মানবসম্পদ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ নেই।

কথা বলা হচ্ছে না মূল অংশীদার বেসরকারি খাত নিয়ে, যারা এই অর্থ বরাদ্দ দেয়। প্রথম আলোর জরিপ মতে, ৬৮ শতাংশ ট্যাক্সদাতা মনে করেন সরকারি কর্মচারীরা পর্যাপ্ত সুবিধা পান। আমরা যদি পুরো বেতনকাঠামো আর পেশাগত দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে আধুনিক এইচআর বা মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার রীতি অনুসারে ঠিক না করে, আবারও ৫ বছর পর আরেকটি পে কমিশনের জন্য পথ রেখে যাচ্ছি।

আগামী বছর আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন সরকার আসবে, এ ছাড়া নভেম্বরে আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ ঘটবে, তখন আমাদের অনেক সুবিধা বাতিল হবে। তখন দরকার ব্যয় সংকোচন।

হ্যাঁ! আমাদের সৎ কর্মচারীরা সমস্যায় আছেন। এই সমস্যা যাতে বারবার না হয়, তার জন্য দরকার পুরো কাঠামোর টেকসই সংস্কার। সরকারি পে স্কেল সংস্কার প্রয়োজন, তবে তা হতে হবে স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তিতে। দুর্নীতিগ্রস্তদের বাদ দিয়ে, সিটিজি কাঠামোতে, সর্বজনীন ট্যাক্স ও পেনশন ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি ন্যায্য ও টেকসই পে স্কেল বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে, সরকারি খাতের বাইরের জনগণের ওপর চাপ বাড়তেই থাকবে, যা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য।

সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রফরম য ন স চ কর জ ব দ র ব তনক ঠ ম দ র জন য র আম দ র প রস ত ব ব যবস থ য় সরক র ন সরক র সরক র র র সরক র অন য য় বর দ দ প নশন দশম ক র খরচ ট কসই র ওপর র একট

এছাড়াও পড়ুন:

নাইজেরিয়ায় যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্পের বিপজ্জনক জুয়া

আবার শুরু। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাইজেরিয়ায় সামরিক শক্তি মোতায়েন করার সর্বশেষ হুমকি ওয়াশিংটনের চিরন্তন বিভ্রান্তির আরেকটি অধ্যায় উপস্থাপন করছে। সেটা হলো আমেরিকান শক্তি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে থাকা একটি জটিল সমাজকেও পুনর্গঠন করতে পারে। 

সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান, মার্কিন স্বার্থ রক্ষা বা গণতন্ত্রের বিকাশ—যে যুক্তিই দেওয়া হোক না কেন, সেটি অতিপরিচিত চিত্রনাট্যের পুনরাবৃত্তি মাত্র। আমরা সেটি ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ও আফগানিস্তানে আগেও দেখেছি। এসব গল্পের মূল জমিনটা কখনোই বদলায় না। প্রথমে সামরিক সাফল্য, এরপর সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, অনিচ্ছাকৃত পরিণতি এবং শেষমেশ বিশৃঙ্খলভাবে মার্কিনদের পিছু হটা।

নাইজেরিয়ার জনসংখ্যা ২২ কোটি। এটি আফ্রিকার বৃহত্তম অর্থনীতি এবং সবচেয়ে জনবহুল দেশ। মুসলিম–অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চল এবং খ্রিষ্টান–অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চল জাতিগত উত্তেজনায় গভীরভাবে বিভক্ত। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইসলামপন্থী বিদ্রোহ, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দেশটিতে রয়েছে। সারা দেশে দুর্নীতি মহামারির রূপ নিয়েছে। এই জটিল ও অস্থিতিশীল একটি দেশে ট্রাম্প মার্কিন সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব করেছেন। তাঁর এ প্রস্তাব ঠিকঠাক বলেই মনে হচ্ছে?

আরও পড়ুনট্রাম্প কেন মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চান১২ নভেম্বর ২০২৫

বাস্তবসম্মত মূল্যায়নটা এখানে স্পষ্ট—নাইজেরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য সরাসরি কোনো হুমকি নয়। সন্ত্রাসবাদ, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতার মতো নাইজেরিয়ায় যেসব সমস্যা ওয়াশিংটন অনুভব করছে, তার কোনোটিই সামরিক হস্তক্ষেপকে যৌক্তিক করে না। বোকো হারাম বিদ্রোহ, যতই ট্র্যাজিক হোক না কেন, সেটা একটি আঞ্চলিক সমস্যা, মার্কিন সমস্যা নয়।

এ ছাড়া বাস্তব বাধাগুলোও অত্যন্ত জটিল। নাইজেরিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার ঘনত্ব ও রাজনৈতিক জটিলতা—সব মিলিয়ে দেশটি ইরাক বা আফগানিস্তানের তুলনায় অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও নাইজেরিয়ার সামরিক বাহিনী বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো আঞ্চলিক শক্তিও এই হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করবে। আফ্রিকান ইউনিয়নও নিন্দা করবে। তাহলে আর কোন কৌশলগত লাভটা এখানে থেকে থাকতে পারে?

যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে নাইজেরিয়ার যা দরকার, সেটা সামরিক হস্তক্ষেপ নয়; বরং বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও এমন কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা, যা দেশটির সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ওয়াশিংটনের উচিত আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করা, আফ্রিকানদের নেতৃত্বে পরিচালিত সমাধানগুলোকে সমর্থন দেওয়া এবং মার্কিন শক্তির সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করা।

যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ যুক্তি হতে পারে, আমরা যদি না করি, তাহলে অন্য কেউ কেউ শূন্যস্থান পূরণ করবে। সম্ভবত চীন বা রাশিয়া। এই জিরো সাম চিন্তাপদ্ধতি এই বাস্তবতা উপেক্ষা করে যে প্রতিটি বৈশ্বিক সমস্যায় মার্কিন সমাধান প্রয়োজন নয়। নাইজেরিয়ার চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করতে হবে আফ্রিকার আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সমর্থনে নাইজেরিয়ানদের নিজস্ব উপায়ে।

আমেরিকা যখন নিজস্ব আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তখন নাইজেরিয়ায় সামরিক শক্তি মোতায়েনের অর্থনৈতিক ব্যয়ও ভয়াবহ হবে। যুক্তরাষ্ট্র, নাইজেরিয়া—দুই দেশের মানবিক ক্ষয়ক্ষতিও হবে অসীম। আর রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে আফ্রিকা ও বৈশ্বিক দক্ষিণে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা অনেকখানি ক্ষয় পাবে। কয়েক দশকের দ্বিচারিতার কারণে এমনিতেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন ভাবমূর্তি এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ট্রাম্পের এই হুমকি একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে দ্বিদলীয় অবাস্তব চিন্তার ধারাবাহিকতারই বহিঃপ্রকাশ। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট—কেউই এটা বুঝতে, শিখতে সক্ষম নয় যে সামরিক শক্তি রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে না। কোনো একটি দেশ নির্মাণের প্রকল্প কখনো কাজ করে না, যখন সেই দেশ নিজেই চায় না যে বিদেশিরা সেটা গড়ে তুলুক।

পরিহাসটা কিন্তু গভীর। একজন প্রেসিডেন্ট, যিনি ‘অনন্ত যুদ্ধ’ শেষ করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছিলেন, এখন তিনি পশ্চিম আফ্রিকায় নতুন যুদ্ধের কথা ভাবছেন। ট্রাম্পের এই হুমকির পেছনে নাইজেরিয়া যতটা তার চেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মঞ্চে শক্তি প্রদর্শন করা, দেশের সমস্যা থেকে জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরানো এবং সমর্থকগোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করা।

যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে নাইজেরিয়ার যা দরকার, সেটা সামরিক হস্তক্ষেপ নয়; বরং বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও এমন কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা, যা দেশটির সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ওয়াশিংটনের উচিত আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করা, আফ্রিকানদের নেতৃত্বে পরিচালিত সমাধানগুলোকে সমর্থন দেওয়া এবং মার্কিন শক্তির সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করা।

ট্রাম্পের জন্য সবচেয়ে সেরা কাজটা হবে নাইজেরিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি ব৵র্থ সামরিক অভিযানে যুক্ত করার প্রলোভন থেকে সরে আসা। কিন্তু এর জন্য দরকার প্রজ্ঞা, সংযম এবং মার্কিন স্বার্থ ও সামর্থ্যের বাস্তব মূল্যায়ন। এই গুণগুলো ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারকদের মধ্যে বরাবরই অনুপস্থিত।

বাস্তবসম্মত অবস্থান এখানে স্পষ্ট, সেটা হলো দূরে থাকুন। নাইজেরিয়ার সমস্যার সমাধান নাইজেরিয়ার নাগরিকদের করতে দিন। মার্কিন সম্পদকে প্রকৃত নিরাপত্তা-হুমকির মোকাবিলায় ব্যয় করুন। এই বিভ্রান্তি ত্যাগ করুন যে বিশ্বের প্রতিটি সংকটেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রতিক্রিয়া প্রয়োজন।

লিওন হাডার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ