১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল, আজ তিনি শতবর্ষ পেরোলেন। অবশ্য এ জগৎ থেকে তিনি বিদায় নিয়েছেন অর্ধশত বছর আগে। তিনি জড়িয়ে আছেন এ দেশের জন্মের সঙ্গে। বিস্মরণের ভেতর থেকে তাঁর স্মৃতি জেগে ওঠে মাঝেমধ্যে। তিনি তাজউদ্দীন আহমদ, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগ ছয় দফা কর্মসূচি নিয়ে এগোচ্ছিল। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ অপ্রত্যাশিতভাবে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হলে এ দেশে অভূতপূর্ব গণবিদ্রোহ হয়। ৩ মার্চ রাতে ধানমন্ডিতে সে সময়ে বাঙালির প্রধান নেতা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে এলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতিনিধি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। মুজিব খুব ক্ষুব্ধ। বললেন, এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও তাঁরা আলোচনা করতে ইচ্ছুক।
বাদ সাধলেন মুজিবের সহকর্মী তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, এই নৃশংসতার পর ভুট্টোর সঙ্গে এক ছাদের নিচে আর বসা যায় না। জাতীয় পরিষদ দুই ভাগ হয়ে যাক। একটি পূর্ব আর একটি পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। প্রত্যেক পরিষদ নিজ অংশের জন্য সংবিধান তৈরি করুক। পরে দুই পরিষদ একসঙ্গে বসে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান লিখতে পারে।
তাজউদ্দীন স্পষ্টতই পাকিস্তান ভেঙে দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তারপরও ২৪ মার্চ পর্যন্ত আলোচনার নামে কালক্ষেপণ হয়। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালির ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধযুদ্ধ।
২৫ মার্চ রাতে দেয়ালে আমাদের পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। আমাদের সামনে কী কী বিকল্প ছিল? আমরা একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারতাম। শেখ মুজিবের হিসাব ছিল ভিন্ন। সশস্ত্র স্বাধীনতার লড়াইয়ের যে অনিশ্চিত, কষ্টকর, কণ্টকাকীর্ণ পথ, সে পথে তিনি যাননি। তাহলে লড়াইটা হবে কীভাবে?
প্রতিবেশী ভারত সীমান্ত খুলে দিল। দলের অন্য নেতারা ও তরুণদের একটা অংশ ছুটল সীমান্তের দিকে। ভারত তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও সামরিক সহযোগিতা দিল। এই কালবেলায় তাজউদ্দীন এককভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে চলে যান নয়াদিল্লি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে ১০ এপ্রিল গঠন করেন বাংলাদেশ সরকার। এই সরকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আমবাগানে। সরকারের ঠাঁই হয় কলকাতার থিয়েটার রোডের একটি দোতলা বাড়িতে।
ভারতে আশ্রয় নেওয়া এবং তাদের সাহায্য নিয়ে সরকার গঠন করার মধ্যেই ছিল একধরনের সমীকরণ ও সংকট। বাংলাদেশের যুদ্ধ একই সঙ্গে হয়ে যায় ভারতের যুদ্ধ। প্রবাসী সরকারের নিউক্লিয়াস ছিলেন তাজউদ্দীন। ভারতের আশ্রয়ে থাকার কারণেই তাঁকে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা এড়ানো যেত না। কেউ পারতেন না। ফলে যুদ্ধে একপর্যায়ে চালকের আসনে বসে যায় ভারত। তাজউদ্দীনের কপালে কেউ কেউ যুক্ত করে দেয় ‘ভারতের দালাল’ তকমা। চার বছর পর তাঁকে জীবন হারাতে হয় এই ‘কলঙ্ক’ নিয়ে।
মুজিবের অনুপস্থিতিতে ভারতে গিয়ে সরকার গঠনের বিকল্প ছিল না। দলের অন্যান্য নেতার প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও তাজউদ্দীন এ কাজটা করেছিলেন। দলের মধ্যে তিনি কোন্দলের শিকার হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর প্রবল সমর্থন নিয়েই তিনি ও তাঁর সরকার টিকে ছিল। যুদ্ধ শেষে চালচিত্র বদলে যায়। তাঁকে বাদ দিয়েই দেশটা এভাবে স্বাধীন হয়ে যাবে, এটা মুজিবের মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাজউদ্দীন ধীরে ধীরে ব্রাত্য হয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল শেখ মুজিবের নামে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত নেতা ছিলেন তাজউদ্দীন। আর তিনিই হলেন এর প্রথম শিকার।
প্রশ্ন হলো, ইতিহাস তাজউদ্দীনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে? আমাদের মতো দেশে রাজনৈতিক দলে যৌথ নেতৃত্ব একটি কল্পনাবিলাস মাত্র। আওয়ামী লীগে নেতা ছিলেন একজনই—শেখ মুজিব। দলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর ‘কাল্ট’। তাঁর ছায়ায় ঢাকা পড়েছিলেন তাজউদ্দীন। একাত্তরের ওই ক্রান্তিলগ্নে মুজিবের অনুপস্থিতিতে তিনি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলেই স্বাধীন বাংলার সরকার গঠন সম্ভব হয়েছিল। তা না হলে বাংলাদেশ হয়তো আরও অনেক দিন থেকে যেত পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে। কে জানে, আমাদের অবস্থা হয়তো হতো মিজোরাম কিংবা বেলুচিস্তানের মতো। জাতিসংঘের একটি পূর্ণ সদস্যরাষ্ট্র ভেঙে আরেকটি রাষ্ট্র তৈরি হওয়া তো একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। সেটিই ঘটে গেল একাত্তরে। তাজউদ্দীন ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন।
দেশ মুক্ত হলো। শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে ফিরে এলেন, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন। তাজউদ্দীন হলেন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী। একই সঙ্গে হলেন পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান। কিছুদিন পর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কেড়ে নেওয়া হলো তাঁর কাছ থেকে। দুই বছর পর তিনি বরখাস্ত হলেন সেখান থেকেও। মুজিব অবশ্য শিষ্টাচার মেনে কাজটা করেননি। তিনি একটা পদত্যাগপত্র লিখে প্রতিস্বাক্ষর করে পাঠিয়ে দেন তাজউদ্দীনের কাছে। তাজউদ্দীন তাতে সই দিয়ে দেন।
একটা ভবন তৈরি করতে অনেকগুলো স্তম্ভ লাগে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাজউদ্দীন যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ছিলেন, তা অস্বীকার করা যায় না। অথচ বিনিময়ে তিনি পেয়েছেন উপেক্ষা। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ার পর তাঁকে নিয়ে সরকারি পত্রিকা বিচিত্রায় যে প্রচ্ছদকাহিনি ছাপা হয়েছিল, তাতে তাঁর চরিত্র হনন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের নায়কের এই অপমান প্রাপ্য ছিল না।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি সফল ছিলেন না বলে একটা প্রচার আছে। অথচ পুরো সরকারই ব্যর্থ বলে সমালোচিত হয়েছিল। সরকারপ্রধানের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কি তাঁর কিছু করার উপায় ছিল?
তাজউদ্দীন ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, মার্জিত, রুচিবান। রাজনীতি করতে হলে যে আগ্রাসী মেজাজ লাগে, এটি তাঁর ছিল না। নানা ফন্দিফিকির তিনি বুঝতেন না। একসময় রাজনীতির দাবা খেলায় তিনি হয়ে যান অচল ঘুঁটি। দলের মধ্যে থেকে দলের সমালোচনা করেছেন। বাকশালের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু সংসদ থেকে পদত্যাগ করেননি। মোসাহেব হননি। বিদ্রোহ করে বিকল্প পথের সন্ধান করেননি। সেই ইচ্ছা কিংবা সাহস তাঁর ছিল না।
তাজউদ্দীন নামে একজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নামে তাঁকে নিয়ে লেখা আমার একটি বই আছে। সত্যিই তাজউদ্দীন নামে যে এ দেশে একজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, এটা আমরা ভুলতে বসেছি। রাজনীতি ও জীবন উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর প্রস্থান বিয়োগান্ত।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন ত জউদ দ ন মন ত র আম দ র র জন ত হয় ছ ল র একট সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
দুই মিনিটের বিতর্কিত দৃশ্য দিয়ে আলোচনায়, পরে বলিউডকে বিদায় জানান সেই অভিনেত্রী
বলিউডের ইতিহাসে এমন অনেক অভিনেত্রী আছেন, যাঁরা শূন্য থেকে শুরু করে রাতারাতি পরিচিতি পেয়েছেন; পরে আবার হঠাৎই হারিয়ে গেছেন। কিমি কাতকার তেমনই একজন। ১৯৮০-এর দশকে বলিউডে তিনি ছিলেন আলোচিত ও সাহসী অভিনেত্রীদের একজন।
কিমির উত্থান
আশির দশকটি বলিউডে সৃজনশীল ও পরিবর্তনের সময় ছিল, যেখানে অনেক প্রতিভাবান অভিনেতা-অভিনেত্রী তাঁদের ছাপ ফেলেছেন। কিমি ছিলেন সেই সময়ের অন্যতম উদীয়মান নায়িকা। পর্দায় সাহসী দৃশ্যের জন্য তিনি ব্যাপক পরিচিতি পান। যদিও তাঁর চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত; কিন্তু এর মধ্যেই ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেন।
মুম্বাইতে জন্ম নেওয়া কিমি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন মডেল হিসেবে, পরে তিনি চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। ১৯৮৫ সালে ‘অ্যাডভেঞ্চার অব টারজান’ দিয়ে আলোচিত হন তিনি। সিনেমার সাফল্য তাঁকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে। হেমন্ত বীরজের সঙ্গে জুটি বেঁধে তিনি দর্শকদের মন মাতিয়ে দেন। তবে এ ছবিতেই একটি নগ্ন দৃশ্যে অভিনয় করে রাতারাতি আলোচনায় আসেন। দৃশ্যটি নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে অভিনেত্রী বলেছিলেন, ‘সেই সময় আমি জানতাম না এই দৃশ্য কতটা বিতর্কিত হবে। কিন্তু অভিনয় আমার জন্য সব সময় ছিল সত্যিই একটি চ্যালেঞ্জ।’ এরপর ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে অমিতাভ বচ্চন, অনিল কাপুর, গোবিন্দ ও আদিত্য পঞ্চোলির সঙ্গেও সিনেমা করেন তিনি। তাঁর নাচ ও অভিনয়ের দক্ষতা দর্শকদের কাছে তাঁকে প্রিয় করে তোলে।
‘অ্যাডভেঞ্চার অব টারজান’-এ কিমি কাতকার। আইএমডিবি