ইবনে হাইম মাকদিসি ছিলেন বিখ্যাত ইসলামবেত্তা ইবনে হাজার আসকালানির (রহ.) শিক্ষক। ফিলিস্তিনের ইতিহাসে অসংখ্য পণ্ডিত ইসলামি জ্ঞান ও সংস্কৃতির অগ্রগতিতে অবদান রেখেছেন, ইবনে হাইম তাঁদের অন্যতম।
ইবনে হাজার (রহ.) তাঁর সম্পর্কে বলেন, তিনি গণিত ও ‘ফারায়েজ’ শাস্ত্রে সমসাময়িকদের তুলনায় ছিলেন শ্রেষ্ঠ, আর এ জন্য দূরদূরান্ত থেকে মানুষ তাঁর কাছে জ্ঞান অর্জনের জন্য আসত। (ইবনে হাজার, ইনাবা, ১৯৯৪, ২/৫২৫)
ইবনে হাইম একাধারে ফিকহ, গণিত, ব্যাকরণ, কবিতা ও ফারায়েজ (উত্তরাধিকার হিসাব) বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। ফারায়েজ শাস্ত্রে বিশেষ দক্ষতার কারণে তিনি ইবনে হাইম আল-ফারায়েজি নামেও পরিচিত ছিলেন।
তিনি গণিত এবং উত্তরাধিকার হিসাবে সমসাময়িকদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন, যাঁর জন্য দূরদূরান্ত থেকে মানুষ তাঁর কাছে জ্ঞান অর্জনের জন্য আসতেন।ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.), ইনাবা, ১৯৯৪, ২/৫২৫
তাঁকে জেরুজালেমের পণ্ডিত বলা হলেও তাঁর জন্ম হয় কায়রোতে আল-কারাফা আল-সুগরা এলাকায় ৭৫৩ বা ৭৫৬ হিজরি (১৩৫২ বা ১৩৫৪ খ্রি.) সালে। পুরো নাম শিহাব আল-দীন আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইমাদ ইবনে আলী আল-কারাফি আল-মাকদিসি।
আরও পড়ুনপৃথিবীতে মহানবী (সা.)–র অবদান: ১৩০ মার্চ ২০২৩বেড়ে ওঠেন জেরুজালেমে এবং সেখানেই থিতু হন। মুকাদ্দাস বা পবিত্র ভূমির সঙ্গে সম্পর্কের কারণে তাঁর নাম হয় ‘মাকদিসি’। তিনি ৮১৫ হিজরি (১৪১২ খ্রি.) সালে জেরুজালেমে মৃত্যুবরণ করেন এবং মামান আল্লাহ কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। (আল-উলায়মি, আব্দ আল-রহমান ইবনে মুহাম্মদ, আল-উনস আল-জালিল বি-তারিখ আল-কুদস ওয়া আল-খালিল, মিসর: আল-মাতবাআ আল-ওয়াহাবিয়্যা, ১২৮৩ হিজরি, ২/৪৫৫)
শৈশবে তিনি কোরআন মুখস্থ করে হাফেজ হন। এরপর হাদিস শেখেন এবং আরবি ভাষা ও ধর্মীয় বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন। তিনি কায়রোর জামে আজহারের মজলিসে অংশ নেন। তারপর তরুণ বয়সে জেরুজালেমে চলে যান। যেখানে তিনি সিরাজ আল-দীন আল-বুলকিনি (১৩২৪-১৪০২), আবু আল-হাসান আল-জালাওয়ি আল-মালিকি (মৃ. ১৩৮১), আল-জামাল আল-আমিউতি (১৩১৫-১৩৮৮) প্রমুখের মতো বিখ্যাত পণ্ডিতদের অধীনে শিক্ষাগ্রহণ করেন।
ইবনে হাইম ফিকহ, গণিত, ব্যাকরণ ও কবিতায় অসাধারণ জ্ঞান অর্জন করেন। জটিল গণিত ও বৈজ্ঞানিক সমস্যাকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করার অসামান্য ক্ষমতা ছিল তার। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও শিক্ষাদানের দক্ষতা তাঁকে জেরুজালেমের পণ্ডিতদের মধ্যে সম্মানিত করে এবং তিনি আল-সালিহিয়া স্কুলের প্রধান নিযুক্ত হন (আল-হাসানি, সালিম, ইন অনার অব ইবনে হাইম: স্কলার অ্যান্ড ম্যাথমেটিশিয়ান অব জেরুজালেম, প্রকাশিত ২৬ জুন ২০২৫)।
ইবনে হাইম ফিকহ, গণিত, ব্যাকরণ ও কবিতায় অসাধারণ জ্ঞান অর্জন করেন। জটিল গণিত ও বৈজ্ঞানিক সমস্যাকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করার অসামান্য ক্ষমতা ছিল তার।আরও পড়ুনইউরোপের নির্মাণে ইসলামের অবদান২৭ আগস্ট ২০২৩গণিতে অবদানবিশেষ করে উত্তরাধিকার হিসাব (ফারায়েজ) ও বীজগণিতে ইবনে হাইমের গণিতে অবদান উল্লেখযোগ্য। তিনি সমকালীন সমাজের জন্য ব্যবহারিক গণিতের দিকে মনোযোগ দেন, যা ইসলামি উত্তরাধিকার আইনের জটিল হিসাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো।
তাঁর গণিতের কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুরশিদাত আল-তালিব ইলা আসনা আল-মাতালিব ফি ইলম আল-হিসাব, যা তিনি ২৭ বা ৩০ বছর বয়সে (৭৮৩ হি./১৩৮১ খ্রি.) সম্পন্ন করেন। এই গ্রন্থে তিনি পূর্ণ সংখ্যা, ভগ্নাংশ এবং আনুপাতিক সংখ্যার হিসাব নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি এটি সংক্ষিপ্ত করে নুযহাত আল-নুযযার ফি সিনায়াত আল-গুবার নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে ডাস্ট বোর্ড হিসাব (অর্থাৎ বালুর ওপর হিসাবের পদ্ধতি) নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
তাঁর অন্যান্য গণিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে পূর্ণ সংখ্যার গুণ, ভাগ ও ভগ্নাংশবিষয়ক আল-লাম ফি আল-হিসাব, ইবনে আল-বান্না আল-মাররাকুশির বীজগণিত ও আনুপাতিক সংখ্যা নিয়ে রচনার সংক্ষিপ্তসার আল-হাওয়ি ফি ইলম আল-হিসাব, মৌলিক ও যৌগিক সংখ্যা পৃথক করার পদ্ধতি সম্পর্কে লেখা রিসালাহ ফি আল-গিরবাল, বীজগণিতের অজানা মান গণনার পদ্ধতি নিয়ে রচিত ৫৯টি ছন্দোবদ্ধ পঙ্ক্তির একটি কাব্য আল-মুকনি ফি আল-জাবর ওয়া আল-মুকাবালাহ প্রভৃতি।
উত্তরাধিকার হিসাবে অবদানইবনে হাইমের উত্তরাধিকার হিসাবে অবদান ইসলামি আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইসলামি উত্তরাধিকার আইন (ইলম আল-ফারায়েজ) জটিল হিসাবের ওপর নির্ভরশীল, যা সম্পত্তি বণ্টনের জন্য সঠিক গণনার প্রয়োজন। তিনি এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন, যা তার সময়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আল-তুহফাহ আল-কুদসিয়্যাহ ফি ইখতিসার আল-রাহবিয়্যাহ। গ্রন্থটি মিসরের জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রয়েছে (নং–৩৯৬৪ জে, ১৪৫৭ খ্রি.)। এ ছাড়া মরক্কোর রাবাত আল-ফাতহ গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত (নং–২১৫/১৫৫) আরেকটি গ্রন্থ হলো আল-শুব্বাক (আল-মুনাসাখাত বি আল-জাদওয়াল)।
আরও পড়ুনটিকাদানে ওসমানিয়া নারীদের অবদান১৬ জুন ২০২৫কেবল গণিতবিদই ছিলেন না, তিনি ফিকহ, তাফসির ও ব্যাকরণেও অসাধারণ অবদান রেখেছেন। ফিকহ ও উসুলে ফিকহের অন্তত পাঁচটি গ্রন্থ লিখেছেন। কবিতায়ও দক্ষ ছিলেন।অন্যান্য শাস্ত্রেইবনে হাইম কেবল গণিতবিদই ছিলেন না, তিনি ফিকহ, তাফসির ও ব্যাকরণেও অসাধারণ অবদান রেখেছেন। ফিকহ ও উসুলে ফিকহের অন্তত পাঁচটি গ্রন্থ লিখেছেন তিনি। ফিকহের আর্থিক লেনদেন বিষয়ে যেমন লিখেছেন, তেমনি কোরআনের অপরিচিত শব্দের তাফসির বিষয়েও গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি কবিতায়ও দক্ষ ছিলেন এবং তাঁর একটি দিওয়ান (কবিতার সংকলন) রয়েছে।
তাঁর গ্রন্থসমূহ মিসরের জাতীয় গ্রন্থাগার, আল-জাহিরিয়া গ্রন্থাগার, তিউনিসিয়ার জাতীয় গ্রন্থাগার এবং তুরস্কের বিভিন্ন গ্রন্থাগার আজও সংরক্ষিত রয়েছে। প্রতিটি গ্রন্থের ওপর একাধিক টীকা ও ব্যাখ্যাগ্রন্থও প্রকাশ পেয়েছে, যা সমকালে তাঁর কাজের প্রভাব ও জনপ্রিয়তার সাক্ষ্য দেয়।
উল্লেখযোগ্য ছাত্রইবনে হাইমের শিক্ষাদানের প্রভাব প্রকাশ পায় তাঁর ছাত্রদের মাধ্যমে। বিখ্যাত হাদিস পণ্ডিত ও ঐতিহাসিক ইবনে হাজার আসকালানি (১৩৭১-১৪৪৯) ছিলেন তাঁর সরাসরি ছাত্র। এবং ইবনে হাইম সম্পের্ক বেশির ভাগ তথ্যও আসকালানির ‘ইনাবা’ থেকে জানা যায়।
এ ছাড়া শাফিয়ি ফকিহ আহমদ ইবন হুসায়ন আল-রামলি আল-মাকদিসি (১৩৩২/১৩৭৩-১৪৫০) এবং মালিকি ফিকহ ও বিচারক মুহাম্মদ ইবনে আহমদ শামস আল-দীন আল-বিসাতিও (১৩৫৮-১৪৩৮) তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
সূত্র: মুসলিম হেরিটেজ
আরও পড়ুন সাহাবির অবদান ও ত্যাগের গল্প০৯ নভেম্বর ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ রন থ গ র ব য করণ ও গ রন থ র র অবদ ন আসক ল ন আল ম ক আল হ স ন কর ন ল গণ ত গণ ত ও র জন য ন ইবন দ ইবন ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
জকসুসহ তিন দফা দাবি মেনে নিল প্রশাসন, ৩২ ঘণ্টা পর অনশন ভাঙলেন শিক্ষার্থীরা
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা ও সম্পূরক বৃত্তিসহ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবি মেনে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের আশ্বাসে ৩২ ঘণ্টা পর অনশন ভেঙে কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
বুধবার রাত দশটার দিকে প্রশাসনের পক্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিলে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় অনশনরত শিক্ষার্থীদের ফলের রস খাইয়ে অনশন ভাঙানো হয়। শিক্ষার্থীদের অনশন ভঙ্গ করান করান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক ও সিন্ডিকেট সদস্য বিলাল হোসাইন।
এর আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক শেখ গিয়াসউদ্দিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আগামী ২৭ নভেম্বর জকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই মোতাবেক নির্বাচনের রূপরেখাও ঘোষণা করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, আগামী জানুয়ারি থেকে আবাসন ভাতা পাবেন শিক্ষার্থীরা। সেই সঙ্গে বৃত্তির জন্য উপযুক্ত শিক্ষার্থীদের নভেম্বরের মধ্যে যাচাই-বাছাই করার কাজ শেষ করা হবে।
অনশনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রক্টর মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী ২৭ নভেম্বরের আগেই কেন্দ্রীয় পাঠাগারে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র স্থাপন করা হবে। ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের মানোন্নয়নে প্রশাসন কাজ করবে।
আরও পড়ুনতিন দাবিতে ২৪ ঘণ্টা ধরে ৪ শিক্ষার্থীর অনশন, দুজন অসুস্থ১২ ঘণ্টা আগেএ সময় অনশনে বসা উদ্ভিদ বিজ্ঞানের বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এ কে এম রাকিব বলেন, আমাদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন। জকসুর রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। আবাসন ভাতার জন্য প্রতিশ্রুত সময়ও দিয়েছে প্রশাসন। কেন্দ্রীয় পাঠাগারে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র স্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ কারণে আমরা অনশন ভেঙে আন্দোলন প্রত্যাহার করেছি।
সতর্ক করে দিয়ে এ কে এম রাকিব আরও বলেন, যদি প্রশাসন ঘোষিত সময়ের মধ্যে আমাদের দাবিগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সমস্ত দায় মাথায় নিয়ে সম্পূর্ণ প্রশাসনকে পদত্যাগ করতে হবে।
এর আগে তিন দফা দাবি আদায়ে গত মঙ্গলবার বেলা দুইটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাশহীদ রফিক ভবনের নিচে অনশন শুরু করেন চারজন শিক্ষার্থী। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) পক্ষ থেকে অনশন কর্মসূচি শুরুর কথা জানানো হয়। অনশনে বসা চার শিক্ষার্থীর মধ্যে তিনজন বাগছাসের নেতা।
আরও পড়ুনজকসু নির্বাচনের রূপরেখা ঘোষণা, ভোট ২৭ নভেম্বর২ ঘণ্টা আগে