বইয়ের প্রতি ভালোবাসায় বেঁচে গেছে আকাফ
Published: 23rd, July 2025 GMT
আকাফ আদিয়াত সোয়াদ। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। রুটিন অনুযায়ী গত সোমবারও স্কুলে গিয়েছিল আকাফ। ক্লাস শেষে স্পেশাল বৃত্তি ব্যাচের কোচিং ক্লাস করার কথা ছিল। কোচিং ক্লাসের জন্য নির্ধারিত কক্ষেও গিয়েছিল সে। তবে সেখানে ব্যাগ রেখে আকাফ সহপাঠীদের নিয়ে বইমেলায় যায়। এটাই শাপে বর হয়েছে ওর জন্য। জীবন বেঁচেছে আকাফের।
ঘড়িতে তখন বেলা একটা। স্কুল ভবনের ১০১ নম্বর কক্ষে ক্লাস শেষ হয় আকাফের। এরপর সে একই ভবনের ১০৯ নম্বর কক্ষে চলে যায়। সেখানেই কোচিং ক্লাস হওয়ার কথা। ওই কক্ষে ব্যাগ রেখে বেরিয়ে যায় আকাফ। পাশেই স্কুলের ইংরেজি ভার্সনের ভবনে বইমেলা চলছিল। বই পড়তে ভালোবাসে সে। তাই বন্ধু–সহপাঠীদের নিয়ে বইমেলায় গিয়েছিল সে।
এর পরপর বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান আছড়ে পরে ভবনটিতে। বিকট শব্দের বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরো স্কুল চত্বর। মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভবনজুড়ে। যেই ভবনে আকাফের ক্লাসরুম, কোচিং রুম, সেখানে যেন বিভীষিকা নেমে আসে।
আকাফের সঙ্গে আজ বুধবার সকালে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের কথা হয়। পাশে ছিলেন শিশুটির মা রীনা নাসরিন। তাঁরা তখন স্কুলের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে। ছেলের ফেলে যাওয়া ব্যাগ নিতে এসেছেন এই মা।
রীনা নাসরিন বললেন, ‘আকাফের কোচিংয়ের শিক্ষক গ্রুপে (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে) মেসেজ দিছেন, ব্যাগটা তাঁর জিম্মায় আছে। কিন্তু আজ তিনি স্কুলে আসেননি। আমরা তাই ঢুকতে পারিনি।’
আরও পড়ুননিজেই স্কুলড্রেস পরে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে স্কুলে গিয়েছিল ছোট্ট জুনায়েত ২ ঘণ্টা আগেবিমান বিধ্বস্তের দিনের কথা জানতে চাইলে আকাফ বলে, ‘আমি তখন বইমেলায় ছিলাম। হঠাৎ করে অনেক জোরে একটা শব্দ হইল। বাইরে আইসা দেখি, আমাদের ভবনের সিঁড়ির পাশে দাউ দাউ কইরা আগুন জ্বলতেছে। আর ধোঁয়া চারদিকে ছড়ায় গেছে। সবাই চিৎকার কইরা দৌড়াচ্ছে।’
আরও পড়ুনমাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান ফটক বন্ধ, সকালে অনেকটাই ফাঁকা২ ঘণ্টা আগেআকাফ জানায়, কয়েকজন বন্ধু–সহপাঠীসহ বইমেলায় না গেলে তখন সে ওই কোচিং ক্লাসেই থাকত। চোখের সামনে বিমান বিধ্বস্ত, আগুন, মৃত্যু—মুহূর্তের মধ্যে এত এত বিভীষিকা দেখেছে সে। এখনো সেই ভীতির রেশ কাটেনি শিশুটির।
আকাফ জানায়, স্পেশাল বৃত্তি ব্যাচে পাঁচজন ছিল ওর গ্রুপ থেকে। অন্য তিনটি গ্রুপের আরও ১৫ থেকে ১৬ জন ছিল একই ব্যাচে। বইমেলায় যাওয়ার আগে কয়েকজন ব্যাগ রেখে বেড়িয়ে গিয়েছিল। অন্যরা তখন ওই কক্ষে ছিল কি না, নিশ্চিত করে বলতে পারে না সে।
রীনা নাসরিন জানালেন, পরিবার নিয়ে তুরাগের নয়ানগর শুক্রাভাঙ্গা এলাকায় থাকেন তিনি। ছেলের যে কোনো ক্ষতি হয়নি, সেটা বলতে গিয়ে কণ্ঠ ধরে আসছিল তাঁর। বললেন, ‘আল্লাহ আমার ছেলেকে বাঁচাইছে। বইমেলায় গিয়েছিল বলেই বাঁচল। ব্যাগ পেলাম কি পেলাম না, সেটা বড় কথা না। আমার ছেলেটা বেঁচে আছে, এটাই সবচেয়ে বড়।’
আরও পড়ুনছোট থেকেই মাসুকা শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন, দুর্ঘটনার সময় শ্রেণিকক্ষে পড়াচ্ছিলেন৪ ঘণ্টা আগেআরও পড়ুনহতাহত-নিখোঁজদের তালিকা তৈরির জন্য কমিটি গঠন মাইলস্টোনের১ ঘণ্টা আগে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বইম ল য়
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতিদিন কেন মৃত্যুকে স্মরণ করতে হবে
মৃত্যু জীবনের একটি অবশ্যম্ভাবী সত্য, যা প্রত্যেকটি মানুষের জন্য নির্ধারিত। ইসলামে মৃত্যুকে ভয়ের বিষয় হিসেবে নয়; বরং আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার একটি স্বাভাবিক ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮৫)
মৃত্যুর স্মরণ মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক অনুশীলন, যা জীবনের উদ্দেশ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং আমাদের পার্থিব লোভ-লালসা থেকে দূরে রাখে।
মৃত্যু: মুমিনের জন্য স্বস্তিপৃথিবী একটি পরীক্ষার ক্ষেত্র, যেখানে মানুষ নানা দুঃখ-কষ্ট, অভাব, প্রিয়জনের মৃত্যু, দারিদ্র্য ও অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। মুসলিমদের জন্য এ পরীক্ষা হলো আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার মাধ্যমে জীবন যাপন করা।
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘(আল্লাহ) যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, যাতে তিনি তোমাদের পরীক্ষা করেন, তোমাদের মধ্যে কে উত্তম কাজ করে।’ (সুরা মুলক, আয়াত: ২)
আনন্দের ধ্বংসকারীকে (মৃত্যুকে) বেশি বেশি স্মরণ করো। তিরমিজি, হাদিস: ২৩০৭মৃত্যু মুমিনের জন্য একটি স্বস্তি। এটি পার্থিব পরীক্ষা ও কষ্ট থেকে মুক্তি দেয় এবং আল্লাহর রহমতের আলিঙ্গনে নিয়ে যায়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন মৃত্যুর মাধ্যমে স্বস্তি পায়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৫০৭)।
এমনকি নবীজি (সা.)-এর জীবনেও এ সত্য প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর সময় মৃত্যুর ফেরেশতা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে মৃত্যু বিলম্বিত করার সুযোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার পথ বেছে নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুনমৃত্যু থেকে পালানোর পথ নেই১৮ মার্চ ২০২৫মৃত্যুকে স্মরণ করার গুরুত্বমৃত্যু স্মরণ একটি গভীর আধ্যাত্মিক অনুশীলন। যখন আমরা কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু দেখি, তখন পার্থিব বিষয়গুলো তুচ্ছ মনে হয়। আমরা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে পুনর্বিবেচনা করি।
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘হৃদয় মরিচার মতো মলিন হয়।’ লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, ‘কীভাবে তা পরিষ্কার করা যায়?’ তিনি বললেন, ‘মৃত্যু স্মরণ ও কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে।’ (নাহজুল ফাসাহা)।
এ ছাড়া তিনি বলেছেন, ‘আনন্দের ধ্বংসকারীকে (মৃত্যুকে) বেশি বেশি স্মরণ করো।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৩০৭)
হজরত আলী (রা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রায়ই মৃত্যুকে স্মরণ করে, সে অল্প সম্পদেও সন্তুষ্ট থাকে। সে কখনো লোভী বা কৃপণ হয় না।’ (বিহারুল আনওয়ার)
মৃত্যুর জন্য কী কামনা করা যায়ইসলামে আত্মহত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তাই কোনো বিপদ বা কষ্টের কারণে মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করা অনুমোদিত নয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন বিপদের কারণে মৃত্যু কামনা না করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৫১)।
তবে শহীদ হওয়ার জন্য দোয়া করা, অর্থাৎ আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণের জন্য প্রার্থনা করা ইসলামে অনুমোদিত।
ইসলামের দৃষ্টিকোণে মৃত্যু জীবনের সমাপ্তি নয়; বরং এটি পার্থিব জীবন থেকে চিরস্থায়ী জীবনের দিকে একটি সেতু। মৃত্যু মুমিনের জন্য এটি আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটি সুযোগ।মৃত্যুই শেষ কথা নয়ইসলামের দৃষ্টিকোণে মৃত্যু জীবনের সমাপ্তি নয়; বরং এটি পার্থিব জীবন থেকে চিরস্থায়ী জীবনের দিকে একটি সেতু। এটি ভয় বা দুঃখের বিষয় হলেও মুমিনের জন্য এটি আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটি সুযোগ। মৃত্যু স্মরণ ও এর জন্য প্রস্তুতি আমাদের জীবনকে আরও অর্থবহ করে।
বিপদে পড়লে মৃত্যু স্মরণের দোয়া আমাদের ধৈর্য ধরতে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে সাহায্য করে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা বিপদে পড়ে বলে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন (আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাব।)’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৬)
এ আয়াত মৃত্যুর সংবাদ শোনার সময়ও পাঠ করা হয়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বিপদ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে এবং তিনি আমাদের সামর্থ্যের বাইরে পরীক্ষা দেন না। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬)।
প্রতিটি বিপদের মধ্যে আমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এ বিপদ ক্ষণস্থায়ী। কারণ, আমরা আল্লাহর কাছে ফিরে যাব।
আরও পড়ুনসন্তান জন্মের আগে মৃত্যু কামনা করেন নবীর মা৩১ মে ২০২৫কয়েকটি দোয়ামৃত্যু ভাবাপন্ন বিপদ হলে: কঠিন বিপদের সময় পাঠ করা যায়, তা হলো নবীজি (সা.)-এর শেখানো: ‘হে আল্লাহ, যতক্ষণ জীবন আমার জন্য কল্যাণকর, ততক্ষণ আমাকে জীবিত রাখো এবং যখন মৃত্যু আমার জন্য উত্তম, তখন আমাকে মৃত্যু দাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৫১)
মৃত্যু নিকটবর্তী হলে: মৃত্যুর সময় শুধু আল্লাহই জানেন। তবে আমরা বা আমাদের প্রিয়জন মৃত্যুর কাছাকাছি থাকি এবং ভয় বা উদ্বেগ অনুভব করি, তবে এই দোয়া পাঠ করা যায়: ‘হে আল্লাহ, মৃত্যুর যন্ত্রণা ও কষ্ট থেকে আমাকে সাহায্য করো।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৯৭৮)।
নবীজি (সা.) নিজেও তাঁর মৃত্যুর সময় এই দোয়া পাঠ করেছিলেন।
হে আল্লাহ, যতক্ষণ জীবন আমার জন্য কল্যাণকর, ততক্ষণ আমাকে জীবিত রাখো এবং যখন মৃত্যু আমার জন্য উত্তম, তখন আমাকে মৃত্যু দাও।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৫১সহজ মৃত্যুর জন্য দোয়া: নবীজি (সা.) একটি দীর্ঘ দোয়ার শেষে বলেছেন, ‘এবং আমার মৃত্যুকে আমার জন্য স্বস্তির উৎস করো, যা আমাকে সব অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৮৮)
এখানে সহজ মৃত্যু বলতে পার্থিব অর্থে আরামদায়ক মৃত্যু (যেমন ঘুমের মধ্যে মৃত্যু) বোঝায় না; বরং এটি বোঝায় মৃত্যুর ফেরেশতার আগমন থেকে শুরু করে পরকালে স্থানান্তর পর্যন্ত একটি সহজ প্রক্রিয়া।
মৃত্যুর কঠিন পরীক্ষা থেকে আশ্রয়: একটি দোয়ায় নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে অলসতা, বার্ধক্য, কাপুরুষতা, অক্ষমতা এবং জীবন ও মৃত্যুর পরীক্ষা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।’ (সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ৫৪৯১)
মৃত্যুর সময় শয়তান থেকে বাঁচতে: নবীজি (সা.) এ–সময় দোয়া করেছেন, ‘আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি যেন শয়তান আমার মৃত্যুর সময় আমাকে ক্ষতি করতে না পারে।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ১৫৫২)
ইসলামে মৃত্যুকে ভয়ের বিষয় হিসেবে নয়; বরং আল্লাহর সঙ্গে পুনর্মিলনের একটি সুযোগ হিসেবে দেখা হয়। নিয়মিত মৃত্যু স্মরণ আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়, লোভ-লালসা থেকে দূরে রাখে এবং আমাদের ভালো কাজের পথে রাখে।
আরও পড়ুনমৃত্যু কি শেষ, মৃত্যু আসলে কী৩১ জুলাই ২০২৩