বিধবা শাহিনুর বেগমের (৩৬) এক চোখে স্বপ্ন, আরেক চোখে হতাশা। তাঁর স্বপ্ন, তিন সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করা। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে সেই স্বপ্নপূরণে তাঁর চোখে নেমে এসেছে হতাশা। ভাইয়ের পরিবার থেকে খাবার না এলে সেদিন আর খাবার জোটে না তাঁদের। নিজের ঘরে রান্নার চুলা নেই। রান্নাঘরটি ভেঙে পড়ে আছে। বসবাসের ঘর সামনের দিকে একটু ভালো হলেও পেছন দিকের বেড়া ভাঙা। টিনের চাল দিয়ে পানি পড়ে।

ভোলার সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কন্দর্পপুর গ্রামে বাবার বাড়িতে থাকেন শাহিনুর। বৃদ্ধ মা–বাবা বেঁচে আছেন। তাঁদের বাড়ির পেছনে মেঘনার শাখা নদী ইলিশা। ভরা জোয়ারে এই গ্রাম নদীর পানিতে ডুবে যায়। রাস্তাঘাট নেই। এই নদীতেই শাহিনুরের স্বামী মো.

কামাল হোসেন (৪৪) মাছ ধরতেন। তাঁর ছিল ছোট একটি ডিঙি নৌকা। কামাল ও তাঁর মাছ ধরার সঙ্গী এই নৌকা নিয়েই মাছ ধরতেন। মাছ ধরতে গিয়ে একদিন কামালের মৃত্যু হয়। ভেঙে যায় শাহিনুরের সুখের সংসার।

২০২২ সালের মার্চ মাস। মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীতে জাটকা সংরক্ষণ অভিযান চলছিল। ইলিশা নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ না হলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের ভয়ে কামাল রাত জেগে মাছ ধরতেন। মার্চের কোনো এক রাতে (তারিখ শাহিনুরের মনে নেই) কামাল জাল পেতে নৌকায় শুয়ে ছিলেন। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত ২টার দিকে ঢাকাগামী যাত্রীবাহী লঞ্চ তাঁর নৌকার ওপর দিয়ে চলে গেলে নৌকাটি দুমড়েমুচড়ে ডুবে যায়। পরের দিন ভাঙা নৌকা আর কামালের লাশ পাওয়া যায় নদীতে। যদিও তাঁর মাছ ধরার সঙ্গী আহত অবস্থায় বেঁচে ছিলেন।

শাহিনুরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কামালের বাবা আজিজুল হক জমাদ্দারের বাড়ি ছিল ইউনিয়নের চর মোহাম্মদ আলী। তখন তাঁরা ছিলেন অবস্থাসম্পন্ন পরিবার। চাষবাসে সংসার চলত। সেই বাড়ি ভেঙে গেলে তাঁরা চলে যান ইউনিয়নের চর সুলতানী গ্রামে। সেই বাড়িও একদিন মেঘনায় বিলীন হয়ে যায়। ততদিনে গেরস্থবাড়ির সন্তানেরা লাঙল ছেড়ে নৌকার বইঠা ধরতে শিখে গেছে। বাড়ির মানুষজন ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায়। কামাল ভাঙা ঘরবাড়ির চালা, বেড়া নিয়ে এসে শ্বশুরবাড়িতে ঘর তোলেন। ধারদেনা করে নিজের একটা ছোট জেলেনৌকা বানান।

কামালের ভাঙা নৌকাটি অর্থের অভাবে সংস্কার করতে পারেননি স্ত্রী শাহিনুর। গোয়ালে একজোড়া গরু-বাছুর ছিল। সেটিও বিক্রি করতে বাধ্য হন মহাজনের দেনা পরিশোধের জন্য। বড় ছেলে হযরত আলী (১২) এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। মেজো ছেলে আল আমিন পড়ছে পঞ্চম শ্রেণিতে। আর ছোট মেয়ে বিবি আছিয়া দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী।

বিধবা শাহিনুর বেগম বলেন, সংসারে আয় বলতে কিছু নেই। মা–বাবা আছেন। দুই ভাই ঢাকায় কাজ করে সংসার চালান। সেই আয়ে তাঁদের মুখে খাবার জোটে। জানেন না, এভাবে কত দিন চলবে। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বড় ছেলে এক হাজার ২০০ টাকা উপবৃত্তি পেয়েছে। এক হাজার টাকা বেতন আর পরীক্ষার ফি বাবদ কেটে নেওয়া হয়েছে। স্বামীর নামে যে জেলে–কার্ড ছিল, তিনি মারা যাওয়ার পর ওই কার্ড দেখিয়ে দুবার চাল পেয়েছেন তাঁরা। এরপর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) থেকে কার্ডটি নিয়ে গেছে। রেশন কার্ডেও আজকাল চাল পাচ্ছেন না। ছেলেমেয়েকে যদি লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে না পারেন, তাহলে ছেলেদেরও মাছ শিকারে পাঠাতে হবে। কিন্তু শাহিনুর তা একেবারেই চান না।

ভোলার রাজাপুর ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান মো. শাজাহান ব্যাপারী বলেন, তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর কেউ তাঁর কাছে আসেননি। এলে যথাসম্ভব সাহায্য করবেন বলে জানান।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন, লঞ্চের চাপায় নৌকাডুবিতে মারা যাওয়ার সব প্রমাণসহ যদি শাহিনুর আবেদন করেন, তবে সরকারি বরাদ্দ এলে তাঁকে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।

ভোলার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরিফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তিনি জানতেন না। শাহিনুরের পরিবারকে সাহায্য করার চেষ্টা করবেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম ছ ধরত

এছাড়াও পড়ুন:

ইসরায়েলে মার্কিন অস্ত্র বিক্রি ঠেকানোর চেষ্টা সিনেটে ব্যর্থ

গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক নিন্দার মধ্যে, ইসরায়েলের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি আটকাতে মার্কিন সিনেটে তোলা একটি বিল পাস হতে ব্যর্থ হয়েছে।

ব্যর্থ হলেও, বুধবারের ভোটে দেখা গেছে, মার্কিন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভেতরে ইসরায়েলের যুদ্ধের বিরোধিতা জোরদার হয়ে উঠেছে। 

আজ বৃহস্পতিবার কাতারভিত্তিক আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রি ঠেকানোর প্রচেষ্টায় এবারের ভোটে উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক ডেমোক্র্যাট যোগ দিয়েছেন। 

আরো পড়ুন:

ভারতের ৬ প্রতিষ্ঠানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা

পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্নের ঘোষণা ট্রাম্পের

ইসরায়েলের কাছে ২০ হাজার স্বয়ংক্রিয় অ্যাসল্ট রাইফেল বিক্রি বন্ধ করার প্রস্তাবের পক্ষে ২৭ জন ডেমোক্র্যাট ভোট দিয়েছেন, আর ৬৭৫ মিলিয়ন ডলারের বোমার চালান বন্ধ করার পক্ষে ২৪ জন ভোট দিয়েছেন। 

অন্যদিকে, ভোটদারকারী সব রিপাবলিকান সিনেটররা প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। 

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের চলমান হামলার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির দুটি চুক্তি আটকে দিতে প্রস্তাবগুলো সিনেটে আনেন ভার্মন্টের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। তিনি প্রগতিশীল ঘরানার স্বতন্ত্র সিনেটর।

ভোটের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে স্যান্ডার্স বলেন, “ওয়াশিংটন ইসরায়েলের ‘বর্ণবাদী সরকার’কে এমন অস্ত্র সরবরাহ করা চালিয়ে যেতে পারে না, যা নিরীহ মানুষদের হত্যা করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।”

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে একজন ‘জঘন্য মিথ্যাবাদী’ হিসেবে উল্লেখ করে স্যান্ডার্স ‘এক্স’ পোস্টে আরো বলেন, “গাজায় শিশুরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে।”

প্রথমবারের মতো স্যান্ডার্সের প্রস্তাবকে সমর্থনকারী আইন প্রণেতাদের মধ্যে, ওয়াশিংটন রাজ্যের সিনেটর প্যাটি মারে বলেছেন, প্রস্তাবগুলো ‘নিখুঁত’ না হলেও, তিনি গাজার নিষ্পাপ শিশুদের অব্যাহত দুর্ভোগকে সমর্থন করতে পারেন না।

মারে এক বিবৃতিতে বলেন, “ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও আমি প্রস্তাবের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিচ্ছি এই বার্তা দিতে: নেতানিয়াহু সরকার এই কৌশল চালিয়ে যেতে পারবে না।”

তিনি বলেন, “নেতানিয়াহু ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রতিটি পদক্ষেপে এই যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করেছেন। আমরা গাজায় মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করছি- সীমান্তের ওপারে যখন প্রচুর পরিমাণে সাহায্য ও সরবরাহ পড়ে আছে, তখন শিশু এবং পরিবারগুলোর অনাহার বা রোগে মারা যাওয়া উচিত নয়।”

মার্কিন জনগণের মধ্যে গাজা যুদ্ধের বিরোধিতা ক্রমবর্ধমান হওয়ার পাশাপাশি ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন নিয়ে ব্যাপক আকারে বিভক্তি দেখা দিয়েছে।

মঙ্গলবার প্রকাশিত গ্যালাপের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৩২ শতাংশ আমেরিকান বলেছেন, তারা গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান সমর্থন করেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৪২ শতাংশ আমেরিকান ইসরায়েলি অভিযান সমর্থন করেছিলেন।

গ্যালাপের মতে, মাত্র ৮ শতাংশ ডেমোক্র্যাট বলেছেন যে তারা ইসরায়েলের অভিযানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, যেখানে ৭১ শতাংশ রিপাবলিকান জানিয়েছেন যে, তারা ইসরায়েলি পদক্ষেপকে সমর্থন দিয়েছেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ