প্রথম আলো:

জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আপনি এর আগে জাতীয় নিরাপত্তা সমন্বয় সংস্থা গঠনের কথা বলেছিলেন। বর্তমান বাস্তবতায় সেটা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে কি?

আ ন ম মুনীরুজ্জামান: এটা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তার কারণ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নীতিমালার ক্ষেত্রে বেশ কিছু ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা নীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা নীতির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত পরিষ্কারভাবে নীতিমালাগুলো প্রণয়ন করা হয়নি। যেকোনো দেশের জন্য এই নীতিমালাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এখন পর্যন্ত আমাদের ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কিটেকচার বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকাঠামো গড়ে তুলতে পারিনি। সে কারণে আমাদের সক্ষমতাগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমন্বয়ের কাজটি অনেক ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নটির সঙ্গে শুধু সশস্ত্র বাহিনী জড়িত থাকে না। বর্তমান বিশ্বে এ জায়গায় সমগ্র সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা থাকে। সে জন্য রাষ্ট্রীয় সব ধরনের সক্ষমতা একই ছাতার নিচে সমন্বয় করার জন্য যে ধরনের অবকাঠামো দরকার, সেটা খুব শিগগির আমাদের গড়ে তুলতে হবে। এ জায়গায় এখন পর্যন্ত অনেক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, যেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রথম আলো:

ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য একক কোনো বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তির দিকে ঝুঁকে পড়া কতটা বাস্তবসম্মত হবে? এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থানটা কী হওয়া উচিত?

আ ন ম মুনীরুজ্জামান: বাংলাদেশ একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক অবস্থানে অবস্থান করে। বিশেষ করে আমরা বঙ্গোপসাগরের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত দেশ। বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভারত মহাসাগরীয় দেশও। এ কারণে বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে এবং উঁচু স্থানে চলে গেছে। বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রণয়ন করা ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির কারণে ভারত মহাসাগর কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান।

চীনের প্রণীত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভেও (বিআরআই) দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন করিডরের মাধ্যমে তারা অনেক ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। কাজেই দুটি পরাশক্তিরই একই মহাসাগরের ওপর যে কড়া দৃষ্টি বা স্বার্থ জড়িয়ে যাচ্ছে, তাতে আমাদের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিটা একটু স্পর্শকাতর হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটা হচ্ছে, আমরা যাতে সব ক্ষেত্রে একটা নিরপেক্ষতা বজায় রাখি।

আমরা যাতে কোনো একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে বা কোনো চুক্তির সঙ্গে এককভাবে জড়িয়ে না পড়ি। আমাদের জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে আমরা সবার সঙ্গে কাজ করতে চাই এবং একইভাবে আমাদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে চাই। আমরা এককভাবে কারও সঙ্গে সংযুক্ত হলে আমরা অন্য পক্ষের নেতিবাচক দৃষ্টিতে চলে আসতে পারি। সেখানে আমাদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হতে পারে। কাজেই আমাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ পথ হবে কৌশলগত নিরপেক্ষতা ও কৌশলগত স্বনির্ভরতা বজায় রাখা।

প্রথম আলো:

মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধে ভারসাম্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো ঝুঁকে পড়েছে। রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই আরাকান আর্মির হাতে। রোহিঙ্গাদের কারণে আরাকানের সঙ্গে আমাদের বড় স্বার্থ রয়েছে। রাজ্যটিতে চীন ও ভারতের স্বার্থটাও বড়। আবার মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বার্মা অ্যাক্ট পাস করেছে। সব মিলিয়ে মিয়ানমার ও রাখাইন ঘিরে একটা জটিল ভূরাজনৈতিক সমীকরণ বিরাজ করছে। এই বাস্তবতা বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে? বাংলাদেশের সামনে পথটাই–বা কী?

আ ন ম মুনীরুজ্জামান: আমাদের দুটি পথে এগোতে হবে। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আছে, তাদের আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি। আবার আমাদের প্রতিবেশী রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ আরাকান আর্মির হাতে চলে গেছে। তবে আরাকান আর্মি কোনো রাষ্ট্রীয় সত্তা নয়, তারা একটি অরাষ্ট্রীয় সত্তা। রাষ্ট্র হিসেবে আমরা তাদের সঙ্গে সরাসরি আলাপ-আলোচনা করতে পারি না। তবে অন্যান্য চ্যানেলে আরাকান আর্মির সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপনের একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে কূটনীতির চেয়ে কৌশলগত মারপ্যাঁচ কাজে লাগাতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্মুখপথে আমাদের কূটনীতি পরিচালিত হবে, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাক চ্যানেলে কূটনীতি পরিচালিত করতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে তাদের দক্ষতা প্রমাণের এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা দুই পক্ষের সঙ্গেই আমাদের কার্যকর একটা সম্পর্ক বজায় রেখে এগোতে হবে। তবে কোনোভাবেই এমন কিছু করা যাবে না, যেটা মিয়ানমার সরকারের স্বার্থের সম্পূর্ণ বিপরীতে চলে যায়।

প্রথম আলো:

রাখাইন পরিস্থিতি রোহিঙ্গা সংকটে নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে। রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। নতুন করে রোহিঙ্গা এসেছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সহায়তা কমেছে। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের নিজ জন্মভূমিতে ফেরানোর বিষয়টা কতটা জটিল হলো?

আ ন ম মুনীরুজ্জামান: পরিস্থিতিটা জটিল হয়ে উঠছে আরও বেশি কারণে যে রোহিঙ্গারা মানবিক যে একটা পরিস্থিতির ভেতরে ছিল, সেটা থেকে এটা উত্তরণ করে এটা একটা নিরাপত্তাজনিত সমস্যায় রূপান্তরিত হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভেতরে অনেকে বিভিন্ন ধরনের বেআইনি কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে। যেমন তাদের অনেকে মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে। এখান থেকে বিভিন্ন দেশে মানব পাচার হচ্ছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রাস্ত্র আসছে, সেগুলো বিভিন্ন দেশে চোরাচালান হচ্ছে। কাজেই এটা শুধু আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটা জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে না; বরং বলা চলে, আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর একটা বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠছে।

এ ছাড়া এই অঞ্চলে যে ধরনের উগ্র মতবাদের সৃষ্টি হচ্ছে, সেটার প্রভাবও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পড়তে শুরু করেছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠন যেমন আরসা বা আরএসও ইতিমধ্যে রাখাইনের ভেতরে গিয়ে বিভিন্ন সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এখন রাখাইনের ওপর আরাকান আর্মির যে ধরনের নিয়ন্ত্রণ আছে, তাতে তাদের সমর্থন ছাড়া রোহিঙ্গারা কোনোভাবেই তাদের জন্মভূমিতে ফেরত যেতে পারবে না।

আরসা, আরএসওর মতো সংগঠনগুলোর তৎপরতার কারণে আরাকান আর্মির রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে খুবই নেতিবাচক অবস্থানে চলে গেছে। এখন আমরা যদি ধরেও নিই মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে রাজি হয়, কিন্তু দেখা যাবে যে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের রাস্তাগুলো খুলে দেবে না। কাজেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ভবিষ্যৎটা খুবই অনিশ্চিত।

অদূর ভবিষ্যতে তারা সেখানে ফেরত যাবে বলে মনে করি না। কাজেই এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে আমরা কীভাবে এখানে রাখব, সেটা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে। কেননা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা উদ্বেগজনকভাবে কমে যাচ্ছে। প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা এখানে আগে থেকেই বাস করছিল। গত ১৮ মাসে আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গা নতুন করে এসেছে। প্রতিবছর রোহিঙ্গা শিবিরে ৪০-৫০ হাজার শিশুর জন্ম হচ্ছে। কাজেই রোহিঙ্গা সমস্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

প্রথম আলো:

সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কয়েকজন তরুণের বিরুদ্ধে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। বৈশ্বিক ও আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে এ ঘটনা আমাদের জন্য কতটা ঝুঁকি তৈরি করল?

আ ন ম মুনীরুজ্জামান: মালয়েশিয়ায় উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে আমাদের তরুণদের জড়িয়ে পড়ার ঘটনা আমাদের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। আমাদের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে আসছে। মালয়েশিয়া আমাদের বড় শ্রমবাজার। মালয়েশিয়ায় উগ্রবাদী তরুণেরা যে সমস্যাটা সৃষ্টি করেছে, সেটা শুধু মালয়েশিয়ার ভেতরে সীমিত নয়। তারা সেখান থেকে অর্থ সংগ্রহ করে মধ্যপ্রাচ্যে আইএসআইএসের কাছে পাঠানোর জন্য উদ্যোগ নিচ্ছিল। কাজেই এখানে একটা আন্তর্জাতিক মাত্রাও যোগ হয়েছে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশেও এ ধরনের উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর যোগাযোগ থাকার সম্ভাবনা খুব বেশি। কাজেই শুধু মালয়েশিয়ায় একটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, এভাবে দেখা ঠিক হবে না। বাংলাদেশে তারা কী ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেছে কিংবা কাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে, সেটা আমাদের খুব গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।

আমাদের আরেকটি বড় উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতিটা একেবারে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ৫ আগস্টের পর পুলিশ সঠিকভাবে কাজ করছে না। উগ্র মতবাদ ও জঙ্গি মতবাদ দমনের জন্য পুলিশের বেশ কিছু বিশেষায়িত ইউনিট তৈরি করা হয়েছিল। সেই ইউনিটগুলো বর্তমানে সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে। এসব ইউনিটের যে সক্ষমতা সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেটা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে নজর দেওয়া ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের সক্ষমতাটা একেবারে নেই বললেই চলে। কাজেই উগ্রবাদের কারণে আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় সমস্যা হচ্ছে, সেগুলো কিন্তু আমরা সঠিকভাবে যাচাই করতে পারছি না। এদিকে আমাদের খুব দ্রুত দৃষ্টি দিতে হবে।

মালয়েশিয়ায় যারা জেলে আছে বা যাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে, আমরা যদি খুব বলিষ্ঠ এবং পরিষ্কার ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নিই, তাহলে মালয়েশিয়া নয়, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য অনেক দেশে আমাদের শ্রমবাজারের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ব্যাপারে আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খুবই আশু কিছু বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান কার্যক্রম চোখে পড়েনি। যে গুরুত্ব দিয়ে এই সমস্যাটা তাদের সামাল দেওয়া উচিত ছিল, সেটা তারা করেনি। এই দুর্বলতার সমস্যাটাকে আরও গভীরে নিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছি।

প্রথম আলো:

প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষি করে শুল্ক কমাতে পারলেও বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার কারণ কী বলে মনে করেন?

আ ন ম মুনীরুজ্জামান: এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ–অর্থনৈতিক সমস্যাট। শুধু বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিল। পরে আলাপ-আলোচনার জন্য তারা এই সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছিল। সে ক্ষেত্রে এই সময়কে কাজে লাগিয়ে অনেক দেশ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। যেমন ভিয়েতনাম আলোচনার মাধ্যমে তাদের ওপর আরোপিত শুল্ক ২০ শতাংশ পর্যন্ত নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। আমরা জানতে পারছি, ভারতও প্রায় ২০ শতাংশ বা তার নিচে শুল্ক নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কার্যকর আলোচনা এগিয়ে নিচ্ছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমরা সময়টাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষির চেষ্টা সঠিক ব্যক্তির দ্বারা করা হয়নি। যেমন ওয়াশিংটনে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা উপস্থিত থেকে আলোচনাটা পরিচালনা করছিলেন। এটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ। এটি কোনোভাবেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার কাজ নয়।

এখানে আরেকটি বড় ঘাটতির জায়গা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যাঁরা রপ্তানি করেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হয়নি, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ত করাও হয়নি। কাজেই যে আলাপ-আলোচনাটি হয়েছে, সেটা কতটা বাস্তবসম্মত ছিল, সেটা আমরা জানি না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে চিঠিটা দিয়েছেন, সেখানে দেখা যাচ্ছে পূর্বঘোষিত ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে শুল্ক ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে। এখন আমাদের যদি ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে হয়, আর আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো যদি আমাদের চেয়ে কম শুল্ক দেয়, তাহলে কিন্তু প্রতিযোগিতার বাজারে আমরা অনেকখানি পিছিয়ে পড়ব। এতে আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পে যে চাপ তৈরি হবে, তাতে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।

তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় বাজার। সেই বাজারে রপ্তানি যদি বিঘ্নিত হয়, তার স্পিল-ওভার প্রভাব ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারসহ অন্যখানেও পড়বে। আমরা এরই মধ্যে শুনতে পাচ্ছি, ইউরোপের কিছু কিছু ক্রেতা বলতে শুরু করেছেন, তাঁরা বাংলাদেশ থেকে পণ্য নেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন করে দর-কষাকষি করতে চান। এটা আমাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। কেননা আমরা রপ্তানির ক্ষেত্রে এককভাবে তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। ফলে ৩৫ শতাংশ শুল্কের কারণে অর্থনীতির ওপর যে ঝুঁকি আসবে, সেটা মোকাবিলা করা বাংলাদেশের জন্য খুবই কঠিন হবে।

এ রকম ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে যে দর-কষাকষির বিষয়টাকে যে ধরনের গুরুত্ব দেওয়া দরকার, যে ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত ছিল, সেটা করা হয়নি। এখানে উচিত ছিল ট্রেড লবিস্ট নিয়োগ করা। ভিয়েতনামসহ আরও কিছু দেশ খুবই দক্ষ ট্রেড লবিস্ট নিয়োগ করেছিল। বাংলাদেশ সে রকম কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। প্রথমে দায়সারাভাবে পদক্ষেপ নিয়েছে, শেষ মুহূর্তে নেগোসিয়েশন করতে গেছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তো নেগোসিয়েশন হয় না। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। অপর পক্ষ যখন জানে যে আমরা খুব নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছি, তারা তো আমাদের কাছ থেকে যতটুকু পারে, ততটুকু নেওয়ার চেষ্টা করবেই।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

আ ন ম মুনীরুজ্জামান:  আপনাকেও ধন্যবাদ।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র আর ক ন আর ম র দ শ র জন য ভ র জন ত ক জনগ ষ ঠ র পদক ষ প ন বড় ধরন র প রথম আল র খ ইন র আম দ র প আম দ র জ আম দ র স ন র জন য র জন য স র আম দ র পর স থ ত ক অবস থ অবস থ ন সমস য ট ক শলগত ত ন কর র ভ তর সরক র র ওপর সবচ য়

এছাড়াও পড়ুন:

বালুচদের আন্দোলন ইসরায়েল যেভাবে ছিনতাই করছে...

ইসরায়েল যখন ইরানের ওপর কোনো ধরনের উসকানি ছাড়াই আকস্মিকভাবে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং যুদ্ধের ডঙ্কা বাজাচ্ছিল, তখন একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রায় সবার নজর এড়িয়ে গেছে। খবরটি ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নতুন একটি প্রকল্পের ঘোষণাসংক্রান্ত। গত ১২ জুন মিডল ইস্ট মিডিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট (মেমরি) নামের থিঙ্কট্যাংক ঘোষণা দেয়, তারা বেলুচিস্তান স্টাডিজ প্রজেক্ট (বিএসপি) নামে একটি নতুন গবেষণা উদ্যোগ শুরু করছে। 

এ ঘোষণায় মেমরি বলেছে, বেলুচিস্তানে তেল, গ্যাস, ইউরেনিয়াম, তামা, কয়লা, বিরল খনিজসহ বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। এ ছাড়া গাদর ও চাবাহার নামের দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর আছে। তারা বলছে, এই অঞ্চল এমন একটি জায়গা, যেখান থেকে ইরান কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র পেতে পারে। এ কারণে এসব নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির জন্য এখানে একটি ঘাঁটি গড়া যেতে পারে। এ যুক্তিতেই তারা প্রকল্পটি চালুর যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে। 

মেমরি এমন একটি সংস্থা, যারা আরবি, ফারসি ও তুর্কি ভাষার মিডিয়ার বিশেষ কিছু অংশ বেছে বেছে অনুবাদ করে। সেগুলোর স্ক্রিনশট পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিম আকারে ঘুরে বেড়ায়। এটি ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শুরু থেকেই এটি ইসরায়েলপন্থী অবস্থান গ্রহণ করে। এ প্রেক্ষাপটে মেমরি যে বেলুচিস্তান স্টাডিজ প্রজেক্ট চালু করেছে, তা আসলে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বালুচদের জাতীয় আন্দোলনকে নিজেদের কৌশলগত স্বার্থে ব্যবহার করার একটি চেষ্টা বলে মনে হয়।

যদি তারা বালুচদের এই সংগ্রামকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়, তাহলে এর মাধ্যমে ইসরায়েল একদিকে রাজনৈতিক সুবিধা পাবে, অন্যদিকে এই অঞ্চলের ‘রাষ্ট্রহীন’ জনগণের (যেমন বালুচ ও ফিলিস্তিনিদের) বিচারভিত্তিক প্রতিরোধ আন্দোলনের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারবে। বিষয়টি মাথায় রেখে স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে ভূরাজনীতির চিন্তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি। 

মেমরি যে বিএসপি চালু করেছে, তার ঘোষণায় বহু অসংগতি ও ভুল তথ্য আছে। বিশেষ করে বেলুচিস্তানে শোষণ ও প্রতিরোধের বাস্তবতা নিয়ে বহু ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। যেমন মেমরির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, যেহেতু ইরান ও পাকিস্তান উভয়ই এখন বেলুচিস্তানে বিদ্রোহ দমনের জন্য সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বোঝা উচিত, বেলুচিস্তান আসলে পশ্চিমা বিশ্বের স্বাভাবিক মিত্র। কিন্তু মেমরি ইচ্ছাকৃতভাবে এই সত্য চেপে যাচ্ছে যে বারিক গোল্ড ও বিএইচপি বিলিটনের মতো পশ্চিমা বিশ্বের বড় বড় কোম্পানি এই অঞ্চলেই ঔপনিবেশিক ধরনের সম্পদ লুট ও পরিবেশ ধ্বংসে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।

এ প্রকল্পে যাঁরা যুক্ত হয়েছেন, তাঁদের নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। মেমরির ওয়েবসাইটে বিএসপি নিয়ে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ‘বিখ্যাত বালুচ লেখক, পণ্ডিত ও রাজনৈতিক বিজ্ঞানী’ হিসেবে মির ইয়ার বালুচ নামের একজনকে ‘বিশেষ উপদেষ্টা’ হিসেবে স্বাগত জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, উপমহাদেশে তাঁর এক্স অ্যাকাউন্ট সবচেয়ে প্রভাবশালী অ্যাকাউন্টগুলোর একটি।

এ বছরের মে মাসে এই মির ইয়ার বালুচ একের পর এক পোস্টে একতরফাভাবে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে জানান, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পক্ষে ছয় কোটি বালুচ দেশপ্রেমিক ভারতের পাশে আছে। এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমেই তিনি প্রথমবারের মতো আলোচনায় উঠে আসেন। 

পরিচিত বালুচ কর্মীরা মির ইয়ার বালুচকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বালুচ ন্যাশনাল মুভমেন্টের নিয়াজ বালুচ এক্সে পোস্ট করে জানান, বালুচ নেতাদের মধ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে কোনো ঐক্য নেই। তিনি চারটি ‘ভুয়া অ্যাকাউন্ট’-এর তালিকা দেন। এর মধ্যে মির ইয়ার বালুচের অ্যাকাউন্টও ছিল। তিনি বলেন, এই অ্যাকাউন্টগুলো ‘তাৎক্ষণিকভাবে রিপোর্ট ও আনফলো করা উচিত’। এ কারণে অনেক বালুচ কর্মীর সন্দেহ, মির ইয়ার বালুচ আদতে একটি তৈরি করা ছদ্মচরিত্র, যা কোনো রাষ্ট্রের স্বার্থে তৈরি হয়েছে। আর তা করা হয়েছে ওই রাষ্ট্রের বিশেষ কৌশলগত লক্ষ্য বাস্তবায়নে সাহায্য করার জন্য। 

বেলুচিস্তান এমন একটি অঞ্চল, যা ইরান ও পাকিস্তানের সীমান্তজুড়ে বিস্তৃত। এ দুই রাষ্ট্রই সেখানে বিদ্রোহ দমন করছে। এর ফলে তাদের মধ্যে প্রায়ই উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, সীমান্ত পেরিয়ে তারা একে অপরের বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দিচ্ছে।

অথচ বাস্তবতা হলো, ইরান ও পাকিস্তানের উভয় পাশের অনেক বালুচ মনে করেন, তাঁরা রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের শিকার এবং সমাজের মূলধারা থেকে বাদ পড়া জনগোষ্ঠী। 

এ প্রেক্ষাপটে বালুচদের সংগ্রামের প্রতি ইসরায়েলের প্রকাশ্য সমর্থন তাদের পশ্চিম এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের নতুন পথ খুলে দেয়। ইরানের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেদ করার ক্ষেত্রে ইসরায়েল কতটা কার্যকরভাবে অনুপ্রবেশ করতে পেরেছে, তা ১৩ জুনের ঘটনাগুলোয় দেখা গেছে। এখন তারা বালুচদের সমর্থন জানিয়ে ইরান ও পাকিস্তানের সেই সব বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চাইছে, যাদের ওপর ওই দুই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দুর্বল। এর ফলে ইসরায়েল ওই অঞ্চলগুলোয় নিজের অবস্থান আরও মজবুত করতে পারবে। 

আরও পড়ুনবেলুচিস্তানে সশস্ত্র আন্দোলন গোপনে কারা, কেন উসকে দিচ্ছে২৪ জুলাই ২০২৫

আরও গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনকে দমন ও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার ব্যাপারে ইসরায়েলের যে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য, তা অর্জনের ক্ষেত্রেও এই কৌশল সহায়ক। কারণ, বালুচ ও অন্যান্য রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের যে আন্ত–আন্তর্জাতিক সংহতি গড়ে উঠতে পারত, ইসরায়েল চাইছে তা ভেঙে দিতে। এভাবে বালুচদের আন্দোলনের ভেতরে ঢুকে পড়ে ইসরায়েল শুধু ইরান ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় না, বরং ফিলিস্তিনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রহীন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংহতির সম্ভাবনাও দুর্বল করে দেয়। 

ইসরায়েল যদি বেলুচিস্তানের প্রতি কোনো সমর্থন দেখায়, তাহলে সেটা ভারতের সঙ্গে তাদের কৌশলগত জোটের অংশ হিসেবেই দেখা যেতে পারে। ভারত অনেক দিন ধরেই বালুচ স্বার্থ বা বালুচদের আন্দোলনের একধরনের সমর্থক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে আসছে। কিন্তু এর ফলে একটি বড় সমস্যা হয়েছে। সেটি হলো ভারতের অধীন থাকা নিরাষ্ট্র জনগোষ্ঠী, যেমন কাশ্মীরিদের সঙ্গে বালুচদের সংহতি গড়ে তোলার চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। 

এমন প্রেক্ষাপটে লক্ষ করা যায়, মির ইয়ার বালুচ, যিনি এক্স হ্যান্ডলে ইসরায়েল ও ভারতের পক্ষে লেখেন, তাঁর পরিচিতি মূলত ভারতীয় গণমাধ্যম থেকেই তৈরি হয়েছে। তাঁর সব বক্তব্যই মূলত ভারতীয় জনগণের উদ্দেশে দেওয়া। সুতরাং বেলুচিস্তান স্টাডিজ প্রজেক্ট বা বিএসপি আসলে ভারত ও ইসরায়েলের কৌশলগত সম্পর্কেরই একটি প্রকাশ, যা কিনা এক অঞ্চলের প্রভাব অন্য অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার এক চর্চা। 

আবদুল্লাহ মোয়াসওয়েস ফিলিস্তিনি লেখক, গবেষক, শিক্ষক ও অনুবাদক

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইরান যে তিন কারণে পারমাণবিক অস্ত্র বানাবে না
  • বালুচদের আন্দোলন ইসরায়েল যেভাবে ছিনতাই করছে...