জবির প্রভাবশালী আওয়ামীপন্থি ‘ক্যাডার’ শিক্ষকরা যেখানে আছেন
Published: 29th, July 2025 GMT
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭ শতাধিক শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছে বুড়িগঙ্গার কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের বেশকিছু জটিল প্রক্রিয়া শেষে জবি সাবেক উপাচার্য মিজানুর রহমানের সময়ে শুরু শিক্ষক নিয়োগের প্রবাহ।
দায়িত্ব পালনের ৮ বছর সময়ে সাবেক উপাচার্য মিজানুর রহমান ৪ শতাধিক শিক্ষক নিয়োগ দেন। এসব শিক্ষকদের শতভাগই আওয়ামী লীগের কিংবা ছাত্রলীগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এছাড়া বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিশাল সংখ্যার অধিকাংশ শিক্ষকের নিয়োগ দেন।
এরপর উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক ড.
আরো পড়ুন:
রাবি ছাত্রদলের কমিটি: সভাপতি-সম্পাদকসহ অধিকাংশেরই ছাত্রত্ব নেই
শিক্ষকের মুক্তি চেয়ে শিক্ষার্থীদের আদালত চত্বরে অবস্থান, সড়ক অবরোধ
এরপর ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতন ঘটলে প্রথমবারের মতো জবির শিক্ষকদের মধ্য থেকে উপাচার্য নিয়োগ পান অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম। কিন্তু ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয়টি আওয়ামী লীগ আর ছাত্রলীগের সাত শতাধিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়ে গেছে। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের বেশিরভাগই নিয়োগ পেয়েছেন দলীয় এবং এলাকা কোটায়।
জবি শিক্ষকদের মধ্যে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের যারা বিগত দিনগুলোতে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন, তারাই ছিলেন মূলত জবির হর্তাকর্তা ও আওয়ামী ক্যাডার শিক্ষক। আওয়ামী সরকারের সরকার পতনের পর যদিও অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন অথবা নিজেকে আড়াল করতে নানাজনের সঙ্গে কিংবা সাদা দলের শিক্ষকদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তবে তারা বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে ছিলেন ব্যাপক প্রভাবশালী।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষদের মধ্যে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের প্রথম আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আহ্বায়ক কমিটি গঠনের সভায় সভাপতিত্ত্ব করেন তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আতিয়ার রহমান। সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের ড. আলী নূরকে সভাপতি এবং দর্শন বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. নূরুল মোমেনকে সদস্য সচিব করা হয়। মূলত এই কমিটির মাধ্যমেই জবিতে নীল দলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
নীল দলের ২০১৪-১৫ সেশনে সভাপতি ছিলেন ইতিহাস বিভাগের ড. মোহাম্মাদ সেলিম এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক রেজাউল করীম। মোহাম্মদ সেলিম বর্তমানে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসবে বহাল তবিয়তে। অধ্যাপক ড. সেলিম গত বছরের ৪ আগস্ট শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে নীল দলের ব্যানারে মানববন্ধন করে বক্তব্য রাখেন। শেষ সময় পর্যন্ত খুনি হাসিনার পক্ষে শক্ত অবস্থানও ধরে রাখেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সেই নীল দলের শিক্ষক সমিতির সভাপতি পদে মনোনীত ছিলেন তৎকালীন আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. সরকার আলী আক্কাস। সরকার আলী আক্কাস ছিলেন, আওয়ামী শাসনামলের সবচেয়ে প্রভাবশালী শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যর সঙ্গে বিশেষ সখ্যতায় তিনি আইন বিভাগে টানা পঞ্চমবারের মতো বিভাগীয় চেয়ারম্যান হিসেবে ১২ বছর পদে ছিলেন।
কেবল এই বিষয়টিই নয়, আইন অমান্য করে পরপর তিনবার বিভাগীয় ডিন হয়েছিলেন তিনি। চতুর্থবার যখন তাকে ডিন করা হয়, তখন একজন শিক্ষক আপত্তি দিলে বিষয়টি আটকে যায়। কিন্তু ২ বছর পর আবার একই পদে নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে। এখানেই শেষ নয়, আইন অনুযায়ী যেসব দায়িত্বের জন্য শিক্ষকদের বাড়তি টাকা দেওয়া হয়, সেগুলোর দুটি একসঙ্গে পেতে পারেন না শিক্ষকরা। কিন্তু অধ্যাপক আক্কাস একই সঙ্গে দুটি দায়িত্ব পেয়েছিলেন। এছাড়া বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের দেশব্যাপী আলোচিত অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ রয়েছে।
তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. পরিমল বালা। সর্বশেষ গত বছরের ১২ জুন তিনি দলীয় প্রভাবে তৎকালীন উপাচার্যর আস্তাভাজন হওয়ায় সিন্ডিকেট সদস্য মনোনীত হন। বর্তমানে তিনি বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্বে আছেন।
২০১৫ সালের ২৫ জুন ২০১৫-১৬ সালের নীল দলের কমিটি গঠন করা হয়। এতে সভাপতি ছিলেন ব্যবস্থাপনা একেএম মনিরুজ্জমান এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক একেএম লুৎফর রহমান।
একেএম মনিরুজ্জামান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এখনো সক্রিয় এবং বিভিন্ন ইস্যুতে নানা ধরনের গুজব শেয়ার করে থাকেন, যা আইন শৃঙ্গলা পরিস্থির অবনতির কারণ হতে পারে। এছাড়া গত বছর জুলাই আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে নানা পোস্ট দিয়েছেন।
২০১৬-১৭ সালে নীল দলের সভাপতি ছিলেন মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী সাইফুদ্দিন। তিনি আওয়ামী পরিবারের সন্তান। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তিনি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুর এর প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হয়েছিলেন। উপাচার্য থাকাকালে অর্থের বিনিময়ে চাকরি প্রদানসহ নানা অভিযোগে বেশকিছু জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
বর্তমান সরকারের সময়ে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে মনোবিজ্ঞান বিভাগে প্রফেশনাল মাস্টার্স প্রোগ্রামের পরিচালক হিসেবে বহাল তবিয়তে। এছাড়া তার নামে হেকেপ এর ফান্ড তছরুপের অভিযোগ একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। ২০১৬-১৭ কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন ইংরেজী বিভাগের ড. নাসির উদ্দীন।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন নীল দল একটি বৃহৎ দল হিসেবেই ক্যাম্পাসে পরিচিত ছিল। এরপর গঠনতন্ত্রকে অমান্য করে সাবেক উপাচার্য মিজানপন্থি কিছু শিক্ষক নীলদল থেকে বেরিয়ে বিভক্ত হয়ে ২০১৭ সালে আরেকটি নীলদল গঠন করে। এতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামীকে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক পদে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ-আল-মাসুদকে মনোনীত করা হয়।
বর্তমানে অরুণ কুমার গোস্বামী অবসরে আছেন। তবে নীল দলের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে আবদুল্লাহ-আল-মাসুদ পিএইচডি না থাকা সত্ত্বেও অধ্যাপক হন তৎকালীন উপাচার্যের আস্তাভাজন হিসেবে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহনপুলের প্রশাসক হিসেবে গত ২০ জুলাই ২০১৭ সাল থেকে ৩১ আগস্ট ২০২২ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
যথাযথ গবেষণাপত্র না থাকা, চাকরির বয়স পূর্ণ না হওয়া এবং পিএইচডি না থাকা সত্ত্বেও অধ্যাপক পদে পদান্নতি পান তিনি। তাছাড়া পরিবহন প্রশাসক থাকাকালীন তার নামে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পরিবহন সংক্রান্ত নানা মধ্যস্থতার টাকা লেনদেন এবং আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় বাস চালক ও পরিবহন পুলের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে তেল চুরির অভিযোগ উঠেছিল, যা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে শিরোনাম হয়।
২০১৭-১৮ সালে নীল দলের আরেক অংশের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম মনিরুজ্জামান এবং ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসির উদ্দীন। ড. নাসির উদ্দীন যদিও উপাচার্য মিজানের কারণে দীর্ঘদিন বরখাস্ত অবস্থায় ছিলেন। তবে হাইকোর্টের আদেশে তিনি এখন বিভাগের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত আছেন।
২০১৮-১৯ সেশনে নীল দলের একপক্ষের কমিটিতে সভাপতি ছিলেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ সেলিম এবং সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. একেএম লুৎফর রহমান। অপর অংশের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে ড. অরুণ কুমার গোস্বামী ও আব্দুল্লাহ আল মাসুদ।
২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জবির নীল দলের একাংশের নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এতে মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুদ্দীন সভাপতি ও গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সিদ্ধার্থ ভৌমিক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। ড. সিদ্ধার্থ ভৌমিক জুলাই আন্দোলন চলাকালীন ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপর নির্মম আক্রমণের জন্য তৎকালীন পরিবহন প্রশাসক হিসেবে তিনি ছাত্রলীগকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস প্রদান করেন। এতে করে জবি ছাত্রলীগ কর্মীরা ঢাবির টিএসসিতে গিয়ে হামলায় অংশ নেয়।
২০১৯ সালের ২৩ জুলাই অনুজীব বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জাকারিয়া মিয়াকে সভাপতি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের তৎকালীন সহযোগী অধ্যাপক মোস্তফা কামালকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। জাকারিয়া মিয়া লাইফ অ্যান্ড আর্থ সাইন্স অনুষদের দুইবারের ডিন ছিলেন এবং নিয়ম ভেঙ্গে গ্রেড-১ অধ্যাপক হন, যা নিয়ে বেশকিছু জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক মোস্তফা কামালকে জুলাই বিপ্লবের পর বিভাগের শিক্ষার্থীরা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে এবং জুলাই আন্দোলনের তিনটি হত্যা মামলার আসামি হয়েছেন তিনি। এখন পর্যন্ত তিনি ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত আছেন।
এরপর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০২১ সালের ৯ জুন নীল দলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটিতে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন সভাপতি এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৎকালীন সহযোগী অধ্যাপক কামাল হোসেন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ড. আবুল হোসেন শিক্ষক সমিতির সভাপতিও নির্বাচিত হন।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন থাকাকালে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের দায়িত্ব পান তিনি। একাডেমিক কমিটির সভায় উপাচার্য ড. ইমদাদুল হকের উপস্থিতিতে তিনি ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের এক শিক্ষককে চড় দেন, যার বিচার এখনো হয়নি। বতর্মানে তিনি বিভাগে কর্মরত আছেন।
আরেক অংশের ২০২১ সালের সভাপতি ছিলেন দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. হাফিজুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান। ড. মনিরুজ্জামান পরিবহন প্রশাসক থাকাকালে পরিবহন দপ্তরের নানা দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়।
তাছাড়া প্রভাব খাটিয়ে পিএইচডি ছাড়াই সহযোগী অধ্যাপক পদে ৬ মাসের বেশি সময় ধরে বেতন ভোগ করার পর আবারো সেই টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হন। বিভাগের চেয়ারম্যান থাকাকালে বিভাগের শিক্ষকদের অনাস্থার ভিত্তিতে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন। ওই কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক ড. আব্দুল কাদের।
২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি নীল দলের (একাংশ) ২৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। এতে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক পরিমল বালাকে সভাপতি ও সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল। জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সক্রিয় ছিলেন আনোয়ার হোসেন।
২০২১-২২ কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক ড. আইনুল হক এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন একেএম লুৎফর রহমান। অধ্যাপক ড. আইনুল হক জুলাই আন্দোলনে সরাসরি শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান নেন। এছাড়া ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট ফাসিস্ট হাসিনার সঙ্গে যে কয়েকজন শিক্ষক দেখা করেছিলেন, তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। এছাড়া প্রভাব খাটিয়ে তিনি উপাচার্য ড. সাদেকা হালিমের সময় ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাছাড়া তিনি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারাকাতের সঙ্গে নানা অর্থনৈতিক লেনদেনে জড়িত ছিলেন।
২০২২ সালের ৮ আগস্ট নীলদলের (একাংশের) কার্যনির্বাহী কমিটি সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জাকির হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাফিস আহমদ। জাকির হোসেন ইউজিসির সদস্য হিসেবে গত ৩ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে যান।
২০২৩ সালের গঠিত নীল দলের একাংশে সভাপতি হিসেবে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. নূরে আলম আব্দুল্লাহ এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোমিন উদ্দিন দায়িত্ব পেয়েছিলেন। নূরে আলম আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে নারী শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন সরবরাহ করা শিক্ষককে প্রশ্রয় দানের অভিযোগ রয়েছে। অধ্যাপক ড. মোমিন উদ্দিন গত বছর ১৫ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের সামনে মোনাজাতে অংশ নেন।
নীল দলের আরেক অংশে সভাপতি হিসেবে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান দায়িত্ব পেয়েছেন। জুলাই আন্দোলনের পর ড. ছিদ্দিকুর রহমানকে বিভাগের শিক্ষার্থীরা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন।
২০২৪-এর কার্যনির্বাহী কমিটিতে সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক ড. জাকারিয়া মিয়া এবং সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহ মো. আরিফুল আবেদ। জাকারিয়া মিয়া জুলাই হত্যা মামলার আসামি হয়েছেন।
বহু যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে শিক্ষক পদে নিয়োগ পান আরিফুল আবেদ। এছাড়া গত বছরের ৪ আগস্ট শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন।
নীল দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ-আল-মাসুদ বলেন, “২০১৭ সালে আমি সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। সবাই মিলে আমাকে বানিয়ে দিয়েছিল, তাই ছিলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়ম মেনেই অধ্যাপক হয়েছি। ২৫ বছর ধরে চাকরি করছি এবং কখনো নিজ যোগ্যতা ছাড়া কিছু নেইনি।”
তিনি বলেন, “আমার প্রতিপক্ষও আছে, কিন্তু নীতিভ্রষ্ট হইনি। এখনো আমি ভাড়া বাসাতেই থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন শাখায় অনিয়ম রোধে আমি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছি। তবে দায়িত্বটি অত্যন্ত কঠিন হওয়ায় আমি বারবার অব্যাহতির আবেদন করি এবং অবশেষে অব্যাহতি পাই।”
আইন বিভাগের শিক্ষক ড. আলী আক্কাস বলেন, “শিক্ষক সমিতির সভাপতি, চেয়ারম্যান ও ডিন হিসেবে নিয়ম অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করেছি।”
একসঙ্গে একাধিক দায়িত্ব পালনের ভাতা প্রসঙ্গে তিনি জানান, এগুলো প্রশাসনিক পদ নয়। তবে একাধিক প্রশাসনিক পদে ভাতা নেওয়ার নিয়ম নেই।
অবন্তিকার আত্মহত্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বিভাগে কোনো লিখিত অভিযোগ আসেনি। ঘটনাগুলো হয়েছিল ফেসবুক পোস্ট, থানায় ও প্রক্টরের অফিস পর্যন্ত। বিষয়টি যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটিতে পাঠানো উচিত ছিল, যা প্রশাসনের দায়িত্ব।”
মনোবিজ্ঞান বিভাগের কাজী সাইফুদ্দিন বলেন, “উপাচার্য তো মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। কেন দেন, সেটা তো আমি জানি না। যার প্রয়োজন মনে করেন, তাকেই করেন। ২০১৬-১৭ সালে আমি নীল দলের একটি অংশের সভাপতি ছিলাম এবং তৎকালীন উপাচার্য মিজান সাহেবের বিরুদ্ধে থাকা গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছি।”
তিনি বলেন, “মিজান স্যারের ৩৩ কোটি টাকার জমি কেনা ও শিক্ষক-ছাত্র নিগ্রহের অনিয়মের প্রতিবাদে আন্দোলন করেছি এবং এক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করিয়েছি। ছাত্রদলের গুলিবিদ্ধ এক শিক্ষার্থীর চিকিৎসা-সহায়তা জোগাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকা তুলে দিয়েছি, হল উদ্ধারেও সামনে থেকেছি। আমার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগপন্থি কারও নানা ষড়যন্ত্র থাকলেও আমি কারও অনুগত নই, শুধু রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তই মেনে চলেছি।”
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, “জুলাই আন্দোলনের সময় যারা শিক্ষার্থীদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েমের চেষ্টা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছি। এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং দায়ীদের শনাক্ত করতে কাজ চলছে।”
তিনি বলেন, “নিয়োগসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জুলাইয়ের পর আমরা একটি নতুন, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে হাঁটছি। সেখানে ফ্যাসিস্ট কোনো অপশক্তির স্থান নেই। আমরা সবাই ফ্যাসিস্ট অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করব।”
ঢাকা/মেহেদী
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর গণঅভ য ত থ ন আওয় ম ল গ মন ব জ ঞ ন ব ভ গ দ ল ল হ আল ম স দ উপ চ র য ম জ ন মন র জ জ ম ন শ ক ষকদ র স ন ল দল র এক ২০১৭ স ল পর বহন প ন ন ল দল হয় ছ ল ন তৎক ল ন সরক র র র রহম ন গত বছর গঠন কর ও পর ব র পর ব কম ট ত কম ট র সদস য অবস থ ইসল ম আগস ট সহয গ ত বছর র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
হামাসকে অস্ত্রত্যাগে ও গাজার শাসন ছাড়তে সৌদি, কাতার, মিসরের আহ্বান
ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ বন্ধে এ ভূখণ্ডে হামাসের শাসনের অবসান ঘটানো এবং সংগঠনটিকে নিরস্ত্রীকরণের আহ্বান জানিয়েছে কাতার, সৌদি আরব ও মিসরসহ একাধিক আরব দেশ।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের দ্বি–রাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রস্তাব পুনরুজ্জীবিত করতে গতকাল মঙ্গলবার জাতিসংঘের উদ্যোগে নিউইয়র্কে সংস্থাটির সদর দপ্তরে একটি সম্মেলন আয়োজন করা হয়। সেখানেই গৃহীত সাত পৃষ্ঠার একটি ঘোষণাপত্রে এ আহ্বান জানানো হয়। ঘোষণাপত্রটিকে সমর্থন করেছে ১৭টি দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লিগ।
ঘোষণায় বলা হয়, ‘গাজায় যুদ্ধ বন্ধে হামাসকে অবশ্যই তার শাসন (এ উপত্যকায়) শেষ করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ ও সমর্থনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। এটি একটি সার্বভৌম ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।’
ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশ এ ঘোষণায় স্বাক্ষর করে। এতে যুদ্ধ শেষে গাজায় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বিদেশি সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনার কথাও বলা হয়। সম্মেলনে ইসরায়েল ও তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেয়নি।আগের দিন, জাতিসংঘে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদল ইসরায়েল ও হামাস উভয়কে গাজা ত্যাগ করার আহ্বান জানায়; যাতে সাগর উপকূলবর্তী এ অঞ্চলটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পরিচালিত হতে পারে।
আরও পড়ুনগাজায় ত্রাণপ্রত্যাশী ৯৩ জনকে হত্যা ইসরায়েলি বাহিনীর, যুদ্ধের বর্বরতার নিন্দায় পোপ২১ জুলাই ২০২৫ঘোষণায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলারও নিন্দা জানানো হয়। তবে এ বিষয়ে এখনো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে নিন্দা জানায়নি। সম্মেলনের সহআয়োজক ফ্রান্স ঘোষণাপত্রটিকে ‘ঐতিহাসিক ও নজিরবিহীন’ বলে উল্লেখ করেছে।
আরও পড়ুনগাজায় হামলার নিন্দা জানালেও ইসরায়েলের সঙ্গে কেন বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে এসব দেশ১৮ ঘণ্টা আগেফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাঁ-নোয়েল বারো বলেন, ‘প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো হামাসের নিন্দা জানিয়েছে, ৭ অক্টোবরের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে, হামাসকে নিরস্ত্রীকরণের আহ্বান জানিয়েছে, ফিলিস্তিনি শাসন থেকে তাদের বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে ও ভবিষ্যতে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইচ্ছা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে।’
প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো হামাসের নিন্দা জানিয়েছে, ৭ অক্টোবরের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে, হামাসকে নিরস্ত্রীকরণের আহ্বান জানিয়েছে, ফিলিস্তিনি শাসন থেকে তাদের বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে ও ভবিষ্যতে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইচ্ছা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে।জ্যাঁ-নোয়েল বারো, ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশ এ ঘোষণায় স্বাক্ষর করে। এতে যুদ্ধ শেষে গাজায় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বিদেশি সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনার কথাও বলা হয়। সম্মেলনে ইসরায়েল ও তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেয়নি।
আরও পড়ুনগাজায় ‘এখনই যুদ্ধ থামাতে’ যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ ২৮ দেশের আহ্বান২২ জুলাই ২০২৫আরও পড়ুনইসরায়েলের স্নাইপাররা এমনভাবে গুলি ছুড়ছিলেন, যেন পশু শিকার করছেন: গাজার বাসিন্দা২১ জুলাই ২০২৫