গবেষকরা বিষ্ময়কর এক তথ্য সামনে এনেছেন, পাখিদের জীবন যাপনে বৈপ্লবিক এক পরিবর্তন এসেছে। অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষক বলছেন, ‘‘কিছু বন্য পাখি জেনেটিকভাবে পুরুষ হলেও তাদের স্ত্রী প্রজনন অঙ্গ রয়েছে। এমনকি দেখা গেছে, একটি পুরুষ কুকাবুরা ডিম পেড়েছে। যা প্রাণিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব এবং অবিশ্বাস্য বলে মনে করা হচ্ছে।’’
কুইন্সল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব দ্য সানশাইন কোস্টের আচরণবিজ্ঞানী ড.
আরো পড়ুন:
ফিরে দেখা: ন্যাশনাল লাভবার্ড চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৫
বিনষ্ট করা বাবুই পাখির বাসা প্রতিস্থাপন
গবেষণার তথ্য, ‘‘পাখিদের মধ্যে প্রায় ৬ শতাংশের জেনেটিক লিঙ্গ ও বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের অমিল রয়েছে। কেউ জেনেটিকভাবে পুরুষ হলেও ছিল ডিম্বাশয়সহ স্ত্রী প্রজনন অঙ্গযুক্ত, আবার কেউ জেনেটিক নারী হয়েও বহন করছিল পুরুষের বৈশিষ্ট্য।’’
গবেষণায় মিলেছে একটি জেনেটিক পুরুষ কুকাবুরার ডিম পাড়ার প্রমাণ। গবেষকরা জানান, ওই পাখির ওভিডাক্ট ফুলে ছিল, যা ডিম উৎপাদনের সময় হয়ে থাকে। এছাড়া ফোলিকলও বড় ছিল, যা সাম্প্রতিক ডিম্বসৃষ্টি নির্দেশ করে।
ড. পটভিন বলেন, ‘‘আমরা দেখতে পাই, যেসব পাখির লিঙ্গ পরিবর্তন হয়েছে, তাদের ৯২ শতাংশই জেনেটিক নারী ছিল, তবে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুরুষদের মতো। এই নমনীয়তা অবিশ্বাস্য।’’
যদিও গবেষণায় লিঙ্গ পরিবর্তনের সরাসরি কারণ নির্ধারণ করা যায়নি। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, পরিবেশে থাকা হরমোন-বিনষ্টকারী রাসায়নিক, প্লাস্টিক, কীটনাশক বা দূষিত পদার্থ এর জন্য দায়ী হতে পারে। উল্লেখযোগ্যভাবে, ডিম পাড়া কুকাবুরাটি আধা-নগরায়িত এলাকায় পাওয়া গিয়েছিল। যেখানে রাসায়নিক দূষণের প্রভাব বেশি।
এই গবেষণা আরও বলা হয়েছে, ‘‘পাখির লিঙ্গ নির্ধারণে শুধু ডিএনএ, পালক বা আচরণের ওপর ভরসা করলে প্রায় ৬% ক্ষেত্রে ভুল হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যা বিশেষ করে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির সংরক্ষণ কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’’
মাছ, উভচর, এমনকি সরীসৃপদের মধ্যে লিঙ্গ পরিবর্তনের ঘটনা আগে থেকেই জানা থাকলেও পাখিদের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত বিরল। এই গবেষণা সেই ধারণায় বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে বলে মনে করছেন প্রাণিবিজ্ঞানীরা।
গবেষক পটভিন বলেন, ‘‘এটি বোঝায় যে পাখির লিঙ্গ নির্ধারণ প্রক্রিয়া আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি জটিল এবং নমনীয়। এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও তা বদলাতে পারে।’’
সূত্র: এনডিটি ও ইকোনোমিক্স টাইমস
ঢাকা/লিপি
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
সুন্দরবনের বড় গেছো প্যাঁচা
শরতের সুন্দরবন দেখার প্রত্যয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে খুলনা থেকে ছোট্ট লঞ্চ গাংচিলযোগে শেখেরটেক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের উদ্দেশে রওনা হলাম। কিন্তু ঢাংমারীতে লঞ্চে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ায় শেখেরটেক পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। কটকা ও কচিখালীর তুলনায় এখানে পর্যটকদের আনাগোনা কম। শেখেরটেকে একটি কালীমন্দির রয়েছে। মন্দিরের আশপাশে বাঘের আনাগোনা বেশি। কিন্তু আমরা এবার ‘মামা’র খোঁজে আসিনি, এসেছি দুটি বিরল পাখির সন্ধানে। তবে লঞ্চ থেকে নেমেই মামার পায়ের তাজা ছাপ দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। সম্ভবত গত রাতে সে এখান দিয়ে হেঁটে গেছে।
একটি ছোট্ট বিরল পাখির খোঁজে টাওয়ারে যাওয়ার রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে আছি। চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। কিন্তু মুহূর্তেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা। মাথায় দু-তিনটি বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই পাখি খোঁজা রেখে ক্যামেরা বাঁচাতে টাওয়ারের দিকে দৌড় দিলাম। বৃষ্টি থামলে মন্দিরের দিকে গেলাম। কিন্তু বহুক্ষণ খুঁজেও দেখা পেলাম না। অথচ এর আগে অনেকেই এই দুটি স্থানে পাখিটির দেখা পেয়েছেন। কিন্তু বারবার রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরির খেলায় আমরা পাখিটি দেখতে ব্যর্থ হয়ে লঞ্চে ফিরে এলাম।
কিছুক্ষণ পর চারদিক অন্ধকার হয়ে সন্ধ্যা নামল। ক্যামেরা হাতে লঞ্চের সামনে যে যার মতো পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম নিশাচর এক বিরল পাখির খোঁজে। চারদিক সুনসান। ছোট্ট একটি ডিভাইসে পাখিটির কল (ডাক) বাজছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর শেখেরটেক খালের অন্য পাড় থেকে ডাকের প্রতি–উত্তর পাওয়া গেল। ডাকের উৎসের দিকে টর্চ ফেলে পাখিটিকে দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু খুঁজে পেলাম না।
প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টার পর পাখিটির অবস্থান শনাক্ত করা গেল পন্টুনের পাশে একটি বড় গাছে। খুব সাবধানে লঞ্চ থেকে পন্টুনে নামলাম। কিন্তু পাখিটি টের পেয়ে উড়ে গিয়ে অন্য একটি গাছে বসল। বুঝতে পারলাম সে বারবার গাছ বদল করবে। কাজেই নৌকা ছাড়া ওর কাছাকাছি যাওয়া যাবে না। লঞ্চের সঙ্গে নিয়ে আসা নৌকায় উঠে পাখিটি যে গাছে বসেছে, সেদিকে গেলাম। রাত ৯টা ২৮ মিনিট ১২ সেকেন্ডে পাখিটির প্রথম ছবি তুললাম। কিন্তু মাত্র ২৯ সেকেন্ড সময় দিয়ে পাখিটি উড়াল দিল। দ্বিতীয়বার পাখিটির ছবি তুললাম রাতের খাবার সেরে আরও দুই ঘণ্টা পর ঠিক রাত ১২টায়।
সুন্দরবনের শেখেরটেকে দেখা প্যাঁচাটি এ দেশের বিরল আবাসিক পাখি বড় গেছো প্যাঁচা। ইংরেজি নাম ব্রাউন উড আউল। স্ট্রিজিডি গোত্রের প্যাঁচাটির বৈজ্ঞানিক নাম Strix leptogrammica। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, চীনসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই পাওয়া যায়।
বড় গেছো প্যাঁচা বড় মাথা-চোখ, খাটো ঘাড় ও চওড়া ডানার পাখি। প্রাপ্তবয়স্ক প্যাঁচার দৈর্ঘ্য ৩৯ থেকে ৫৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৮০০ থেকে ১ হাজার ১০০ গ্রাম। কাঁধে চিকন সাদা ডোরাসহ দেহের ওপরটা ঘন বাদামি বা খয়েরি। দেহের নিচটা হলদে-সাদা ও তাতে থাকে সরু বাদামি ডোরা। মুখমণ্ডলের গোলক ডাম্বেল আকারের। গোলকের প্রান্ত কালো। এ দেশে পাখিটির যে উপপ্রজাতিটি দেখা যায়, তার মুখমণ্ডল গাঢ় বাদামি বা খয়েরি, ভ্রু সুস্পষ্ট ও সাদা এবং ঘাড়ের সামনের অংশে সুস্পষ্ট সাদা বন্ধনী দেখা যায়। চোখ হলদে। চঞ্চু ফ্যাকাশে নীলচে ও পা ফ্যাকাশে বাদামি। প্যাঁচা ও পেঁচীর চেহারা একই রকম।
সুন্দরবন ছাড়াও ওরা সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বন এবং ঢাকা বিভাগের পত্রঝরা বনের বাসিন্দা। অত্যন্ত লাজুক ও নিশাচর পাখিগুলোকে একাকী বা জোড়ায় দেখা যায়। দিনে বনের উঁচু কোনো গাছের ঘন পাতার আড়ালে বসে বিশ্রাম করে। ভোর ও সন্ধ্যায় উঁচু গাছ বা জায়গা থেকে মাটিতে বা পানিতে শিকার খোঁজে ও পায়ের তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে ইঁদুর, ছোট পাখি, সরীসৃপ ইত্যাদি শিকার করে খায়। নিচু কণ্ঠে ও গভীরভাবে ‘টু...হুও...’ বা ‘উ...হুও...’ শব্দে ডাকে।
জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে প্রজনন করে। সচরাচর গাছের গর্তে কাঠিকুটি ও ঝরা পালক বিছিয়ে বাসা বানায়। পেঁচী তাতে দুটি সাদা রঙের ডিম পাড়ে। প্রায় ৩০ দিন তা দিয়ে ছানা ফোটায়। সচরাচর পেঁচী ডিমে তা দেয় ও প্যাঁচা ডিমে তা–দানরত পেঁচী ও পরে ছানাদের খাওয়ায়। ছানারা প্রায় দেড় মাসে উড়তে শেখে। তবে এরপরও বেশ কয়েক মাস বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে। আয়ুষ্কাল প্রায় ১০ বছর।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়