মোহাম্মদপুরের ১১ বছরের মেয়েটিকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশে সংবেদনশীলতার অভাব ছিল: ইউনিসেফের প্রতিনিধি
Published: 10th, February 2025 GMT
সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া ১১ বছরের মেয়েটিকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সংবাদ পরিবেশনে সংবেদনশীলতার অভাব ছিল বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স। মেয়েটিকে উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রশংসা করলেও পুরো পরিস্থিতি সামাল দেওয়া এবং উপস্থাপনের কিছু ক্ষেত্রে শিশু সুরক্ষা নীতি লঙ্ঘন হয়েছে জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি।
আজ সোমবার এক বিবৃতিতে রানা ফ্লাওয়ার্স এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, কোনো শিশু যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে, তখন সে নতুন কিছু শেখার সুযোগে ভরপুর এক জগতে প্রবেশ করে। এই জগতে নতুন সব সংযোগ তৈরি করার সম্ভাবনার পাশাপাশি অজানা বিপদের ঝুঁকিও থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয়ের সূত্র ধরে ১১ বছরের একটি মেয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে তাকে বাড়ি থেকে অনেক দূরে উত্তরবঙ্গের একটি জেলা থেকে উদ্ধার করা হয়। ঘটনাটি দেশজুড়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। প্রশ্ন উঠছে—কীভাবে এমন একটি ঘটনা ঘটতে পারে, শিশুরা সঠিক দিকনির্দেশনা পাচ্ছে কি না এবং শিশুদের সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট করা হচ্ছে কি না।
রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের মতো আচরণ করবে, সেটা আশা করা ভুল। তাদের মস্তিষ্ক আবেগ, মনঃসামাজিক ও শারীরিক বিকাশের কাজে চলমান থাকে। তারা দুর্বল ও অসহায়। তাদের নিরাপত্তা ও সুস্থতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সমাজে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত সব বিষয় এখনো সুস্পষ্ট নয়। তবে এমন সংবেদনশীল ঘটনা কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে ভুক্তভোগীর মানসিক অভিঘাত থেকে বেরিয়ে আসা ও মর্যাদার বিষয়। ইউনিসেফ শিশুটিকে উদ্ধারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রচেষ্টার প্রশংসা করে। তবে গভীর উদ্বেগও প্রকাশ করে যেভাবে পুরো পরিস্থিতি সামাল দেওয়া ও উপস্থাপন করা হয়েছে, সে বিষয়ে। বিশেষ করে যেখানে শিশু সুরক্ষা নীতি লঙ্ঘন হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের ক্ষেত্রেও সংবেদনশীলতার অভাব দেখা দিয়েছে।
ইউনিসেফের প্রতিনিধি বলেন, এই শিশুটিকে উদ্ধারের সময় যা যা ঘটেছে, তা গভীর উদ্বেগজনক। পুলিশের মাধ্যমে সুরক্ষিত ও বেষ্টিত থাকার পরিবর্তে তাকে ক্যামেরায় সবার সামনে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে, যা তার মানসিক অবস্থাকে আরও নাজুক করে তুলেছে। শিশু আইন ২০১৩-এ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা আছে, এ ধরনের ঘটনা কীভাবে সামাল দেওয়া উচিত। ধারা ৫৪ (১)–এ কন্যাশিশুদের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু প্রোটোকলের উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা আছে, এমন পরিস্থিতিতে কন্যাশিশুদের একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে সংবেদনশীলভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করাতে হবে। এ সময় অবশ্যই শিশুটির আস্থাভাজন একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি সহায়তার জন্য তার সঙ্গে থাকবেন। এ ছাড়া ধারা ৯১–এ আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুদের জন্য শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তাদের ভূমিকার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তবে এ ঘটনায় আশ্চর্যজনকভাবে শিশুটির সাক্ষাৎকার রেকর্ড করা হয়। এর চেয়েও ভয়ংকর বিষয় হলো, শিশুটির পরিচয় গোপন না করে সাক্ষাৎকারটির ফুটেজ তখনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা হয়, যা প্রমাণ করে যে আইন মানা হয়নি।
রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, এমন পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে এই অনৈতিক পোস্টগুলো অবিলম্বে সরিয়ে ফেলা উচিত ছিল। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়ানো এই ভিডিওগুলো পরবর্তী সময়ে অনেক মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও ব্যবহার করতে দেখা গেছে, যদিও এই সংবাদমাধ্যমগুলো এমন সংবেদনশীল ও নাজুক ঘটনা নিয়ে খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর পরিচয় ও অন্যান্য তথ্য গোপন রাখার আইন সম্পর্কে অবহিত। সংবাদমাধ্যম এমন বেশ কিছু ভিডিও ও সিসিটিভি ফুটেজ বারবার শেয়ার করেছে। এর চেয়েও ভয়ের বিষয় হচ্ছে সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের বর্ণনায় প্রাপ্তবয়স্ক একজন পুরুষকে শিশুটির ‘বয়ফ্রেন্ড বা প্রেমিক’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। এভাবে একটি বিপজ্জনক ও ভুল ব্যাখ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে।
বিবৃতিতে রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, ‘আমাদের সবার পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিত যে এই শিশুটি ভুক্তভোগী। তাকে আমাদের দোষারোপ করা বা তার ঘটনা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। তার প্রয়োজন সুরক্ষা, গোপনীয়তা রক্ষা এবং নিজেকে সামলে নেওয়ার সুযোগ ও সহায়তা। সে নিতান্তই ১১ বছরের শিশু। সে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর ক্ষেত্রে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে মানসিকভাবে সক্ষম নয়। আর কোনো প্রাপ্তবয়স্কের কখনোই কোনো শিশুর বিশ্বাস, কৌতূহল বা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে শোষণ করা উচিত নয়।’
রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, ১১ বছর বয়সী শিশুটির এখন যা দরকার, তা হলো মানসিক ক্ষত থেকে সেরে ওঠার সময়, সুযোগ ও পরিবেশ। এটা তখনই সম্ভব যখন কর্তৃপক্ষ, সংবাদমাধ্যমসহ সবাই তার গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারকে সম্মান করবে। এমন একটি সমাজ গড়ে উঠুক, যেখানে প্রতিটি শিশু সুরক্ষিত থাকে, মূল্যায়িত হয়, সম্মানিত বোধ করে এবং ভয় বা ক্ষতি ছাড়াই বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ১১ বছরের শিশু ‘নিখোঁজ’, থানায় জিডিমোহাম্মদপুর থেকে ‘নিখোঁজ’ শিশুটির সন্ধান পেয়েছে পুলিশমোহাম্মদপুর থেকে ‘নিখোঁজ’ শিশুটি উদ্ধার হয়ে এখন র্যাবের হেফাজতে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম হ ম মদপ র স ব দনশ ল ১১ বছর র একজন প র পর স থ ত ইউন স ফ র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ