মামুন স্ত্রীর জন্য ইফতারি কিনে পাঠাতে চেয়েছিলেন, এর আগেই আসে তাঁর মৃত্যুর খবর
Published: 14th, February 2025 GMT
‘হামার ব্যাটা ম্যালা দিন থাকি রাজনীতি করে না। সে একন খেলাধুলা করে। ব্যাটা কি দোষ করছিল। তাক ওমরা ডাঙ্গে (পিটিয়ে) মারি ফেলাইলো। হামার বুক খালি করলা। তোমরা হামার ব্যাটাক আনি দেও। ওমারঘরে (দুর্বৃত্তদের) ফাঁসি দাও। হামরা ওমার বিচার চাই।’
আজ শুক্রবার দুপুরে এভাবেই বিলাপ করছিলেন নিহত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আল মামুন মণ্ডলের মা রনজিনা বেগম। তাঁর মৃত্যুর খবরে বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের ভিড়। সবাই মামুনের স্মৃতি হাতড়ে কান্নাকাটি করছিলেন। আজ দুপুরে মামুনের গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার ধাপেরহাট ইউনিয়নের খামারপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়িতে গিয়ে এ দৃশ্য দেখেন এই প্রতিবেদক।
আরও পড়ুনগাইবান্ধায় দুর্বৃত্তের হামলায় ছাত্রলীগ নেতা নিহত, লাশ নিয়ে মহাসড়ক অবরোধ১৭ ঘণ্টা আগেমামুন ওই গ্রামের হোটেল ব্যবসায়ী মান্নান মণ্ডলের ছেলে। তিনি ধাপেরহাট ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার উপজেলার ধাপেরহাট এলাকায় দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত হন তিনি।
মামুনের মায়ের আহাজারির সময় পাশেই ছিলেন তাঁর স্ত্রী দিনা খাতুন। তিনি বলেন, ‘গতকাল আমি রোজা রেখেছিলাম। মামুন বাড়িতে ছিল। বিকেল তিনটার পর মামুনের একটি ফোন আসে। ফোন পেয়ে সে ধাপেরহাট বাজারে যায়। যাওয়ার সময় বলে যায়, তোমার ইফতারি পাঠিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু পাঁচটার পর খবর পাই, ওকে মেরে ফেলা হয়েছে।’ তাঁর দাবি, পরিকল্পিতভাবে মামুনকে ডেকে নিয়ে রামদা, হকিস্টিক ও দেশীয় অস্ত্র দিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করতে পায়ের রগ কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘হত্যাকারীদের এমন শাস্তি দেওয়া হোক, যাতে আমার মতো আর কেউ বিধবা না হয়।’
সবার আহাজারি দেখে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল মামুন ও দিনার পাঁচ বছর বয়সী কন্যা আয়াত খাতুন। সে কী করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। এ সময় বিছানায় আহাজারি করছিলেন মামুনের বড় ভাই রকিব মণ্ডল। অভিযোগ করে তিনি বলেন, ছোট ভাইকে হত্যার পর দুর্বৃত্তরা ক্ষান্ত থাকেনি। ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল তাঁদের বাসায় হামলা চালায়। তাঁরা মামলা না করার জন্য ভয়ভীতি দেখিয়ে গেছে। মামলা করলে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে।
এদিকে আজ শুক্রবার সকালে মামুন মণ্ডলের বাবা মান্নান মণ্ডল বাদী হয়ে সাদুল্লাপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ২৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আজ বেলা দুইটা পর্যন্ত এ ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। মামুন মণ্ডলের বাবা মান্নান মণ্ডল জানান, কয়েক বছর ধরে মামুন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেট খেলা নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে আল মামুন মণ্ডল ধাপেরহাট বন্দরের জামদানি এলাকায় অবস্থান করছিলেন। এ সময় হঠাৎ সাত থেকে আটজন অজ্ঞাতপরিচয় যুবক মামুনের ওপর হামলা করেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুর্বৃত্তরা তাঁকে মারধর করতে থাকেন। একপর্যায়ে মামুন মাটিতে পড়ে চিৎকার করতে থাকেন। তাঁর আর্তচিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে দুর্বৃত্তরা দ্রুত পালিয়ে যায়। গুরুতর অবস্থায় মামুনকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার সময় তিনি মারা যান।
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে সাদুল্লাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজউদ্দিন খন্দকার জানান, ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে পুলিশ দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত ও আটক করতে অভিযান শুরু করেছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: করছ ল ন
এছাড়াও পড়ুন:
বক্সিং রিংয়ে চ্যাম্পিয়ন জিনাতই, বোনকে উৎসাহ দিতে গ্যালারিতে আফঈদা
কদিন ধরে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের আড্ডায় ঘুরেফিরে একটাই নাম জিনাত ফেরদৌস। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এই বক্সার প্রথমবারের মতো পা রেখেছেন জাতীয় বক্সিং রিংয়ে। আর প্রথমবারই নিজের জাত চেনালেন।
আজ বিকেলে পল্টনের মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়ামে ৫২ কেজি ওজন শ্রেণির ফাইনালে নেমে প্রতিপক্ষ আফরা খন্দকারকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নের মুকুট মাথায় তুলেছেন জিনাত। প্রতিযোগিতার আগেই যাঁর আগমন ঘিরে কৌতূহল ছিল তুঙ্গে, সেই জিনাত রিংয়ে নামতেই যেন বুঝিয়ে দিলেন, অন্যদের চেয়ে কেন তিনি এগিয়ে।
তিন রাউন্ডের লড়াইয়ে শুরু থেকেই জিনাত ছিলেন আক্রমণাত্মক। পাঞ্চে ছিল গতি, রক্ষণে ছিল আত্মবিশ্বাস। অন্যদিকে আফরা খন্দকার চেষ্টা করেছেন রক্ষণ সামলে লড়াইয়ে টিকে থাকতে। খান কয়েক মোক্ষম ঘুষিতে কিছুটা নড়বড়ে হলেও শেষ পর্যন্ত দমে যাননি আফরা।
বরং জিনাতের ঘন ঘন আক্রমণের ফাঁক গলে এক-আধটু পাল্টা আঘাত করতেও পেরেছেন। তবে এই পর্যায়ের এক প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত হয়ে পড়ে তাঁর জন্য অনেকটাই চাপের। তবু আফরা লড়ে গেছেন। আর জিনাতের আত্মবিশ্বাসী উপস্থিতি এ লড়াইকে করে তুলেছিল দেখার মতো।
গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছিলেন জাতীয় নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক ও আফরার বড় বোন আফঈদা খন্দকার। উৎসাহ দিচ্ছিলেন ছোট বোনকে। পাশে ছিলেন মা–বাবাও। তবে পরিবারের ষোলো আনা সমর্থনও জিনাতকে হারানোর জন্য যথেষ্ঠ হয়নি।
ম্যাচ শেষে আফরা বললেন, ‘তিনি একজন ভালো খেলোয়াড়। তাঁর বিপক্ষে খেলা আমার জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে তাঁর আক্রমণাত্মক স্কিলটা দুর্দান্ত। ম্যাচ শেষে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, গুড ফাইট।’
বিজয়ী জিনাত পরে কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘আমি সবাইকে বলতে চাই, বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা খেলতে চায়। তারা যদি সুযোগ-সুবিধা পায়, অনেক ভালো করবে। ওদের স্কিল আছে।’
সেমিফাইনালে আছিয়া না ফাইনালে আফরা—কোন লড়াইটা বেশি কঠিন ছিল? জিনাতের জবাব, ‘আমি আমার খেলাটা খেলেছি এবং জিতেছি। দুজনই আলাদা ধাঁচের প্রতিপক্ষ।’
জিনাত বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক পদক জয়ের আকাঙ্ক্ষার কথা আজও বলেছেন। আগামী এশিয়ান গেমসে সুযোগ পেলে পদক জিতবেন কি না, প্রশ্নের ছোট্ট উত্তর, ‘ইনশা আল্লাহ।’
আফরা-জিনাত ফাইনাল ম্যাচটা যেন ছিল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বক্সারের লড়াই নয়, এর বাইরেও চলছিল আরেক নাটক। ফাইনালের কয়েক ঘণ্টা আগেই বক্সিং রিংয়ে এক ব্যতিক্রমী দৃশ্য। আনসারের বক্সার জাহিদুল হক রেফারির রায় নিয়ে ক্ষোভ জানাতে রিংয়ে বসে পড়েন প্রতিবাদ হিসেবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বক্সার জনি ভদ্রর ঘুষিতে কপালে চোট পান জাহিদুল। চিকিৎসাও নেন। একপর্যায়ে রিংয়ের মাঝখানে বসেই অভিনব প্রতিবাদ জানান।
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ আনসার দল বাংলাদেশ বক্সিং ফেডারেশনের সভাপতির কাছে অভিযোগ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের হুমকি দেয়। একপর্যায়ে আনসারের প্রতিনিধিরা রিং ছেড়ে চলে যান। মুহূর্তেই ঘনীভূত হয়ে ওঠে অনিশ্চয়তা, আফরা-জিনাত ফাইনালটি আদৌ হবে তো? কারণ, আফরা বাংলাদেশ আনসারের প্রতিযোগী। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আনসার ফিরে আসে এবং প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।
এ বিষয়ে বক্সিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুস কুদ্দুস প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফাইটে হারলে যা হয়। হারলেই বলে অন্যায় হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত রিংয়ে ফিরে এসেছে, খেলেছে, এটা ভালো।’
ম্যাচ শুরুর ঠিক আগে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের একটি প্রতিনিধিদল গ্যালারিতে এসে জিনাতকে শুভেচ্ছা জানায়, তাঁকে উপহারও দেয় তারা। গ্যালারিতে বাড়তি উত্তেজনা আর গুরুত্ব যোগ করে ফাইনাল ম্যাচকে ঘিরে। আর দেশের সংবাদমাধ্যমের ব্যাপক উপস্থিতি তো ছিলই ম্যাচটা ঘিরে।