ট্রাম্প চীনে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের কী লাভ
Published: 17th, February 2025 GMT
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর শাসনের প্রথম ১০০ দিনের মধ্যেই চীন সফর করতে চান বলে জানা গেছে। সফরের পরিকল্পনা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে হয়তো। তবে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং নিশ্চিত হতে চান যে বৈঠক থেকে ইতিবাচক ফল আসবে। বর্তমান শুল্কযুদ্ধ আরও বাড়লে এই বৈঠক ভেস্তে যেতে পারে।
ট্রাম্প ও সির মধ্যে সংলাপ দুই দেশেরই স্বাগত জানানো উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে না সব অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যু একসঙ্গে মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় ‘বড় চুক্তি’ করতে চাওয়া। এর চেয়ে বরং তার স্বার্থ রক্ষায় কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে অগ্রগতি আনাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
চীন আমেরিকার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে তারও দুর্বলতা রয়েছে। চীন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। যেমন রিয়েল এস্টেট খাতের অস্থিরতা, সরকারি ঋণের বোঝা, দুর্বল ভোক্তা ব্যয়, জনসংখ্যার বার্ধক্য এবং প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি। এসব বিষয় ট্রাম্পের জন্য কিছুটা সুবিধা তৈরি করতে পারে। তবে যতটা আশা করা হচ্ছে ততটাও নয়। সি মনে করেন, চীনের এসব সমস্যা সাময়িক। বরং যুক্তরাষ্ট্র ও তার নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে।
সি আলোচনার মাধ্যমে কিছু সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করবেন। তিনি চান নতুন করে শুল্ক আরোপ না হোক, চীনের স্থায়ী বাণিজ্যসুবিধা যুক্তরাষ্ট্র বাতিল না করুক এবং মার্কিন উন্নত প্রযুক্তিতে চীনের প্রবেশাধিকার কিছুটা শিথিল করা হোক। এ জন্য বেইজিং কৌশলে নানা প্রলোভন ও চাপ প্রয়োগের নীতি নিতে পারে।
চীন হয়তো যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি কৃষিপণ্য ও জ্বালানি কিনতে রাজি হবে। সেখানে বড় বিনিয়োগও করবে, যা চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করবে। অবৈধভাবে আমেরিকায় থাকা নাগরিকদের ফেরত নিতে পারে চীন। দিতে পারে ইউক্রেন সংকট নিরসনে সহায়তার প্রস্তাবও।
ট্রাম্প চীন সফরে গেলে কিছু নির্দিষ্ট দাবি তুলতে পারেন। তাঁর প্রথম দাবি হওয়া উচিত যে চীন যেন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা খাতকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করে। রাশিয়ার যুদ্ধ সক্ষমতা ইউক্রেনে চলমান সংঘাত জিইয়ে রাখছে। তৈরি করছে ইউরোপ ও ট্রান্স-আটলান্টিক নিরাপত্তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি। যদি সি এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান, তাহলে ট্রাম্প পাল্টা চীনের সেইসব কোম্পানি ও ব্যাংকের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার কথা ভাববেন হয়তো, যারা রাশিয়াকে ড্রোন, স্যাটেলাইট ও অন্যান্য প্রযুক্তি পেতে সহায়তা করছে। ইউরোপকেও একই পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করতে পারেন। অন্যদিকে সি-কে এটাও স্পষ্ট জানানো হতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্র আশা করে, চীন তার অপূর্ণ প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করবে। বিশেষ করে মার্কিন জ্বালানি ও কৃষিপণ্য কেনার ব্যাপারে।
ট্রাম্প চীনের মার্কিন বিনিয়োগকেও স্বাগত জানাতে পারেন। তিনি এর আগেও বলেছেন যে চীনা কোম্পানিগুলোর ব্যাটারি ও বৈদ্যুতিক গাড়ির কারখানার মতো বিনিয়োগ তিনি সমর্থন করেন। এগুলো আমেরিকানদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রও চীনের কাছ থেকে কিছু প্রযুক্তি আদায় করবে, যাতে মার্কিন কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না থাকে। চীন বহু বছর ধরে বিদেশি কোম্পানিগুলোর প্রযুক্তি হস্তান্তরের শর্ত দিয়ে ব্যবসার সুযোগ দেয়। যুক্তরাষ্ট্রকেও চীনের সঙ্গে এই নীতিতে এগোতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা আগামী বহু বছর ধরে চলবে। তবে দুই দেশের নেতাদের মধ্যে বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণের সুযোগ এনে দেয়। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সুযোগ তৈরি হয়। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের এই প্রথম বৈঠক যদি ঠিকভাবে এগোয়, তাহলে চীনের সঙ্গে আরও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হবে। আর তা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করবে।পারমাণবিক অস্ত্র ইস্যুতেও অগ্রগতির সম্ভাবনা রয়েছে। ট্রাম্প চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আলোচনা চান। কিন্তু সি চীন পিং পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ বাড়াতে আগ্রহী। ২০৩৫ সালের মধ্যে চীন এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হতে চায়। আমেরিকান বিশ্লেষকরা মনে করেন ট্রাম্পের উচিত চীনের পারমাণবিক সক্ষমতা সম্পর্কে আরও স্বচ্ছতা দাবি করা। আর নিয়মিত আলোচনার মাধ্যমে পরমাণু, সাইবার ও মহাকাশ প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত ঝুঁকি কমানোর ব্যবস্থা করা।
তবে যেকোনো চুক্তির ক্ষেত্রে ট্রাম্পকে কিছু ছাড় দিতেই হবে। নতুন শুল্ক আরোপ না করার পাশাপাশি কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে আগের শুল্কও প্রত্যাহার করা হতে পারে। একই সঙ্গে চীনকেও দিতে হবে একই ধরনের ছাড়। চীনের স্থায়ী বাণিজ্যসুবিধা অক্ষুণ্ন রাখা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করতে পারে যে পারমাণবিক যুদ্ধ দুই দেশের জন্যই ধ্বংসাত্মক হবে। ট্রাম্প সি-কে ওয়াশিংটনে এক গালভরা আয়োজনে স্বাগত জানানোর প্রস্তাবও দিতে পারেন। এতে চীনা নেতৃত্বের মর্যাদার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে।
তবে কিছু বিষয় আলোচনার বাইরে থাকার সম্ভাবনা বেশি। মার্কিন প্রযুক্তির এমন কোনো স্থানান্তর ট্রাম্প অনুমোদন করবেন না, যা চীনের সামরিক সক্ষমতা বাড়ায়। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রি কমাবে না। তাহলে তাইওয়ানের ওপর চীনের দাবিকে সমর্থন দেওয়া হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা আগামী বহু বছর ধরে চলবে। তবে দুই দেশের নেতাদের মধ্যে বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণের সুযোগ এনে দেয়। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সুযোগ তৈরি হয়। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের এই প্রথম বৈঠক যদি ঠিকভাবে এগোয়, তাহলে চীনের সঙ্গে আরও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হবে। আর তা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করবে।
● বনি এস গ্লেসার জার্মান মার্শাল ফান্ডের ইন্দো-প্যাসিফিক প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক
নিউইয়র্ক টাইমস–এর ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ জাভেদ হুসেন
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবস থ র জন য আম র ক প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ
এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।
সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।
ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।
‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।
ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।
খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।
এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরীডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।
প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।
পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।
ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।
বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।
নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউবইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।
ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।
২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।