Samakal:
2025-09-18@06:07:32 GMT

আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষা

Published: 20th, February 2025 GMT

আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষা

কতকাল আগে দার্শনিক হেরেক্লিটিস কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিল কথাটা যে, জগতে সব কিছুই সর্বদা বদলে যাচ্ছে। ভাষার ব্যাপারে এ বক্তব্য খুবই সত্য। সমস্ত জীবিত ভাষাই সর্বক্ষণ বদলাচ্ছে। কিন্তু এটা কোনো দুঃখের ব্যাপার নয়, ভাষার জন্য; আনন্দের ব্যাপার বটে। জীবনের নিয়মই এই ক্রমাগত বদলাতে থাকে। যে-পরিবর্তন দেখে হেরেক্লিটিস দুঃখ পেয়েছিল তার কারণও জীবনের ভেতরেই রয়েছে। কারণটা হলো দ্বন্দ্ব ভাষাও বদলায় দ্বন্দ্বের কারণেই। প্রকাশের সঙ্গে প্রকাশিতব্যের একটা বিরোধ চলতে থাকে। গ্রহণের ইচ্ছা ও গ্রহণের ক্ষমতার ভেতর একটা ঝগড়া বাঁধে। এবং উভয় দিক থেকেই ভাষা প্রতিবাদ করে তার নিজের বিরুদ্ধে। সেই প্রতিবাদেই সে এগোয়; ক্রমাগত। এই ঘটনা যদি না ঘটে, যদি থেমে যায় দ্বন্দ্ব তথা প্রতিবাদ, তাহলে বুঝতে হবে তার মৃত্যু অত্যাসন্ন।
ব্যাপারটা বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও পুরোপুরি সত্য। এ ভাষা এগিয়েছে, বিস্তৃত হয়েছে, গভীর হয়েছে, নিজের বিরুদ্ধে নিজে দাঁড়িয়ে। তার বিরুদ্ধে আরো একটি প্রতিপক্ষ ছিল। সে হলো রাষ্ট্র। রাষ্ট্র কখনো মিত্র ছিল না বাংলা ভাষার। মিল ছিল না বললে সবটা বলা হয় না, বলতে হয় রাষ্ট্র ছিল শত্রুপক্ষ।
অনেক ভাষার ইতিহাসে দেখা যায় রাষ্ট্র সাহায্য করছে ভাষাকে, তার বিকাশে। প্রাচীন গ্রিসে অতি উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, তার ভাষা একটা ছিল না, ছিল সেখানে অনেক ক’টি উপভাষা; নগর রাষ্ট্র এথেন্স ঠিক করে দিলো কোনটি হবে মান ভাষা, এবং সেটিই ভাষা হলো সাহিত্যের ও যোগাযোগের; সে-ভাষাতেই গ্রিক সাহিত্য এসে পৌঁছেছে পরবর্তী পৃথিবীর কাছে। একই ঘটনা ঘটেছে পরের কালে ইংল্যান্ডে, ফ্রান্সে, জার্মানিতে, ইতালিতে। রাষ্ট্র ছিল ভাষার অনুকূলে, রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষা ছিল অভিন্ন, কেননা দেশ ছিল স্বাধীন। এসব দেশে একাধিক উপভাষা চালু ছিল, যেমনটা থাকা স্বাভাবিক। রাষ্ট্র মান-ভাষা ঠিক করে দিয়েছে, সেই ভাষাই মূল ভাষা হয়েছে একাধারে সাহিত্যের ও রাজদরবারের, যেমনি সম্ভ্রান্তের তেমনি জনগণের।
এও দেখেছি আমরা যে ভাষার গঠনে বড় লেখকেরা খুব বড় ও সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করেছেন যেমন দান্তে, লুথার ও পুশকিন। দান্তে প্রাচীন ল্যাটিনের আধিপত্য ভেঙে আধুনিক ইতালীয় ভাষার যে-অভ্যুদয় তার প্রধান সংগঠক ছিল; কাজটা করেছিল তিনি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে। মার্টিন লুথার যদিও ধর্মযাজকই, তবু বাইবেলের জার্মান অনুবাদের ভেতর দিয়ে নিজের মাতৃভাষাকে মুক্তির দিকে নিয়ে গেলেন। তেমনি ভাবে পুশকিনও রুশ ভাষার সংগঠনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মুখের ভাষাকে তাঁরা সাহিত্যের ভাষায় পরিণত করেছেন।
বাংলা এই দুই সৌভাগ্যের উভয়টি থেকেই বঞ্চিত। সূচনাকালে এ ভাষায় কোনো দান্তে, লুথার বা পুশকিন এগিয়ে আসেননি। তাকে এগোতে হয়েছে নিজে নিজেই। এগোতে হয়েছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। অতীতের ইতিহাসে বাংলা কখনোই রাষ্ট্রভাষা ছিল না। রাষ্ট্রভাষা ছিল সংস্কৃত, ফার্সি, ইংরেজি; চেষ্টা হয়েছিল উর্দুকে ওই জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করবার, সম্ভব হয়নি, তার আগেই রাষ্ট্র ভেঙে গেছে। কিন্তু অতীতে ভাঙেনি, সেকালে মানুষ এতটা বিদ্রোহী ছিল না, একালে যেমন।
বাংলায় পাল বংশের রাজারা রাজত্ব করেছেন। তারা বাঙালি ছিল। তাদের রাজসভায় বাংলার কোনো স্থান ছিল না। সেখানে সংস্কৃত ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তারপরে সেনেরা এসেছেন। তারা তো বাঙালি নন, বিদেশ থেকে এলেন, ভিন্ন তাদের চাল-চলন, ভিন্ন তাদের ভাষা। রাজসভায় সংস্কৃতের ব্যবহার আগের মতোই চলেছে। পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা থেকে প্রার্থনা পর্যন্ত সর্বত্রই ছিল সংস্কৃতের একক আধিপত্য। সংস্কৃত শুধু ভাষা নয়, দেবভাষা; তাই কেবল যে রাজা ও কবিরা তা নন, দেবতারাও চাইতেন সংস্কৃতের চর্চা হোক।
এক সময়ে সেনদের পতন হয়েছে। যারা এসেছেন তারাও বাঙালি নন, তাদের ভাষাও ভিন্ন। পাঠান ও মুঘলদের আমলে রাজভাষা ছিল ফার্সি। সম্ভ্রান্তরাও ওই ভাষাই ব্যবহার করতেন, বাংলা নয়।
এরপর এলো ইংরেজ। আরো দূর থেকে এসেছে, আরো দূরের এক ভাষা নিয়ে, সেই ভাষাকে চাপিয়ে দিয়েছে মানুষের ওপর; ফার্সি গেছে চলে, তার জায়গা দখল নিয়েছে ইংরেজি। এরই মধ্যে বাংলা ভাষার বিকাশ। এ হচ্ছে সাধারণ মানুষের ভাষা, ব্রাত্যজনের, অবহেলিত জনগণের। 

সংস্কৃতের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক আছে, কিন্তু সেটা যতটা না আত্মীয়তার তার চেয়ে বেশি বিদ্রোহের। সংস্কৃতের দৃষ্টিতে ভ্রষ্ট সে, অপভ্রংশ। সংস্কৃত ভাষায় লিখিত নাটকে নিম্নবর্গের পাত্র-পাত্রীরা অপভ্রংশে কথা বলতো, গ্রামের লোকের মতো, শহরের লোকদের আমোদ দেবার জন্য। বিদ্রোহটাও ওই রকমেরই ছিল হাস্যকর। কিন্তু বাংলার দিক থেকে ব্যাপারটা কৌতুকের ছিল না, ছিল জীবন-মরণের। বাংলা আত্মসমর্পণ করেনি, করলে শেষ হয়ে যেত।
আত্মসমর্পণ করেনি ফার্সি যুগেও। বাংলার স্বাধীন সুলতানেরা বাঙলা ভাষার প্রতি বিদ্বেষী ছিলেন না, তারা বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, এই প্রমাণ ইতিহাসে আছে। কিন্তু এ-তো স্বাধীনকে নয়, অধীনকে সাহায্য করা; আধিপত্য চাপিয়ে দিয়ে বলা, এবার তুমি যাও, যত পারো ঘুরে বেড়াও। রাজভাষা কোনো নির্জীব বোঝা নয়, সে অত্যন্ত সজীব, ভেতরে ঢুকে পড়ে, ভেতর থেকে বাধা দেয় মাতৃভাষার বিকাশকে। রাজদরবারে যে ভাষা চালু থাকে সেটিই হয় সম্ভ্রান্ত জনের ভাষা, সম্ভ্রান্তরাই হয় আদর্শ। সাধারণ মানুষ তাদেরই অনুকরণ করতে থাকে, ভক্তিতে কিছুটা, অনেকটাই ভয়ে। সংস্কৃতের বিরুদ্ধে যেমন, ফার্সির বিরুদ্ধেও তেমনি বিদ্রোহ করেই বাংলাকে এগোতে হয়েছে। বাংলা শান্ত কোমল ভাষা, তার বাক্য গঠন ‘না’টা আসে শেষে, যেন না-পারতে আসা; শুরুতে কিংবা মধ্যে সে ‘না’ বলে না, বলে শেষে এসে; কিন্তু ভাষা হিসেবে তাকে ‘না’ বলে বলেই এগোতে হয়েছে; অনেকটা শান্ত নদীর মতোই, সে তার দু’ধারের ও সামনের সব প্রতিবন্ধককেই অমান্য করে, নীরবে, এতো নীরবে যে মনে হয় বশ্যতা স্বীকার করেছে, কিন্তু স্বীকার তো করেনি, করলে হারিয়ে যেতো কোথায়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো কবে।
এ কাজটা ফ্রাইডে’রা করে না। ড্যানিয়েল ডিফো’র ‘রবিনসন ক্রুশো’ নামের উপন্যাসে ফ্রাইডে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়, ভাষান্তরিতও হয়ে যায়। ধর্মান্তরের চেয়েও ভাষান্তর মৌলিক ঘটনা; ধর্ম ভোলা অনেক সহজ, ভাষা ভোলার তুলনায়। রবিনসন ক্রুশো ফ্রাইডে নিমক ও ইংরেজি ভাষা দু’টোই খাইয়েছিল পরিণামে ফ্রাইডে কখনো নিমকহারামি করেনি। ভাষা তো কেবল ভাষা নয়, সে চিন্তারও অংশ হয়ে যায়, স্থায়ী হয়ে বসে পড়ে চেতনায়, এবং প্রভাব বিস্তার করতে থাকে বংশপরম্পরায়।
হ্যাঁ, বাংলা প্রভাব নিয়েছে। সংস্কৃতের প্রভাব তো ছিলই, সেখান থেকেই উৎপত্তি, তদুপরি সংস্কৃতভাষীদের শাসনাধীনে ছিল বাঙালি; শাসকরা তাদের প্রভাব ভাষার ওপর ফেলেছেন, যেমন ফেলেছেন মানুষের জীবনের ওপর। শাসনাধীন থাকার কারণে ফার্সির প্রভাবও রয়েছে বাংলার শব্দভাণ্ডারে। পর্তুগিজ যাজক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগের দরুন তাদের শব্দও পাওয়া যাবে। কিন্তু মূলধারা কখনোই কারো কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। সর্বদাই প্রতিবাদের ও সৃষ্টির পথ ধরে এগিয়েছে সে, ওই নদীর মতো, যার ধারা প্রবাহে অনেক শাখা ও উপনদী এসে মেলে, কিন্তু কোনোটিই মূল প্রবাহকে বিচ্যুত করতে পারে না, আপন ধারা থেকে।
পরে এলো ইংরেজ। ইংরেজ শাসন বাংলা ভাষার অনেক উপকার করেছে বলে প্রসিদ্ধি আছে। তা করেছে বৈকি; অস্বীকার করবে কে। আধুনিক গদ্যের সৃষ্টি ইংরেজ আমলেই, আধুনিকতার সৃষ্টিও এই সময়েই। বাক্যের যতিচিহ্নগুলো আমাদের দিয়েছে, কোথায় কতটা থামতে হবে সেটা জানিয়েছে, শিখিয়েছে গতি যোগ করবার কলা-কৌশল। তারা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছে; ভাষার চর্চা যার ফলে সহজ হয়েছে। কিন্তু ইংরেজ আমাদের বাংলা গেলাতে আসেনি, চায়ওনি; চেয়েছে ইংরেজি গেলাতেই। বলেছে মেনে নাও, মেনে নিয়ে স্বাধীনভাবে বাংলার চর্চা করো। কথাটা পাঠানরা বলেছে একভাবে, ইংরেজরা বলেছে অন্যভাবে, কিন্তু মূল বক্তব্য অভিন্ন। এ হচ্ছে অধীনের স্বাধীনতা, অধীন হয়ে স্বাধীন হওয়া, হয়তো-বা অধীনতাকেই স্বাধীনতা বলে ভুল করা।
ইংরেজ আমলে খ্রিষ্টান মিশনারিরাও বাংলা শিখেছেন, বাংলায় বই লিখেছেন, কিন্তু বিদ্রোহী সৃষ্টির লক্ষ্যে নয়, অনুগত সৃষ্টির লক্ষ্যেই। পরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ একটা ভূমিকা রাখলো। রাষ্ট্র এলো বাংলার সেবায়। তাতে বাংলার উপকার হয়নি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ যে পণ্ডিতদের কাজে লাগিয়েছিল তাঁদের অনুরাগ ছিল সংস্কৃতের প্রতি, বাংলার প্রতি নয়। ফলে বাংলা গদ্য সংস্কৃতভারাক্রান্ত হয়ে পড়বে, এবং তা জনগণের ভাষা রইবে না এমন একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। ইংরেজ শাসনে রাষ্ট্রের পক্ষপাত ফার্সির প্রতি ছিল না, ছিল সংস্কৃতের প্রতি, কারণ ফার্সিওয়ালাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তবেই ইংরেজের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে, সে হিসেবে ফার্সি শত্রুর ভাষা। বাংলা থেকে ফার্সি শব্দ তাড়িয়ে দিয়ে সে-জায়গায় সংস্কৃত আসুক এ কাজ সাহেবরা বেশ পছন্দ করতো, পণ্ডিতরা তো করবেই। চেষ্টা ছিল বাংলাকে সংস্কৃত ভাষার অনুগত করে রাখার। কিন্তু সে-উদ্যোগ সফল হয়নি। বাংলা এগিয়ে গেছে, প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদ আসলে ছিল দু’টো, একটি ইংরেজির বিরুদ্ধে অপরটি ইংরেজদের পক্ষপাতপুষ্ট সংস্কৃতবাহুল্যের বিরুদ্ধে। একটি বড়, অপরটি ছোট, কিন্তু দুটি অভিন্ন।
যেমনটি স্বাভাবিক, ইংরেজও তাই চেয়েছিল। চেয়েছিল বাঙালি নয়, এদেশে অসংখ্য ছোট-বড় ফ্রাইডে তৈরি হোক। ঔপনিবেশিক শাসক হিসেবে রবিনসন ক্রুশো শেক্সপীয়রের প্রসপেরোর তুলনায় অনেক বেশি দক্ষ। প্রসপেরো জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করেছে, রবিনসন প্রয়োগ করলো ভাষাবিদ্যা। এ কৌশলটা যে অধিক কার্যকর কে তা অস্বীকার করবে। ভাষার শক্তি সম্পর্কে একটি শিশুও খবর রাখে, যা ফ্রয়েড খুব সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, শিশু সহজেই বুঝে ফেলে কথা দিয়ে কেমন করে বয়স্কদের বশে আনা যায়। শিশু যা বোঝে একালের ঔপনিবেশিক সরকার তা বুঝবে না কেন। রবিনসন যা করেছে তার নির্জন দ্বীপে সেই একই কাজ অনেক ব্যাপক ও দক্ষ উপায়ে ইংরেজ করেছে আমাদের দেশে।
এমনকি মাইকেল মধুসূদন দত্তও তো ফ্রাইডেই হতে চেয়েছিলেন। ধর্ম, ভাষা সবই ত্যাগ করেছিলেন তিনি, ইংরেজিতেই লিখছিলেন। কিন্তু ভেতরের যে বাঙালিটি ছিল, মেধাবান ও বিদ্রোহী, সেটিই বিদ্রোহ করল ফ্রাইডে হবার জন্য রাষ্ট্রীয় প্ররোচনার বিরুদ্ধে। মহাকাব্যে তিনি ছিন্ন করলেন পয়ারের বন্ধন; প্রহসনে উগ্র আধুনিকতা ও সনাতনীদের দৌরাত্ম্যকে। প্রত্যাখ্যান করলেন ইংরেজিকে, লেখক হতে চাইলেন না ‘ক্যাপটিভ লেডি’র। পা ছিল মাটিতে, প্রাণে ছিল বিদ্রোহ, তাই তো তাঁকে রণপা পায়ে চড়িয়ে হাঁটতে হয়নি, তাইতো তিনি বাংলা ভাষাকে এগিয়ে দিয়ে গেলেন যেমন সম্পদে তেমনি সম্ভ্রমে।
অনেকে মনে করেন বাংলা গদ্যের সূত্রপাত রামমোহন থেকেই। তাঁর আগে চিঠিপত্রের, দলিল দস্তাবেজের, ধর্মপ্রচারের জন্য একটা ভাষা ছিল, কিন্তু প্রকৃতই যাকে গদ্য বলে, যে হচ্ছে আদান-প্রদানের ভাষা তা ছিল না। রামমোহনের জীবন প্রতিবাদের ঘটনাপঞ্জি। তিনি যেখানে থাকবার কথা সেখানে রইলেন না। কর্মচারী হয়ে রইলেন না ইংরেজদের, যদিও শুরু করেছিলেন সে-ভাবেই। স্বাধীন ব্যবসায় ধরলেন। আরবি-ফার্সিতে লিখতেন, সে-অভ্যাস ত্যাগ করলেন, ইংরেজিতেও লিখেছেন, কিন্তু ইংরেজির লেখক হলেন না, চর্চা করলেন বাংলার, যেটি একটি বড় প্রতিবাদ বটে। সংস্কৃতিতে লিখিত শাস্ত্রীয় গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করলেন, শাস্ত্রব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীর ভঙ্গিতে। গদ্য লিখে একেশ্বরবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতা প্রচার করলেন, পুরোপুরি বিদ্রোহী হিসেবে।
সতীদাহের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে। আবার ইংরেজ পাদ্রীদের সঙ্গে লিপ্ত হলেন দ্বন্দ্বে; সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে বললেন।
পাদ্রী ও পণ্ডিতদের ভূমিকায় বিদ্রোহ না-থাকাটাই বাংলা গদ্যের সৃষ্টিতে তাদের ভূমিকাটিকে খর্ব করে দিয়েছে, ঠিক যেমন ভাবে রামমোহনের বিদ্রোহ তাঁর ভূমিকাকে বড় করেছে। বাংলা গদ্যকে আমরা রামমোহনের বিদ্রোহকে বাদ দিয়ে ভাবতেই পারি না; সংস্কৃত, ফার্সি ও ইংরেজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন সেই অন্ধকার কালে। না, তিনি জার্মানির লুথার নন, বাংলা ভাষাকে জনগণের কাছে নিয়ে যাননি, তার গঠনের বৈপ্লবিক ভূমিকার দাবিও তিনি করবেন না, কিন্তু সংস্কৃত, ইংরেজি ও আরবি-ফার্সি এই তিন ভাষার তিনমুখী আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাংলাকে যে সম্ভ্রান্ত ও অগ্রগামী করে গেলেন তাতে সন্দেহ কী। 

লেখক

ইমেরিটাস অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: দ বন দ ব জনগণ র ক র কর র জন য কর ছ ন করল ন

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদ নিয়ে যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে

ফরাসি বিপ্লবের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলা হয়ে থাকে ‘বিপ্লব তার সন্তানদেরই খেয়ে ফেলে’। আধুনিক যুগের বিপ্লব প্রায়ই পুরোনো সংবিধানকে খেয়ে ফেলে। ব্রিটিশ রাজকবি আলফ্রেড টেনিসনের ভাষায়, পুরোনো বন্দোবস্ত সরে গিয়ে স্থান করে দেয় নতুন ব্যবস্থাকে। জার্মান আইনবিদ কার্ল স্মিটের ভাষায়, ‘স্টেট অব এক্সেপশন’ অর্থাৎ ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’র উদ্ভব ঘটে। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম পুরোধা এবি সিয়েসের মতে, জনগণের গাঠনিক ক্ষমতার উন্মেষ ঘটে।

স্মিটের মতে, ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় যে বা যাঁরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তিনি বা তাঁরাই সার্বভৌম। এই সার্বভৌম শক্তি আইনের বাইরে ও আইনের ঊর্ধ্বে। পুরোনো আইনব্যবস্থা, শাসনতন্ত্র, ক্ষমতাকাঠামো বা বিধিবিধান, কোনো কিছু দিয়েই এই পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করা যায় না; সেসব থেকে এর চূড়ান্ত বৈধতার নিদান খোঁজাও যায় না। পুরোনো ব্যবস্থা সেই সমাধান দিতেও সক্ষম নয়। বিদ্যমান সবকিছুই পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায় নয়া সার্বভৌম শক্তির সব সিদ্ধান্তের অধীনে প্রয়োগ হয়।

চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামোয় যে অবস্থা বিরাজ করছে, সেটাকে এক ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’ বলা যায়। কারণ, বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় এটাকে ব্যাখ্যা করা ও সেই ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না; কোনো না কোনো অধিসাংবিধানিক প্রক্রিয়ার শরণ নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

বাস্তবে ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ পুরোনো ব্যবস্থার পদ্ধতি মেনেই নেওয়া হয়। কারণ, পদ্ধতিগুলো প্রায় সব জায়গাতেই একই থাকে। পার্থক্য থাকে শুধু কোন সার্বভৌম শক্তি সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, কেন, কীভাবে, কখন, কাকে দিচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে।

আরও একটি কারণে আগের মতো করেই কাজগুলো করা হয়, সেটা হলো, এ পদ্ধতিগুলো শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা, সার্বভৌম শক্তিকে সাধারণ জনগণের কাছে সহজে অনুভূত বা আবির্ভূত হওয়া ও অনুকরণযোগ্য সবচেয়ে ভালো শাসনতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রয়োগ করা সুবিধাজনক। কিন্তু যত যা–ই হোক না কেন, সব সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপই নতুন সার্বভৌম শক্তির সিদ্ধান্তের অধস্তন হয়ে যায়।

২.

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আমরা যে ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় ঢুকে গিয়েছি, তা ছাত্র–জনতার দাবি ও সক্রিয় আন্দোলনের মুখে সাংবিধানিক পদাধিকারী বিভিন্ন ব্যক্তির পদত্যাগ বা অব্যাহতির ঘটনা থেকে আঁচ করা যায়। স্বাভাবিক সাংবিধানিক অবস্থায় ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ বা জাতীয় সংসদে অভিশংসনের প্রক্রিয়া ছাড়া এদের পদচ্যুত করার সুযোগ নেই; কিন্তু সবই হয়েছে আর তা হয়েছে পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায়, যেখানে অভ্যুত্থানে বিজয়ীদের অভিপ্রায়ই প্রাধান্য লাভ করে।

তত্ত্বে যেভাবেই থাক না কেন, আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার ইতিহাসে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৯৫৮ সালের পাকিস্তানে আইয়ুব খান সংবিধান রদ করে ‘আইন (বলবৎকরণ) আদেশ, ১৯৫৮’ জারি করেন। তাতে ১৯৫৬ সালের সংবিধানকে মৃত সংবিধান অভিহিত করে রদ করা হলেও সেটিকেই আবার ‘ভেন্টিলেশন’–এ আনা হয়। বলা হয়, রাষ্ট্রীয় সব কর্মকাণ্ড যত দূর সম্ভব ‘মৃত সংবিধান’ অনুযায়ীই চলবে, তবে সামরিক আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে।

১৯৬৯ সালে আইয়ুব নিজেই যখন মসনদ ছাড়তে বাধ্য হন, তখন ইয়াহিয়া খান মার্শাল ল জারি করে সংবিধান রদ করে হুবহু একই পদ্ধতি অবলম্বন করেন ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৬৯’ দিয়ে।

আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে মতভেদ এত প্রবল কেন?৩০ আগস্ট ২০২৫

বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্টে জারি করা মার্শাল ল প্রোক্লেমেশনের ঙ ও চ—দফার মাধ্যমে ঘোষণাপত্র ও সামরিক আইন বিধিমালা ও আদেশ সাপেক্ষে সংবিধান বলবৎ রাখা হয়। এই অধিসাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনেই ১৯৭৫-৭৯ পর্যন্ত প্রণীত অনেকগুলো ‘প্রোক্লেমেশন অর্ডার’ বলেই সংবিধান সংশোধন করা হয়।

এসব সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন ঘটানো সাংবিধানিক কাঠামো দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করে ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সেই সাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনেই সম্পন্নের পর গঠিত জাতীয় সংসদে সেগুলো অনুমোদিত হয়। ভুলে গেলে চলবে না যে পঞ্চম সংশোধনী দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে সংবিধানে কোনো সংশোধনীই আনা হয়নি, শুধুই অধিসাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনে আনা সংশোধনীগুলোই অনুমোদন করা হয়।

১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সংবিধান স্থগিত করে দেন এবং আরেক কাঠি সরেস হয়ে ২৪ মার্চ ১৯৮২ জারি করা মার্শাল ল প্রোক্লেমেশনকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে ঘোষণা করে এর অধস্তন হিসেবে পূর্ববর্তী সব আইনকানুন, ব্যবস্থা চালু রাখেন। এর অধীনে তিনিও ‘প্রোক্লেমেশন অর্ডার’ জারি করে সংবিধানে সংশোধনী আনেন, যেগুলো পরে সপ্তম সংশোধনী হিসেবে অনুমোদিত হয়।

১৯৭১ সালে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশ সরকার একটি আইন জারি করে ‘আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ, ১৯৭১’ নামে। এ আইনের বলে ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত বিদ্যমান সব আইন, বিধিবিধানকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অধীনে কার্যকর রাখা হয়। এরও আগে ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির সময়েও দেখা যায়, নতুন বন্দোবস্তের আলোকে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ এর ১৮(৩) ধারাতেও উভয় রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আগের সব আইন কার্যকর রাখা হয়।

এসব দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যায়, যারাই একটা নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করে, তারা পূর্বের সংবিধান বা আইনি কাঠামোর যেটুকু মানতে চায়, সেটুকুই নিতে পারে। চাইলে পুরোটাই নিতে পারে, না চাইলে পুরোপুরি বাদও দিতে পারে। একবার পূর্ববর্তী সংবিধানের কিছু নিয়েছে বলেই তা সব সময় মেনে চলতে হবে, এ রকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

প্রকৃতপক্ষে এটা অভ্যুত্থানের একটা মূলনীতি; পূর্বের কাঠামো থেকে যত দূর সম্ভব বেরিয়ে আসা। কিন্তু যত দিন পর্যন্ত পুরোপুরি বেরিয়ে আসা সম্ভব না হয়, তত দিন আগের রাষ্ট্রকাঠামোর কলকবজাগুলো প্রয়োজনমতো গৃহীত বা বর্জিত হয়। তাদের এই ম্যান্ডেট দেয় অভ্যুত্থানকারী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী।

৩.

এমন পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের রাজনৈতিক পরিসরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা আরেকটা বয়ান নিয়ে দুটো কথা না বললেই নয়। এটি প্রথম প্রকাশ্যে আনেন কবি, লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। তাঁর মতে, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী শপথ নেওয়ার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘বিপ্লবী চরিত্র’ নষ্ট হয়ে গেছে।

ফরহাদ মজহারের এ রকম বক্তব্যে যুক্তি আছে কি নেই, তাঁর চেয়ে বড় কথা হলো, গণ–অভ্যুত্থানের রাজনীতি, সরকারের বৈধতা, শাসনতান্ত্রিক পরম্পরার ব্যাপারগুলোতে এটাই একমাত্র বা শেষ কথা নয়। এর কারণটি হলো, কাঠামো বদলে গেলেই বৈধতার নতুন পথ তৈরি হয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানিরা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী অনেক জাতীয় পার্লামেন্ট সদস্যকে (এমএনএ) অযোগ্য ঘোষণা করে। তারপর সেসব আসনে উপনির্বাচন দিয়ে বেশির ভাগ আসনে পছন্দের প্রার্থীদের একতরফাভাবে জিতিয়ে আনে।

কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী পূর্বের পার্লামেন্ট সদস্যরাই গণপরিষদের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেন। একই সময় পাকিস্তানেও একটি গণপরিষদ গঠিত হয় ’৭০–এর নির্বাচনে বিজয়ীদের নিয়ে, যেখানে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত দুজন এমপি ছিলেন নুরুল আমীন ও রাজা ত্রিদিব রায়। বাংলাদেশের গণপরিষদে আবার এই দুজনকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।

এ থেকে বোঝা যায়, জনগণের অভিপ্রায় বদলে গিয়েছিল বলেই নতুন কাঠামোর জন্ম হয়েছিল, বৈধতার নতুন নতুন নিয়ম ও পদ্ধতি তৈরি হয়েছিল।

বিশুদ্ধ রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া পরবর্তী সংসদকেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বাধ্য করার সুযোগ নেই। কারণ, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত সেই সংসদও নিজেদের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ম্যান্ডেট পাবে। তখন তারা নতুন আরেকটি সাংবিধানিক কাঠামোর জন্ম দেবে। তারা যদি জুলাই সনদের আংশিক বাস্তবায়ন করে, তখন তাদের বাধ্য করার ক্ষমতা সংবিধানে থাকবে না; শুধুই রাজপথই হতে পারে তার সমাধান।৪.

আধুনিক কালে সরকার বা কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈধতার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পথ হলো সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ভূখণ্ডের নাগরিক, সামাজিক–রাজনৈতিক সংগঠন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভ। শুরুতেই জনগণ ও বহির্বিশ্বের স্বীকৃতির ভেতর দিয়ে জুলাই-উত্তর নয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা তার সার্বভৌম ক্ষমতা সুসংহত করেছে।

এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে চলতি সংবিধানের আওতায় শপথ নিলেও তাতে অন্তর্বর্তী সরকারের বিপ্লবী চরিত্র ক্ষুণ্ন হয়নি বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ, ৩৬ জুলাই এখানে জনগণের গাঠনিক ক্ষমতার উন্মেষ ও একটা ‘পরম ব্যতিক্রমী অবস্থা’র জন্ম দিয়েছে।

‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’ সার্বভৌম ক্ষমতাকে বাছাই করার ম্যান্ডেট দেয়, কী করতে হবে আর কী না করলেও চলবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে আদালতের মতামত নেওয়া এবং বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণকে ‘অবৈধ’ বলার সুযোগ নেই।

আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে কিছু ভাবনা১৮ আগস্ট ২০২৫৫.

তাহলে জুলাই সনদ নিয়ে কি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে? এর জবাব হলো, সেটা হতেও পারে, আবার না–ও হতে পারে। এটাও সার্বভৌম ক্ষমতার সিদ্ধান্তের বিষয়। এ রকম প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন হলো, আগামী নির্বাচন কি গণপরিষদ নির্বাচন হবে? সেখানে কি জুলাই সনদ অনুযায়ী সংবিধান পুনর্লিখন করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত?

লক্ষণীয়, ১৯৭২ সালে গঠিত গণপরিষদ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তারা পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য রায় পেয়েছিলেন। আবার সেই নির্বাচনে জয়ী দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে ভোট পেয়েছিল ৭৫ দশমিক ১১ শতাংশ। ফলে অঙ্কের হিসাবেই এখানকার ২৫ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্বও সেই গণপরিষদের ছিল না।

আবার গণপরিষদ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে গণপরিষদের সদস্যদের সদস্যপদ বাতিল আদেশ পাস করে এর তাঁদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মতপ্রকাশের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এভাবে ২০ জনকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল। ফলে ওই গণপরিষদের পক্ষে স্বাধীনভাবে জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা সম্ভব ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

সর্বোপরি ওই গণপরিষদের দ্বারা প্রণীত সংবিধান অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি; এ দেশে বারবার ঘটা গণ–অভ্যুত্থান, সংবিধান স্থগিত, সংবিধান পুনর্লিখনের মতো ঘটনাগুলো থেকেই তা বোঝা যায়। এর ফলে জনগণকে স্বাধীনভাবে তাদের অভিপ্রায় প্রকাশের সুযোগ দিতে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিকে ইতিবাচক বলেই প্রতীয়মান হয়।

 এ রকম পটভূমিতে জুলাই সনদের আইনগত অবস্থান বা এর বাস্তবায়নের পদ্ধতিকে বিবেচনায় নিতে হবে। ৫ আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় থাকা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা। আর এই পুরো কর্মযজ্ঞের প্রতিভূ হিসেবেই ধরতে হবে জুলাই সনদকে। সে ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বন্দোবস্তের ভেতর দিয়েই এর বাস্তবায়ন হওয়াই মানানসই হয়।

আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে গতানুগতিক সাংবিধানিক বন্দোবস্তে ফেরত আসার পর জুলাই সনদের বাস্তবায়নকে বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে বা এর মুখাপেক্ষী করা হলে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা তার কর্তৃত্ব হারাবে। এতে যে সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে উৎখাত করে জুলাই সংঘটিত হয়েছিল, সেই ব্যবস্থার অধীনেই জুলাই অভ্যুত্থানের বৈধতা-অবৈধতার বিচার বা পর্যালোচনার বিষয়টি উন্মুক্ত হয়ে পড়বে।

আরও পড়ুনজুলাই ঘোষণাপত্র: জন-আকাঙ্ক্ষা এবং রাষ্ট্রের অভিপ্রায়০৮ আগস্ট ২০২৫

আবার পরবর্তী সংসদই কেবল এগুলো বাস্তবায়ন করার আইনগত ক্ষমতার অধিকারী, এটাও অলঙ্ঘনীয় কোনো ব্যাপার নয়।

পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর ক্ষেত্রে এ রকম দেখা গেছে; একইভাবে জুলাই সনদ আগে বাস্তবায়ন করে পরে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে অনুমোদন নেওয়া যেতে পারে।

বিশুদ্ধ রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া পরবর্তী সংসদকেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বাধ্য করার সুযোগ নেই। কারণ, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত সেই সংসদও নিজেদের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ম্যান্ডেট পাবে। তখন তারা নতুন আরেকটি সাংবিধানিক কাঠামোর জন্ম দেবে। তারা যদি জুলাই সনদের আংশিক বাস্তবায়ন করে, তখন তাদের বাধ্য করার ক্ষমতা সংবিধানে থাকবে না; শুধুই রাজপথই হতে পারে তার সমাধান।

কিন্তু সব রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা রাজপথে হওয়া রাজনৈতিক পরিপক্বতার লক্ষণ নয়। কিছু ফয়সালা জাতীয় ঐকমত্য, কিছু নির্বাচনে আর কিছু সংসদে নেওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে রাষ্ট্রের স্থিতিশীতলতা। জুলাই সনদ প্রশ্নে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে।

মিল্লাত হোসেন আইন–আদালত, সংবিধান বিষয়ে লেখক ও গবেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এখন ১৮ কোটি মানুষের দাবি: জামায়াত
  • ‘ভোটারদের আস্থা নিশ্চিত করা বিএনপির দায়িত্ব’
  • পটুয়াখালীতে সালিস বৈঠকে অংশ নিলে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বিএনপি
  • জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে: জামায়াত নেতা রফিকুল
  • বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই: এবি পার্টি
  • রোহিঙ্গা সমস্যায় রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে
  • মাঠের জবাব মাঠে দেওয়া হবে: সালাহউদ্দিন 
  • জামায়াত কীভাবে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে: আনিসুল ইসলাম মাহমুদ
  • জুলাই সনদ নিয়ে যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে
  • ফরিদপুরে সীমানা নিয়ে ডিসির চিঠি, এলাকাবাসীর ৫ দাবি