হৃদ্‌রোগ নির্ণয়ে ইসিজি বা ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। আমাদের ধারণা, ইসিজি স্বাভাবিক মানে কোনো হৃদ্‌রোগ নেই। কিন্তু ইসিজি স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও হৃদ্‌রোগ থাকতে পারে, এমনকি হতে পারে হার্ট অ্যাটাকও।

হার্টের একটা ইলেকট্রিক সার্কিট আছে, যার মাধ্যমে হার্ট নির্দিষ্ট হারে সর্বদা স্পন্দিত হয়। একটা হৃৎস্পন্দন মানে হার্টের একবার সংকোচন ও একবার প্রসারণ। এ স্পন্দনের একটা গ্রাফিক্যাল চিত্র যখন যন্ত্রের সাহায্যে ধারণ করা হয়, সেটিই ইসিজি। ইসিজি দিয়ে হৃৎস্পন্দনের হার, ছন্দ, হার্টের চেম্বারগুলোর স্বাভাবিক আকার, ইলেকট্রিক সার্কিটে কোনো ব্লক বা বাধা আছে কি না ইত্যাদি ভালো বোঝা যায়।

হার্ট অ্যাটাক হলে হৃৎপিণ্ডের সংকোচন দুর্বল হয়ে পড়ে। ৭০ শতাংশের বেশি হার্ট অ্যাটাক ইসিজি দেখেই শনাক্ত করা যায়।

মুখ্য বিবেচ্য বিষয় উপসর্গ

হার্ট অ্যাটাকে উপসর্গ হলো মুখ্য বিবেচ্য বিষয়। এ ক্ষেত্রে বুকের মাঝখানে হঠাৎ ব্যথা, কখনো তীব্র ব্যথা, মনে হচ্ছে কেউ বুক চেপে ধরেছে, বুকের ভেতর প্রচণ্ড ভার অনুভূত হতে পারে। তবে নীরব বা সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাকও অস্বাভাবিক নয়।

বয়স্ক ব্যক্তি, দীর্ঘদিনের ও অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিক রোগী বা স্নায়ুজনিত জটিলতায় ভোগা রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যথার অনুভূতি কম হওয়ার কারণে বুকে ব্যথা ছাড়াও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। হার্ট অ্যাটাক ছাড়া অ্যানজাইনা বা করোনারি হৃদ্‌রোগে পরিশ্রম করলে বুকে ব্যথা হয় ও বিশ্রাম নিলে ব্যথা চলে যায়। এ ক্ষেত্রেও বিশ্রামরত অবস্থায় করা ইসিজি স্বাভাবিক পাওয়া যেতে পারে।

কিছু অ্যারিদমিয়া বা অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের অসুখ আছে, যা স্বল্পস্থায়ী। অ্যারিদমিয়া হলে বুক ধড়ফড় করে। এসব রোগীর উপসর্গহীন অবস্থায় ইসিজি করলে তা স্বাভাবিক পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

হার্টের ভালভের কিছু অসুখ ও জন্মগত কিছু হৃদ্‌রোগে ইসিজিতে তেমন পরিবর্তন না পাওয়া যেতে পারে। কার্ডিওমায়োপ্যাথি বা হার্টের মাংসপেশির অসুখ, যেখানে হার্ট বড় ও দুর্বল হয়, বিশেষ করে গর্ভকালীন কার্ডিওমায়োপ্যাথির মতো রোগেও ইসিজি স্বাভাবিক হতে পারে। তখন ইকো পরীক্ষার দরকার পড়ে। এসবের মানে শুধু ইসিজির ওপর নির্ভর করেই বলা যাবে না যে হৃদ্‌রোগ নেই।

করণীয়

বুকব্যথা, হয়রানি, শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড় ও অজ্ঞান হয়ে পড়া হৃদ্‌রোগের প্রধান উপসর্গ। এসব উপসর্গকে গুরুত্ব দিতে হবে, যতই ইসিজি স্বাভাবিক থাকুক।

বুকব্যথায় অনেকে ইসিজি স্বাভাবিক থাকলে বাড়ি চলে যান। পরে দেখা যায় হার্ট অ্যাটাক ছিল। তাই ইসিজি স্বাভাবিক সত্ত্বেও হার্ট অ্যাটাক সন্দেহ হলে প্রয়োজনে কয়েক ঘণ্টার পর্যবেক্ষণ ও আবার ইসিজি করে দেখার পরামর্শ অবহেলা করা যাবে না। রক্তের ট্রপোনিন পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

যেকোনো বয়সে অল্প পরিশ্রমে হয়রান হওয়া, শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড় করলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে শারীরিক পরীক্ষা ও পরামর্শের জন্য যাওয়া উচিত।

ইসিজি স্বাভাবিক হলেও চিকিৎসক ইটিটি, হল্টার বা ইকো পরীক্ষার প্রয়োজন মনে করতে পারেন।

ডা.

শরদিন্দু শেখর রায়, সহকারী অধ্যাপক, হৃদ্‌রোগ বিভাগ, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: উপসর গ পর ক ষ

এছাড়াও পড়ুন:

গবাদিপশু থেকে মানুষের শরীরে ‘তড়কা’ রোগ, প্রতিরোধে যা করবেন

অ্যানথ্রাক্স রোগটি‘তড়কা’ নামেই বহুল পরিচিত। গ্রীক শব্দ ‘অ্যানথ্রাকিস’ বা কয়লা থেকে উদ্ভূত এই নামটি হয়তো অনেকেই জানেন না। তবে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ ঠিকই অবগত।

অ্যানথ্রাক্স নামের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগটি শুধু বন্য বা গৃহপালিত পশুকে নয়, বরং মানুষের জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে বারবার।

আরো পড়ুন:

১৬ দিন ধরে অচলাবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ বাকৃবি ছাত্রশিবিরের

দ্রুত অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালুর দাবি বাকৃবি শিক্ষার্থীদের

সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, দেশের অ্যানথ্রাক্স পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক। সাধারণত গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়াকে আক্রান্ত করে এই ব্যাকটেরিয়া। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই রোগে মারা গেছে অন্তত ১ হাজার গবাদিপশু। আর আক্রান্ত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।

সম্প্রতি রংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্তের রিপোর্ট করেছেন অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ। এরইমধ্যে এ রোগের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন দুইজন, যা নিশ্চিত করেছেন রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।

গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০টিরও বেশি মানব অ্যানথ্রাক্স কেস রেকর্ড করা হয়েছে, যার সবগুলোই ছিল ত্বকের অ্যানথ্রাক্স। তবে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৬ হাজার ৩৫৪টি পশুর অ্যানথ্রাক্স কেস রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯৯৮টি পশুর মৃত্যু হয়েছে। সে হিসাবে মোট মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ১৫.৭ শতাংশে।

গবেষণার তথ্য মতে, বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ১৯৮০ সালে। এরপর থেকে এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বারবার ফিরে এসেছে। বিশেষ করে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও মেহেরপুর জেলাকে ‘অ্যানথ্রাক্স বেল্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে এ রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।

বিশেষজ্ঞরা ময়মনসিংহ, পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলাকে যথাক্রমে উচ্চ, মাঝারি ও নিম্ন-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে, বিশেষত এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।

অ্যানথ্রাক্সের মূল কারণ হলো- ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামের একটি ব্যাকটেরিয়া, যা সাধারণত মৃত পশুর দেহে পাওয়া যায়। এটি এতই শক্তিশালী যে, জৈবিক অস্ত্র হিসেবেও এর ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে। এই ব্যাকটেরিয়া বাতাসে উড়ন্ত স্পোর তৈরি করতে পারে, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। 

অ্যানথ্রাক্স নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের স্নাতক রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট অর্ণব সাহা। 

তিনি বলেন, “মানুষ তিনভাবে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে— ত্বকের মাধ্যমে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এবং খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে। এর মধ্যে ত্বকের অ্যানথ্রাক্স সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এবং এর সুপ্তিকাল সাধারণত দুই থেকে ছয়দিন।”

অন্যদিকে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংক্রমিত অ্যানথ্রাক্সের সুপ্তিকাল গড়ে চারদিন, যা ১০-১১ দিন পর্যন্তও হতে পারে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোট আক্রান্তের ৯১.৩ শতাংশ মানুষই ত্বকের অ্যানথ্রাক্সে ভুগেছে, যেখানে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল এবং উভয় ধরনের সংক্রমণ ছিল যথাক্রমে ৬.৫২ শতাংশ ও ২.৬৬ শতাংশ।

ত্বকীয় অ্যানথ্রাক্সের ক্ষেত্রে চামড়ায় প্রথমে একটি চুলকানিযুক্ত লাল ফোঁড়া দেখা যায়, যা পরবর্তীতে কালো কেন্দ্রযুক্ত ব্যথাহীন ঘা হিসেবে প্রকাশ পায়। উলের কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যাওয়ায় এটি ‘উল-সর্টার্স ডিজিজ’ নামেও পরিচিত।

সবচেয়ে মারাত্মক ধরণ হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের অ্যানথ্রাক্স। ব্যাকটেরিয়ার স্পোর শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে ঠান্ডা, জ্বর ও কাশির মতো উপসর্গ দেখা যায়, যা দ্রুত শ্বাসকষ্ট, শক এবং উচ্চ মৃত্যুহারের দিকে নিয়ে যায়।

অর্ণব বলেন, “প্রাণীদের মধ্যে অ্যানথ্রাক্স হলে হঠাৎ মৃত্যু সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গ। মৃত পশুর নাক, মুখ ও মলদ্বার থেকে কালচে, জমাট না বাঁধা রক্ত বের হয় এবং পেট ফুলে যায়।”

রোগটির প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিষয়ে বাকৃবি মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলজার হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম কারণ হলো জনসচেতনতার অভাব। অসুস্থ পশু জবাই করে তার মাংস কম দামে বিক্রি করার একটি প্রবণতা আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান। অনেক বিক্রেতা ও সাধারণ মানুষ জানেনই না যে, এই মাংস থেকে মানুষের শরীরেও রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।”

“পাশাপাশি, মৃত পশুর দেহ সঠিক উপায়ে অপসারণ না করে খোলা মাঠে, নদী, খাল বা বন্যার পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। এর ফলে এই জীবাণু পরিবেশ ও পশুপালনের জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, যা নতুন করে সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করে,” যুক্ত করেন ড. গোলজার।

তিনি বলেন, “অ্যানথ্রাক্সের বিস্তার রোধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ এই রোগের বিস্তার রোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম- জনসচেতনতা বৃদ্ধি। পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধে জনশিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়াতে হবে।”

তিনি আরো বলেন, “অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো গবাদি পশুর মধ্যে নিয়মিত এবং ব্যাপক হারে টিকাদান নিশ্চিত করা। সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত টিকাদান কর্মসূচিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে। আমদানি করা ও জবাই করা পশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টাইন করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।”

ড. গোলজার বলেন, “এছাড়া মৃত পশুর দেহ ও দূষিত পদার্থ সঠিকভাবে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে এবং অনুমোদিত মাংস বিক্রেতাদের মাধ্যমে এবং পশু চিকিৎসকের পরীক্ষা করা মাংস বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।”

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পিসিওএস এখন জনস্বাস্থ্য সমস্যা
  • গবাদিপশু থেকে মানুষের শরীরে ‘তড়কা’ রোগ, প্রতিরোধে যা করবেন
  • প্রোস্টেট ক্যানসারের উপসর্গগুলো আপনার জানা আছে কি