আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি লাগামছাড়া। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি আরও অসহনীয়। চালের ভরা মৌসুম ও শীতের সবজির ভালো সরবরাহ থাকলেও খাদ্যেপণ্যের মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের নিচে নামেনি। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি টানা তিন মাস সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি কমে আসার মধ্যেও খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। অবশেষে ফেব্রুয়ারি মাসে এসে এ হার এক অঙ্কে নেমে এলো। মাসটিতে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। ১১ মাস পর এ হার এখন দুই অঙ্কের নিচে। সর্বশেষ গত বছরের মার্চে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এপ্রিলে তা বেড়ে হয় ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সে ধারা অব্যাহত ছিল। 

সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ, যা গত ২৩ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মূলস্ফীতি এর চেয়ে কম ছিল। ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ ছিল ওই মাসের মূল্যস্ফীতি। ফেব্রুয়ারি নিয়ে টানা তিন মাস মূল্যস্ফীতি কমছে। 
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রাম-শহর সব জায়গায় খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমেছে। মাসটিতে গ্রাম এলাকার মূল্যস্ফীতি আগের মাসের ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ। শহরাঞ্চলে যা ১০ দশমিক ৯৫ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে। 
বিবিএসের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, সার্বিক এবং খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমলেও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে। মাসটিতে এ খাতের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা আগের মাস জানুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। 

খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে কিছুটা সন্দেহের অবকাশ রয়েছে বলে মনে করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। গতকাল সমকালকে তিনি বলেন, সব আমলেই সরকারকে খুশি রাখাই যেন আমলাদের কাজ। বিবিএসের প্রতিবেদনে এমন উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। বাজার এখন স্থিতিশীল। বেশির ভাগ পণ্যের দাম আর বাড়েনি। আবার সবজি ছাড়া অন্যান্য পণ্যের দাম কমেনি। তাহলে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমলো কীভাবে? উপরন্তু চাল, তেলের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। ক্যাবের পক্ষ থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখা হবে বলে জানান তিনি। 
আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি জাতীয় অর্থনীতিতে মাথা ব্যথার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত সরকারের সময়ে এ পরিস্থিতি শুরু হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও (এনবিআর) পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনতে বেশ কিছু নিত্যপণ্যের শুল্ক-কর কমিয়েছে। বাজারে নিত্যপণ্যের আমদানি প্রবাহ ঠিক রাখতে আরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকার আশা করছে, আগামী জুন নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ঘরে নেমে আসবে। 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে গত বছর থেকে মূল্যস্ফীতি হিসাব পদ্ধতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। এখন ২০২১-২২ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হচ্ছে। পণ্য ও সেবার সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। ভোক্তা মূল্যসূচকে ৭৪৯ ধরনের ৩৮৩ আইটেমের পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে ৪২২টি পণ্যের বাজারদর হিসাব করা হতো। নতুন হিসাবের আওতায় এসেছে সন্তানের শিক্ষার খরচ, পরিবারের ইন্টারনেটের খরচ, রেস্টুরেন্ট ও হোটেলে খাবারের খরচসহ বেশ কয়েকটি খাত। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ৯ দশম ক সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি

নিয়োগপত্র নেই। এ কারণে চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। দেওয়া হয় না পরিচয়পত্র। নেই কর্ম ঘণ্টার হিসাব। তবে রয়েছে মজুরিবৈষম্য ও জীবনের ঝুঁকি। এ চিত্র খুলনার বরফকলে কর্মরত বরফ শ্রমিকদের।

অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত বরফকলের শ্রমিকেরা জানেন না মে দিবসের অর্থ। তারা শুধু এটুকু জানেন, কাজ থাকলে মজুরি পাবেন, অন্যথায় জুটবে না কিছু। খুলনার নতুন বাজার, রূপসা, শিপইয়ার্ড ও নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বরফ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে ঝুঁকি ও বৈষম্যের এই চিত্র।

সরেজমিনে জানা গেছে, লবণ পানি এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের সংমিশ্রণে বরফের প্রতিটি ক্যান তৈরি হয়। এ কাজে প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যুসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এছাড়াও অধিকাংশ সময় হাত-পা ভিজে ঠান্ডা থাকায় ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়। এর বাইরে বুকে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় ভোগেন এখানকার শ্রমিকেরা। পাতলা বরফে অনেক সময় হাত-পা কেটে যায়। কিন্তু মালিক বা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্য কোন ধরনের অ্যাপ্রোন বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন না। তবে দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

আরো পড়ুন:

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

মহান মে দিবস: শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সংস্কারে জোর সরকারের

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর নতুন বাজার, নিউমার্কেট, শিপইয়ার্ড, রায়েরমহল এবং রূপসা উপজেলার পূর্ব রূপসা এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি বরফকল রয়েছে। এর মধ্যে নতুন বাজার ও পূর্ব রূপসায় সর্বাধিক বরফকল রয়েছে। এসব কলে গড়ে দশ জন হিসেবে দেড় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।

রূপসার নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত ‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করেন মোহাম্মদ রাসেল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি হলেও পরিবার নিয়ে রূপসার জাবুসা এলাকায় বসবাস করেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই বরফকলে কাজ করছেন তিনি। রাসেল জানান, তাদের মাসিক বেতন নেই। নেই নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র। মূলত উৎপাদনের উপর প্রতি পিস বরফের ক্যান অনুযায়ী ১২ টাকা হারে মজুরি পান। নামমাত্র এ মজুরিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে সংসার ঠিকমতো চলে না।

‘‘তিন বছর আগে নির্ধারণ করা মজুরি এখনো চলছে। লোকসানের অজুহাতে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে চান না। তাদের মতো শ্রমিকদের কোন বেতন-বোনাস নেই। নো ওয়ার্ক, নো পে অর্থাৎ কাজ থাকলে মজুরি আছে কাজ না থাকলে নেই। মালিকদের এ সিদ্ধান্ত না মানলে চাকরিও থাকে না।’’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন রাসেল হোসেন।

একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মোঃ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘গড়ে প্রতিমাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা মজুরি পাই। কিন্তু মাসিক খাবার খরচ প্রায় ৩ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া বাবদ ৩ হাজার টাকা চলে যায়।’’

তবে জাকির হোসেন ব্যাচেলর হওয়ায় কারখানার মধ্যেই থাকেন। বিয়ের পর এ কাজ করার ইচ্ছা নেই বলে জানান তিনি।

বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১-এ অপারেটর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মোঃ সেলিম শেখ। তার জন্ম নড়াইলের লক্ষ্মীপাশা হলেও কর্মসংস্থানের কারণে রুপসার বাগমারা গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি জানান, বর্তমান বয়স ৮৪। ২০ বছর বয়স থেকেই বরফ কারখানার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে হেলপার হিসেবে ২৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে অপারেটর হিসেবে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পান। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়। তবে সবসময় উৎপাদন না থাকলেও ২৪ ঘণ্টা কারখানায় থাকতে হয়। ছুটি পান না।

‘অ্যামোনিয়া গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। তবে তিনি কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি বলে জানান তিনি।

‘মায়ের দোয়া আইস এন্ড কোল্ড স্টোরেজে’র শ্রমিক জাকারিয়া হাওলাদার বলেন, ‘‘চার বছর বরফকলে কাজ করছি। চাকরির ভবিষ্যৎ নেই। শ্রম দিতে পারলে মজুরি হয়, না হলে হয় না। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেন না মালিকপক্ষ। বেতন বাড়ানোর কথা বললে তারা আমলে নেন না।’’

একই এলাকার ‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করছেন মোঃ মুন্না গাজী ও মোঃ হাসান শেখ। তারা নগরীর জিন্নাপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। তারা দুজনেই মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই।

‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’র ম্যানেজার আশিকুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদাসীন। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার মাঝেমধ্যেই লিক হয়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৩২টি আইস উৎপাদনের ক্যানের প্লান্ট রয়েছে। তবে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ ক্যান বরফ উৎপাদন হয়। ছয়জন শ্রমিক কাজ করে বলে জানান তিনি।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ- ২'র ম্যানেজার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘‘বরফের মূল ক্রেতা চিংড়ি ও সাদা মাছের ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে গ্রীষ্ম মৌসুমে ভ্রাম্যমাণ ও দোকানে শরবত বিক্রেতারাও কারখানা থেকে বরফ কিনে নেন। গ্রীষ্ম মৌসুমের ৬ মাস চাহিদা থাকে এবং কিছুটা লাভের মুখ দেখা যায়। তবে শীত মৌসুমের ছয় মাস বরফের চাহিদা কম থাকে। তখন কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি দিয়ে লোকসান গুণতে হয়।’’

জামাল উদ্দিন স্বীকার করেন কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও তা এড়াতে কোন সরঞ্জাম নেই। তবে অপারেটরদের অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঝুঁকি প্রতিরোধে মাক্স সরবরাহ করা হয়।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১'র মালিকপক্ষের প্রতিনিধি রিয়াদ-উল-জান্নাত সৈকত বলেন, ‘‘ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে না। কখনো লাভ, কখনো লোকসান এভাবেই চলছে। গত বছর কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’’

তবে লাভ হলে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এ বিষয়ে শ্রমিকদের সংগঠন রূপসা বেড়িবাঁধ হ্যান্ডলিং শ্রমজীবী ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রিপন শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি বরফকলের ৪০ জন শ্রমিক তাদের ইউনিয়নের সদস্য। বিগত দেড় বছর আগে মজুরির সমস্যা নিয়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দুই একজন শ্রমিক অভিযোগ করলে ইউনিয়নের মাধ্যমে সেটির সমাধান করে দেন তারা। কিন্তু বর্তমানে অভিযোগ নিয়ে কেউ আসে না।’’

বরফকলের শ্রমিকদের নিয়ে তারা মে দিবসের কর্মসূচি পালন করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ