উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ওয়াল্ট রোস্টো তাঁর স্টেজেস অব ইকোনমিক গ্রোথ তত্ত্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাঁচটি ধাপ রয়েছে বলে মনে করেন। পাঁচটি ধাপে সমাজ ও দেশ পৌঁছাতে পারলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে।

প্রথাগত সমাজব্যবস্থা এই ধাপের প্রথম স্তর, এরপর রয়েছে প্রস্তুতিমূলক পর্যায়, তারপরে উন্নয়নের জন্য উড্ডয়ন বা টেক-অফ পর্ব, এরপরের দুই ধাপ পরিপক্বতা ও ম্যাস কনজামশন বা ভোগের মেয়াদকাল।

বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থা এই মডেল অনুসারে উড্ডয়ন বা টেক-অফের পথে রয়েছে বলে মনে করা যায়। নানাভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা এখনো অর্জিত হয়নি। রোস্টোর তত্ত্ব অনুসারে, এই পর্যায়ে দেশের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ।

এ বছরের ২৬ জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি তাদের কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী সব অংশীজনকে তাদের অধীন চলমান সব প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ অথবা স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছে। ইউএসএআইডির তহবিল বন্ধ বা স্থগিতের ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

বিশেষত টেকসই উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন, যা শুধু অভ্যন্তরীণ রাজস্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করা কঠিন। বাংলাদেশের জন্য এই তহবিল হ্রাস নারীশিক্ষা, মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুপুষ্টি ও গণতন্ত্রের বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হতে পারে।

তহবিলের পরিধি কেমন ছিল

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএআইডির তহবিল বরাদ্দের প্রবণতা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। ২০২৫ সালের হিসাবে বাংলাদেশ দক্ষিণ ও সেন্ট্রাল এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ৭১ মিলিয়ন ডলার তহবিল নিয়ে শীর্ষস্থানে ছিল বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে এই বরাদ্দ ছিল ৫০০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২০ সালে ছিল ৫৭০ মিলিয়ন ডলার। ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স ডট গভ সাইটে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে সামগ্রিক সংকটের আর্থিক অবস্থা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

দুই দশকের তুলনামূলক চিত্র

২০২৫ সালের ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স ওয়েবসাইটের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের দাতাদের মধ্যে জাপান (২.

২৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ (১.১২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), যুক্তরাষ্ট্র (৩৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার), ফ্রান্স (২১৪.৫ মিলিয়ন) ও জার্মানি (১৯২.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।

২০০১ সালে ইউএসএআইডি বাংলাদেশকে ১২০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা করেছিল, যা তখনকার সময়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ২০১৫ সালে তহবিলের আকার ছিল ২১০ মিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে বরাদ্দ ৩২০ মিলিয়ন ডলারে নামলেও ২০২৪ সালে তা বেড়ে ৪৫০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক তহবিলের আকার কমার আশঙ্কা করেন অর্থনীতিবিদেরা। ২০২৫ সালে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল ৭১ মিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছিল বলে দেখা যায়।

খাতভিত্তিক বরাদ্দের পরিবর্তন

২০০১ সালে ইউএসএআইডির সহায়তার মূল লক্ষ্য ছিল খাদ্যনিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য খাত। ২০২৪ সালের বরাদ্দের ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বাস্থ্য খাতে ৫৯ মিলিয়ন, কৃষিতে ৪১ মিলিয়ন, গভর্ন্যান্সে ২৯ মিলিয়ন, শিক্ষায় ৩৩ মিলিয়ন এবং মানবিক সহায়তায় ২৩০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। বন্ধ হওয়ার আগে ২০২৫ সালে এই খাতে বরাদ্দের পরিমাণ আরও কম দেখা যায়।

*[এখানে একটি গ্রাফ বসবে]

২০২৪ ও ২০২৫ সালের চিত্র

ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স ডট গভ সাইটে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ২০২৫ সালের জন্য ৮.১৯৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ ছিল দ্য ফিড দ্য ফিউচার বাংলাদেশ নিউট্রিশন কর্মসূচিতে, ৭.১৮ মিলিয়ন বরাদ্দ ছিল আরবান হেলথ কর্মসূচিতে, ৬.০৪৪ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ ছিল আমার ভোট আমার কর্মসূচিতে, ৪.৫ মিলিয়ন ডলার ছিল ইউএসএআইডি ইকোসিস্টেম প্রতিবেশ কর্মসূচিতে, ৩.৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল আইন সহায়তা কর্মসূচিতে, ৩.২৩ মিলিয়ন ডলার ছিল বাংলাদেশ অ্যাডভান্সিং ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড গ্রোথ থ্রো এনার্জি (ব্যাজ) কর্মসূচিতে, ৩ মিলিয়ন ছিল পশুসম্পদ ও পুষ্টি কর্মসূচিতে, ২.৮৩৪ মিলিয়ন ডলার ছিল সিভিল সোসাইটির সাংগঠনিক ক্ষমতা উন্নয়ন কর্মসূচিতে, ২.৮ মিলিয়ন ডলার ছিল ডেমোক্রেটিক লেবার অ্যান্ড ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমে।

২০২৪ সালে যেসব কার্যক্রমে ফান্ডিং করা হয়, তার মধ্যে দেখা যায় মানবিক সহায়তার জন্য ছিল ৮৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ৭৮.০১ মিলিয়ন ডলার ছিল দ্বিতীয় ইমার্জেন্সি কমোডিটি ক্রেডিট করপোরেশন ফান্ডে, ৪৩ মিলিয়ন ডলার ছিল সুরক্ষা, সহায়তা ও সমাধান কার্যক্রমে, ১৯.৭৪ মিলিয়ন ডলার ছিল বাংলাদেশ টিবি হেলথ প্রকল্পে, ১৪.৬৭ মিলিয়ন ডলার ছিল বাংলাদেশ-আমেরিকা মৈত্রী কর্মসূচিতে, ১৩.২ মিলিয়ন ডলার ছিল ইউএসএআইডি হোস্ট ও প্রভাবিত কমিউনিটি রেজিলিয়েন্স অ্যাকটিভিটি ডেভেলপমেন্ট ইনোভেশন ভেঞ্চার (ডিআইভি) কার্যক্রমে, ১৩.১৭ মিলিয়ন ডলার ছিল এসো শিখি কর্মসূচিতে, ৯.৪৯২ ছিল ভিত্তি কর্মসূচিতে, ৮.৩৮ মিলিয়ন ছিল কনসালটেটিভ গ্রুপ অন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ (সিজিআইএআর) ফান্ডের দ্বিতীয় ফলোঅন গ্র্যান্ট টু ওয়ার্ল্ড ব্যাংক কার্যক্রমে।

২০২০ সালে যেসব কার্যক্রমে ফান্ডিং করা হয়, তার মধ্যে দেখা যায় বাংলাদেশ ইমার্জেন্সি প্রোগ্রামে ১২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, অ্যাডভান্সিং হেলথ কাভারেজে ২০.৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, স্ট্রেনদেনিং পাবলিক সেক্টর সিস্টেমস ফর ম্যাটারনাল অ্যান্ড নিউবর্ন হেলথ কর্মসূচি (এসপিএসসিএমএনএইচপি), ইন্টারন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ (সিজিআইএআর) কার্যক্রমে ১০.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, বাংলাদেশ কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্সে ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, বাংলাদেশ টিবি হেলথ প্রজেক্টে ৫.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, রাইস অ্যান্ড ডাইভার্সিফাইড ক্রপসে ৫.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, পাবলিক ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

সংকটের বহুমাত্রিকতা

আমরা দেখছি ইউএসএআইডির সামগ্রিক কার্যক্রম বন্ধ করে ফেলার কারণে দেশের উন্নয়ন খাতসংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থানের ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। একদিকে বাংলাদেশে কমোডিটি অ্যাসিস্ট্যান্স, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা, কৃষি, গভর্ন্যান্স, শিক্ষা, মানবিক খাতে বিশাল বরাদ্দ বন্ধের কারণে সরাসরি সুবিধা পাওয়া জনগোষ্ঠীর ওপরে চাপ তৈরি হবে। ২০২৪ সালের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ইমপ্লিমেন্টিং পার্টনার হিসেবে বিভিন্ন কর্মসূচিতে ইউএসএআইডির কাছ থেকে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ১৬৫ মিলিয়ন ডলার, জাতিসংঘের কাজে ৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, আইসিডিডিআরবি ১৯.৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, চেমোনিক্স ইন্টারন্যাশনাল ইঙ্ক ১২.৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, উইনরক ইন্টারন্যাশনাল ১৯.৩৩ মিলিয়ন, ব্র্যাক ১৮.০৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, আরটিআই ইন্টারন্যাশনাল ১৬.৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ফান্ড গ্রহণ করে। ২০২৪ সালে নেওয়া এসো শিখি কর্মসূচির ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৮ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এই কর্মসূচির ইমপ্লিমেন্টিং পার্টনার উইনরক ইন্টারন্যাশনাল। এই কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল সাক্ষরতা উন্নয়ন ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়া।

স্থানীয় সম্প্রদায়কে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করার পাশাপাশি মানসম্পন্ন শিক্ষার আওতা বাড়ানোর জন্য সরকারি সক্ষমতা বিকাশ ছিল লক্ষ্য। একই সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য বিভিন্ন স্কুলকে প্রস্তুত করতে সহায়তা করার কার্যক্রম যুক্ত ছিল এই কর্মসূচিতে। ২০২৪ সালের আরেকটি বড় কর্মসূচি ছিল বাংলাদেশ টিবি হেলথ প্রজেক্ট। ইমপ্লিমেন্টিং পার্টনার ছিল আইসিডিডিআরবি। এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৭ সালের ৪ মার্চ।

এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের যক্ষ্মারোগের চিকিৎসা উন্নতি করা। যক্ষ্মা প্রতিরোধ, কেস শনাক্তকরণ, রোগনির্ণয়, দ্রুত চিকিৎসা, উন্নত চিকিৎসার জন্য ফলাফল, শক্তিশালী রেফারেল সিস্টেম উন্নত করা। প্রাইভেট সেক্টরকে যক্ষ্মা চিকিৎসায় সম্পৃক্ত করতে কাজ করছি এই কর্মসূচি।

২০২৪ অর্থবছরে নেওয়া আরেকটি কর্মসূচি সবাই মিলে শিখি, যার ইমপ্লিমেন্টিং পার্টনার ছিল আরটিআই ইন্টারন্যাশনাল। এ কর্মসূচিতে স্বল্পসংখ্যক বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান উন্নত করার জন্য অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী শিশুদের জীবন দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করার পরিকল্পনা ছিল।

সামগ্রিকভাবে ২০২৫ সালে ইউএসএআইডির তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়া বেশ উদ্বেগজনক, বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও মানবিক সহায়তা খাতে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ফলে এই তহবিল বন্ধের চাপ নিতে সংকটে পড়বে। সাধারণভাবে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব অপরিসীম। সেখানে এমন চাপ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য নতুন সংকট হতে পারে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

আসন্ন সংকটকে মেনে নিতে হবে

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি দীর্ঘদিন ধরেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও মানবিক সহায়তা খাতের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে সারা দেশে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান সংকটে পড়েছে।

প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে অনেক। কর্মসংস্থানের সংকট সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে ইউএসএআইডির সহযোগিতায় পরিচালিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, দারিদ্র্য বিমোচন এবং নারীর ক্ষমতায়ন অন্যতম। এই প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন কমে যাওয়ার ফলে অনেক কর্মচারী চাকরি হারিয়েছেন, যার সংখ্যা লাখের কাছাকাছি বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে, স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষাকর্মী, সমাজকর্মী এবং স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তারা এই সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন। আন্তর্জাতিক অনুদানের ওপর নির্ভরশীল কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনই পরিকল্পনা করা জরুরি।

সরকারের পরিকল্পনার অভাব দেখা যাচ্ছে। ইউএসএআইডির সহায়তা কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা এখনো প্রকাশ করা হয়নি। বিশেষত, যেসব অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো ইউএসএআইডির সহায়তায় গড়ে উঠেছে, সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে, তা অনিশ্চিত। অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল এবং মানবিক সহায়তা প্রকল্পগুলো পরিচালনার জন্য বিকল্প অর্থায়নের কোনো ঘোষণা আসেনি।

বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণে দেরি হলে সমস্যা হতে পারে। স্বাস্থ্য খাতের সংকটের জন্য যক্ষ্মা, পুষ্টিহীনতা, মাতৃস্বাস্থ্য এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হলে স্বাস্থ্যসেবার অবনতি ঘটবে। শিক্ষা খাতে ধাক্কা লাগবে। ‘এসো শিখি’ কর্মসূচি ও অন্যান্য শিক্ষাসহায়তা কার্যক্রমে অর্থায়ন কমে যাওয়ায় দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হবে। নারীর ক্ষমতায়ন কর্মসূচিতে বিঘ্ন ঘটবে। বিভিন্ন নারীকেন্দ্রিক উদ্যোগ যেমন দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সহায়তা প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে নারীদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমে যাবে। কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি দেখা যাবে। কৃষি খাতে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য ইউএসএআইডি গুরুত্বপূর্ণ অনুদান দিত। এর সংকোচন হলে কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া আমরা এনজিও খাতের বড় একটা সংকট দেখব। অনেক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ইউএসএআইডির অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল। ফলে তারা এখন বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে পারে, যা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ইউএসআইডির উপস্থিতি ছিল, যা এখন বন্ধ।

সম্ভাব্য সমাধান ও সুপারিশ

মার্কিন অর্থনীতিবিদ ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফ্রে স্যাকস মনে করেন, যেকোনো দেশকে অর্থনৈতিক স্বনির্ভর হতে হলে তাকে বিনিয়োগ ও উৎপাদনদক্ষতা বাড়াতে হবে। বর্তমান এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকার, এনজিও ও বেসরকারি খাতকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। জাতীয় বাজেটে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। ইউএসএআইডির অর্থায়ন সংকুচিত হওয়ায় সরকারকে বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি খাতে বাড়তি বরাদ্দ দিতে হবে। এতে স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর স্থায়িত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে।

বিকল্প উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সন্ধান করতে হবে দ্রুত। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি অন্যান্য আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে তহবিল সংগ্রহের কৌশল নিতে হবে। স্থানীয় এনজিও ও করপোরেট সংস্থার সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এনজিও ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) অর্থায়ন ব্যবহার করে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো চালু রাখা যেতে পারে।

স্বল্পমেয়াদি প্রকল্পগুলোর ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দিকে যেতে হবে। ভারত, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো আন্তর্জাতিক অনুদান থেকে নিজেদের উৎপাদনমুখী বিনিয়োগে স্থানান্তর করেছে, বাংলাদেশকেও এই মডেলে যেতে হবে। বাংলাদেশকে এখন উন্নয়নশীল থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে এগোতে হচ্ছে। ফলে অনুদানের পরিবর্তে স্বল্প সুদে ঋণভিত্তিক উন্নয়ন সহযোগিতার দিকে যেতে হতে পারে। ইউএসএআইডির স্লোগান যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের পক্ষ থেকে লেখা আবারও হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ভবিষ্যতে অন্যভাবে দেখা যাবে। সেই পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারকে নিজের পরিকল্পনা অনুসারে এগোতে হবে।

জাহিদ হোসাইন খান গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সাবেক কর্মী; ই-মেইল: [email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউএসএআইড র তহব ল ইউএসএআইড র স ইমপ ল ম ন ট ২০২৫ স ল র ২০২৪ স ল র বর দ দ ছ ল ন র জন য প র টন র বর দ দ র ব শ ষ কর সহয গ ত ব সরক র প রকল প র র জন অন দ ন এনজ ও হওয় র র ওপর ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

ভারতের ৬ প্রতিষ্ঠানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা

ইরানের পেট্রোলিয়াম ও পেট্রোকেমিক্যাল পণ্যের বাণিজ্যে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে অন্তত ছয়টি ভারতীয় কোম্পানির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। একই পদক্ষেপের আওতায় বিশ্বজুড়ে মোট ২০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

গতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ইরানের পেট্রোলিয়াম পণ্য কেনাবেচা ও বিপণনের জন্য ‘গুরুত্বপূর্ণ লেনদেনে’ ইচ্ছাকৃতভাবে অংশ নিয়েছে। ফলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ইরানবিষয়ক নিষেধাজ্ঞা ভেঙেছে।

নিষেধাজ্ঞার শিকার কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারতের কিছু বড় পেট্রোকেমিক্যাল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো অ্যালকেমিক্যাল সলিউশনস, গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যালস, জুপিটার ডাই কেম, রমনিকলাল এস গোসালিয়া অ্যান্ড কোম্পানি, পার্সিসটেন্ট পেট্রোকেম ও কাঞ্চন পলিমার্স।

নিষিদ্ধ কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারতের কিছু বড় পেট্রোকেমিক্যাল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযোগ উঠেছে অ্যালকেমিক্যাল সলিউশনস প্রাইভেট লিমিটেডের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৮ কোটি ৪০ লাখ ডলারেরও বেশি মূল্যের ইরানি পেট্রোকেমিক্যাল পণ্য আমদানির সঙ্গে জড়িত ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযোগ উঠেছে অ্যালকেমিক্যাল সলিউশনস প্রাইভেট লিমিটেডের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৮ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের ইরানি পেট্রোকেমিক্যাল পণ্য আমদানির সঙ্গে জড়িত ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যালস লিমিটেডের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে ৫ কোটি ১০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের ইরানি পেট্রোকেমিক্যাল, বিশেষ করে মিথানল কিনেছে।

জুপিটার ডাই কেম প্রাইভেট লিমিটেডের বিরুদ্ধেও এ সময়ে টলুইনসহ ৪ কোটি ৯০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের ইরানি পণ্য আমদানির অভিযোগ রয়েছে।

রমনিকলাল এস গোসালিয়া অ্যান্ড কোম্পানি মিথানল ও টলুইনসহ ২ কোটি ২০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের ইরানি পেট্রোকেমিক্যাল পণ্য কেনার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে।

এসব প্রতিষ্ঠানের যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সম্পদ কিংবা যেসব সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে আছে, তা জব্দ করা হবে। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া নিষিদ্ধ হবে। নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর যেকোনো সহযোগী প্রতিষ্ঠান—যেগুলোর অন্তত ৫০ শতাংশ মালিকানা তাদের হাতে, তা–ও একইভাবে নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হবে।

পার্সিসটেন্ট পেট্রোকেম প্রাইভেট লিমিটেড ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ইরানি পেট্রোকেমিক্যাল পণ্য, বিশেষ করে মিথানল আমদানি করেছে বলে জানানো হয়েছে।

এ ছাড়া কাঞ্চন পলিমার্স নামে একটি কোম্পানি ১৩ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের ইরানি পলিথিন পণ্য কিনেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

নিষেধাজ্ঞার ফলে এখন এসব প্রতিষ্ঠানের যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সম্পদ কিংবা যেসব সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে আছে, তা জব্দ করা হবে। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া নিষিদ্ধ হবে। নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর যেকোনো সহযোগী প্রতিষ্ঠান, যেগুলোর অন্তত ৫০ শতাংশ মালিকানা তাদের হাতে, তা–ও একইভাবে নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হবে।

এ পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের ‘সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ’ নীতির অংশ। এর মাধ্যমে ইরানের কথিত ‘ছায়া নৌবহর’ ও মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, যারা বিশ্বব্যাপী ইরানি তেল ও পেট্রোকেমিক্যাল পণ্য পরিবহনে সহায়তা করে।

আরও পড়ুনভারতের পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা ট্রাম্পের, রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য আলাদা ‘দণ্ড’১৫ ঘণ্টা আগে

মার্কিন কর্মকর্তাদের দাবি, এসব পণ্য রপ্তানি থেকে ইরান যে রাজস্ব পায়, তা মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা ছড়ানো ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সহায়তায় ব্যয় করা হয়।

ইরানের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকলেও ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আগের নিষেধাজ্ঞা চালু হওয়ার পর ভারত ইরানি তেল আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়।

নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্পেশালি ডেজিগনেটেড ন্যাশনালস (এসডিএন) তালিকা থেকে নিজেদের নাম বাদ দেওয়ার জন্য আবেদন করতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন বলেছে, এ নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য শাস্তি দেওয়া নয়; বরং আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা।

ভারতের পাশাপাশি তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন ও ইন্দোনেশিয়ার কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, এ বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ইরানের তেল ও পেট্রোকেমিক্যাল–বাণিজ্যে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

উল্লেখ্য, ভারতের কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বাইরেও দেশটি থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। গতকাল তিনি এ ঘোষণা দেন।

আরও পড়ুনভারতের পণ্যে এবার ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিলেন ট্রাম্প২২ ঘণ্টা আগে

আগামীকাল ১ আগস্ট থেকে ভারতের পণ্যে নতুন এ পাল্টা শুল্কনীতি কার্যকর হবে। পাশাপাশি রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র ও জ্বালানি কেনার জন্য ভারতকে ‘দণ্ড’ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প। তবে কী ধরনের দণ্ড দেওয়া হবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলেননি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পিডিবির ভুলে ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হলো বাংলাদেশকে
  • জুলাইয়ের ৩০ দিনে রেমিট্যান্স ২৩৬ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে
  • নির্বাচনের রোডম্যাপে কবে যাত্রা শুরু করবে বাংলাদেশ
  • ভারতের ৬ প্রতিষ্ঠানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা
  • সবজির দামে স্বস্তি, মজুরি বৃদ্ধির হার এখনো কম
  • জন্মহার বাড়াতে চীনের নতুন উদ্যোগ, শিশুদের জন্য মা-বাবা পাবেন ভাতা
  • সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ১২ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা
  • ‘রাষ্ট্রীয় শোক’ প্রত্যাখ্যান
  • পুঁজিবাজারে বড়-মাঝারি বিনিয়োগকারী বেড়েছে : বিএসইসি
  • সরকারি পলিটেকনিকে ভর্তি: ২০২৩, ২০২৪ ও ২০২৫ সালে এসএসসি উত্তীর্ণদের সুযোগ