মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত জানুয়ারিতে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর আগের প্রশাসন, অর্থাৎ বাইডেন সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ঘায়েল করতে আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করেছে। তাই তিনি (ট্রাম্প) এই ‘অস্ত্রায়ণ’ বন্ধ করার ঘোষণা দেন। সমালোচকেরা এটিকে ট্রাম্পের নিছক একটি চটকদার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখলেও তাঁর সমর্থকেরা মনে করেন, রাজনৈতিক পক্ষপাতের বিরুদ্ধে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। 

তবে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের আড়ালে আরও গভীর একটি বাস্তবতা রয়েছে। সেটি হলো বিশ্বরাজনীতিতে অর্থনীতি, জ্বালানি সরবরাহ, বাণিজ্য পথ এবং আর্থিক লেনদেনও রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্থনৈতিক শক্তির ভূমিকা অনেক পুরোনো। ১৯৪৫ সালে অর্থনীতিবিদ অ্যালবার্ট ও.

হির্সম্যান দেখিয়ে গেছেন, শক্তিশালী দেশগুলো দুর্বল দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে।

 একইভাবে ১৯৮০-এর দশকে ডেভিড এ বল্ডউইন তাঁর গবেষণায় দেখান, নিষেধাজ্ঞা, অর্থনৈতিক সহায়তা বা বাণিজ্য–সুবিধা প্রদানও অনেক সময় সরাসরি সামরিক শক্তির মতো রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হতে পারে। 

আরও পরে এসে গবেষক এডওয়ার্ড লুটওয়াক যুক্তি দেন, শীতল যুদ্ধের পর থেকে বিশ্ব শক্তিগুলোর মধ্যে সামরিক লড়াইয়ের চেয়ে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতাই প্রধান হয়ে উঠেছে। অনেকেই মনে করতেন, যদি দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক মজবুত হয়, তবে যুদ্ধ বা সংঘাত কমে যাবে। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে এই ধারণার বিরোধিতা শুরু হয়। সমালোচকেরা বলেন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক আসলে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে এবং এতে নতুন ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়। সহজভাবে বললে, দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা শুধু সহযোগিতা বাড়ায় না, বরং এটি একটি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে।

বিশ্বরাজনীতিতে নীতিগুলো সব সময় তাত্ত্বিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। শীতল যুদ্ধের সময় অ্যালান পি ডবসন লক্ষ করেন, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিক সংঘাতের বদলে ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’ চালিয়ে গেছে। তারা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও আর্থিক নীতিগুলোকে কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। সুসান স্ট্রেঞ্জের কাঠামোগত ক্ষমতার তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো রাষ্ট্র যদি আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, উৎপাদন বা প্রযুক্তিগত ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে, তবে সেই রাষ্ট্র অন্যদের জন্য শর্ত ঠিক করে দিতে পারে এবং এর ফলে সরাসরি বলপ্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়। 

২০১৩ সালের শেষ দিকে যখন রাশিয়া ক্রিমিয়া ও পূর্ব ইউক্রেনের কিছু অংশ দখল করতে ছোট ছোট সশস্ত্র দল পাঠায়, তখন ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের টমাস রাইট বলেছিলেন, পারস্পরিকভাবে লাভজনক অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কগুলো আসলে কৌশলগত দুর্বলতার উৎস হয়ে উঠতে পারে। এর তিন বছর পর ইউরোপীয় পররাষ্ট্র সম্পর্ক পরিষদের মার্ক লিওনার্ড ‘পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে অস্ত্রায়ণ করা’ শিরোনামে একটি ধারণা উপস্থাপন করেছিলেন। সেখানে তিনি সতর্ক করেছিলেন, একসময় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য প্রশংসিত হওয়া বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক (যেমন সীমান্ত পেরিয়ে বিনিয়োগ, বাণিজ্য রুট ও ডিজিটাল অবকাঠামো) সহজেই রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলে ব্যবহৃত হতে পারে। 

এর পর থেকে তথাকথিত হেলসিঙ্কি স্কুলের গবেষকেরা (মিকা আলতোলা, সোরেন শোলভিন ও মিকায়েল উইগেল) ‘ভূ–অর্থনৈতিক করিডর’ সম্পর্কে আলোচনা করছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন, তেল ও গ্যাস পাইপলাইন, শিপিং রুট ও সমুদ্রের তলদেশে থাকা যোগাযোগ কেব্‌লগুলো কৌশলগত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি দেশকে প্রতিপক্ষের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দিতে পারে। 

এদিকে ২০১৩ সালে প্রকাশিত ট্রেজার’স ওয়ার গ্রন্থে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপজাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জুয়ান জারাতে ব্যাখ্যা করেন কীভাবে আর্থিক নেটওয়ার্কগুলো সন্ত্রাসবাদ ও অবৈধ কার্যক্রম মোকাবিলায় ব্যবহার করা যেতে পারে। একইভাবে রবার্ট ডি ব্ল্যাকউইল ও জেনিফার এম হ্যারিস দেখান, ব্যাংকিং বার্তা আদান-প্রদানের স্বীকৃত মাধ্যম সুইফট ব্যবহারের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা সম্ভব। 

২০১৯ সালে হেনরি ফারেল ও আব্রাহাম নিউম্যান তাঁদের গবেষণায় দেখান, যারা তথ্য ও আর্থিক লেনদেনের কেন্দ্রীয় নোড নিয়ন্ত্রণ করে, তারা প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে বা নজরদারি চালাতে সক্ষম হয়। একই সময়ে অ্যান্থিয়া রবার্টস, হেনরিক চোয়ের মোরাস ও ভিক্টর ফার্গুসন দেখান, অর্থনৈতিক নীতি ও কৌশলগত নীতির সংমিশ্রণে একটি নতুন ভূ–অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠছে, যেখানে নিরাপত্তার স্বার্থে অর্থনৈতিক নীতিগুলোকে সামরিক কৌশলের মতো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণার এই প্রেক্ষাপট এমন এক সময়ের মধ্যে পড়ছে, যখন বৈশ্বিক সংযোগ দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিষেধাজ্ঞার কৌশল আরও উন্নত করেছে। অন্যদিকে চীন তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে ঋণনির্ভর বন্দর, রেলপথ ও শিল্পাঞ্চলের নেটওয়ার্ক তৈরি করে ইউরেশিয়া ও আফ্রিকায় একটি নির্ভরশীলতার জাল বিস্তার করেছে।

চীন আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। উদাহরণস্বরূপ, বৈশ্বিক লিথিয়াম পরিশোধনের ৭০ শতাংশ চীনের দখলে থাকায় তারা বৈদ্যুতিক যানবাহন শিল্পের জন্য একটি বড় সরবরাহ সংকট তৈরি করেছে এবং ইতিমধ্যে এই অবস্থানকে কৌশলগতভাবে কাজে লাগাতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান উত্তেজনা শুধু একটি উদাহরণ। আসলে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা শত্রুতায় রূপ নিয়েছে। ইউরোপেও রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর পাশাপাশি আমেরিকান পেমেন্ট সিস্টেম ও চীনা টেলিকম পরিষেবার বিকল্প খোঁজার প্রতিযোগিতা চলছে। 

সমস্যাটি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা নীতিনির্ধারকদের জন্য সরাসরি যুদ্ধের চেয়ে সহজতর উপায়। তবে এই কৌশলের জন্যও মূল্য চুকাতে হয়। কারণ, দীর্ঘ মেয়াদে এর ফলে দেশগুলোর মধ্যে সন্দেহ বাড়ে এবং প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থার সম্ভাবনা তৈরি হয়। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশগুলো বাণিজ্যনীতি কঠোর করবে এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সীমিত করবে। 

 ● কার্লা নরলফ টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ন টওয় র ক র জন ত ক ক শলগত আর থ ক র জন য র ওপর ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

কলকাতায় সম্মিলিত সেনা সম্মেলনের উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রী মোদির

কলকাতায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৬তম সম্মিলিত সেনা সম্মেলন (সিসিসি) উদ্বোধন করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেনা সম্মেলন একটি দ্বিবার্ষিক প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত শীর্ষস্তরীয় মতবিনিময়ের আসর।

অপারেশন সিঁদুরে’র পর এটিই প্রথম সম্মিলিত সেনা সম্মেলন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছাড়াও এই বৈঠকে যোগ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, তিন বাহিনীর প্রধান জেনারেল অনিল চৌহান, প্রতিরক্ষা সচিব রাজেশ কুমার সিং এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধানও।

আরো পড়ুন:

অবৈধ অভিবাসীদের প্রতি নরম হওয়ার দিন শেষ: ট্রাম্প

আসামে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ, ৫ বাংলাদেশি ছাত্রকে বহিষ্কার

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সদর দপ্তর কলকাতার বিজয় দুর্গে তথা ফোর্ট উইলিয়ামে আগামী তিনদিন এই সম্মিলিত সেনা সম্মেলন চলবে। 

এই সম্মেলন সেনার তিন বাহিনীর সর্বোচ্চ চিন্তাভাবনামূলক ফোরাম, যা দেশের শীর্ষ অসামরিক ও সামরিক নেতৃত্বকে ধারণাগত ও কৌশলগত স্তরে মতামত বিনিময়ের জন্য আয়োজন করা হয়েছে ৷ কলকাতার আগে সর্বশেষ সম্মিলিত সেনা সম্মলেন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২৩ সালে ভোপালে। অপারেশন সিঁদুরের প্রেক্ষাপটে, এই বছরের সম্মেলন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এবারের সম্মেলনে সংস্কার, রূপান্তর, পরিবর্তন এবং অপারেশনাল প্রস্তুতির উপর জোর দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের  বিবৃতি অনুযায়ী, ‘সম্মেলনের কেন্দ্রবিন্দু সশস্ত্র বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, সংহতিকরণ এবং প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণে বিশেষ জোর দেওয়া। একই সঙ্গে শীর্ষস্তরের একাধিক ক্ষেত্রে অপারেশনাল প্রস্তুতির উপরও জোর দেওয়া হবে। তিনদিনের এই সম্মেলন সশস্ত্র বাহিনীকে আরো শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হবে, যাতে ক্রমবর্ধমান জটিল ভূ-কৌশলগত পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়।’

রবিবার আসাম সফর সেরে নির্ধারিত সময়ের থেকে বেশ কিছুটা পর দমদম বিমানবন্দরে নামেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। তাকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় শিক্ষা এবং উত্তর-পূর্ব উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার। দলীয় কোনো কর্মসূচি না থাকলেও মোদিকে দেখতে ভিড় ছিল বিজেপি সমর্থকদের। ভিড় দেখে গাড়ি থামিয়ে হাত নেড়ে জনসংযোগ সারেন মোদি। সেখান থেকে তার ২৪ গাড়ির কনভয় পৌঁছায় রাজভবনে। সেখানেই রাত্রিবাস করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংও। তিনি রাত কাটান ফোর্ট উইলিয়ামে।

চলতি বছরে এই নিয়ে চতুর্থবার পশ্চিমবঙ্গে এলেন নরেন্দ্র মোদি। সকাল ৯ টাতেই রাজভবন থেকে ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে রওনা দেন প্রধানমন্ত্রী। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ফোর্ট উইলিয়ামে ছিলেন মোদি। দেড়টার পরে কলকাতা থেকে বিহারের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি।

একদিকে বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি। অন্যদিকে অস্থির চিন সীমান্ত। তার মধ্যে আবার নেপালে পালাবদল। দিনকয়েক আগে বাংলাদেশের উত্তরে চিন বিমানঘাঁটি তৈরি করতে চলেছে বলে একটি খবর ছড়ায়। ঘাঁটিটি নাকি আবার তৈরি হবে চিকেনস নেকের কাছেই। সবমিলিয়ে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিরাট এক জটিল সমীকরণ তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থায় কলকাতার বিজয় দুর্গে সেনা সম্মেলনের আয়োজন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও ইঙ্গিতবাহী বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা/সুচরিতা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কারও ওপর আক্রমণ হলে যৌথভাবে জবাব দেবে পাকিস্তান ও সৌদি আরব
  • কলকাতায় সম্মিলিত সেনা সম্মেলনের উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রী মোদির