বিশ্ব অর্থনীতি কতটা ‘অস্ত্রায়ণ’ সহ্য করতে পারে
Published: 27th, March 2025 GMT
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত জানুয়ারিতে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর আগের প্রশাসন, অর্থাৎ বাইডেন সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ঘায়েল করতে আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করেছে। তাই তিনি (ট্রাম্প) এই ‘অস্ত্রায়ণ’ বন্ধ করার ঘোষণা দেন। সমালোচকেরা এটিকে ট্রাম্পের নিছক একটি চটকদার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখলেও তাঁর সমর্থকেরা মনে করেন, রাজনৈতিক পক্ষপাতের বিরুদ্ধে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
তবে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের আড়ালে আরও গভীর একটি বাস্তবতা রয়েছে। সেটি হলো বিশ্বরাজনীতিতে অর্থনীতি, জ্বালানি সরবরাহ, বাণিজ্য পথ এবং আর্থিক লেনদেনও রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্থনৈতিক শক্তির ভূমিকা অনেক পুরোনো। ১৯৪৫ সালে অর্থনীতিবিদ অ্যালবার্ট ও.
একইভাবে ১৯৮০-এর দশকে ডেভিড এ বল্ডউইন তাঁর গবেষণায় দেখান, নিষেধাজ্ঞা, অর্থনৈতিক সহায়তা বা বাণিজ্য–সুবিধা প্রদানও অনেক সময় সরাসরি সামরিক শক্তির মতো রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হতে পারে।
আরও পরে এসে গবেষক এডওয়ার্ড লুটওয়াক যুক্তি দেন, শীতল যুদ্ধের পর থেকে বিশ্ব শক্তিগুলোর মধ্যে সামরিক লড়াইয়ের চেয়ে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতাই প্রধান হয়ে উঠেছে। অনেকেই মনে করতেন, যদি দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক মজবুত হয়, তবে যুদ্ধ বা সংঘাত কমে যাবে। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে এই ধারণার বিরোধিতা শুরু হয়। সমালোচকেরা বলেন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক আসলে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে এবং এতে নতুন ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়। সহজভাবে বললে, দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা শুধু সহযোগিতা বাড়ায় না, বরং এটি একটি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে।
বিশ্বরাজনীতিতে নীতিগুলো সব সময় তাত্ত্বিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। শীতল যুদ্ধের সময় অ্যালান পি ডবসন লক্ষ করেন, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিক সংঘাতের বদলে ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’ চালিয়ে গেছে। তারা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও আর্থিক নীতিগুলোকে কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। সুসান স্ট্রেঞ্জের কাঠামোগত ক্ষমতার তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো রাষ্ট্র যদি আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, উৎপাদন বা প্রযুক্তিগত ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে, তবে সেই রাষ্ট্র অন্যদের জন্য শর্ত ঠিক করে দিতে পারে এবং এর ফলে সরাসরি বলপ্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়।
২০১৩ সালের শেষ দিকে যখন রাশিয়া ক্রিমিয়া ও পূর্ব ইউক্রেনের কিছু অংশ দখল করতে ছোট ছোট সশস্ত্র দল পাঠায়, তখন ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের টমাস রাইট বলেছিলেন, পারস্পরিকভাবে লাভজনক অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কগুলো আসলে কৌশলগত দুর্বলতার উৎস হয়ে উঠতে পারে। এর তিন বছর পর ইউরোপীয় পররাষ্ট্র সম্পর্ক পরিষদের মার্ক লিওনার্ড ‘পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে অস্ত্রায়ণ করা’ শিরোনামে একটি ধারণা উপস্থাপন করেছিলেন। সেখানে তিনি সতর্ক করেছিলেন, একসময় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য প্রশংসিত হওয়া বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক (যেমন সীমান্ত পেরিয়ে বিনিয়োগ, বাণিজ্য রুট ও ডিজিটাল অবকাঠামো) সহজেই রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলে ব্যবহৃত হতে পারে।
এর পর থেকে তথাকথিত হেলসিঙ্কি স্কুলের গবেষকেরা (মিকা আলতোলা, সোরেন শোলভিন ও মিকায়েল উইগেল) ‘ভূ–অর্থনৈতিক করিডর’ সম্পর্কে আলোচনা করছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন, তেল ও গ্যাস পাইপলাইন, শিপিং রুট ও সমুদ্রের তলদেশে থাকা যোগাযোগ কেব্লগুলো কৌশলগত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি দেশকে প্রতিপক্ষের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দিতে পারে।
এদিকে ২০১৩ সালে প্রকাশিত ট্রেজার’স ওয়ার গ্রন্থে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপজাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জুয়ান জারাতে ব্যাখ্যা করেন কীভাবে আর্থিক নেটওয়ার্কগুলো সন্ত্রাসবাদ ও অবৈধ কার্যক্রম মোকাবিলায় ব্যবহার করা যেতে পারে। একইভাবে রবার্ট ডি ব্ল্যাকউইল ও জেনিফার এম হ্যারিস দেখান, ব্যাংকিং বার্তা আদান-প্রদানের স্বীকৃত মাধ্যম সুইফট ব্যবহারের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা সম্ভব।
২০১৯ সালে হেনরি ফারেল ও আব্রাহাম নিউম্যান তাঁদের গবেষণায় দেখান, যারা তথ্য ও আর্থিক লেনদেনের কেন্দ্রীয় নোড নিয়ন্ত্রণ করে, তারা প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে বা নজরদারি চালাতে সক্ষম হয়। একই সময়ে অ্যান্থিয়া রবার্টস, হেনরিক চোয়ের মোরাস ও ভিক্টর ফার্গুসন দেখান, অর্থনৈতিক নীতি ও কৌশলগত নীতির সংমিশ্রণে একটি নতুন ভূ–অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠছে, যেখানে নিরাপত্তার স্বার্থে অর্থনৈতিক নীতিগুলোকে সামরিক কৌশলের মতো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণার এই প্রেক্ষাপট এমন এক সময়ের মধ্যে পড়ছে, যখন বৈশ্বিক সংযোগ দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিষেধাজ্ঞার কৌশল আরও উন্নত করেছে। অন্যদিকে চীন তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে ঋণনির্ভর বন্দর, রেলপথ ও শিল্পাঞ্চলের নেটওয়ার্ক তৈরি করে ইউরেশিয়া ও আফ্রিকায় একটি নির্ভরশীলতার জাল বিস্তার করেছে।
চীন আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। উদাহরণস্বরূপ, বৈশ্বিক লিথিয়াম পরিশোধনের ৭০ শতাংশ চীনের দখলে থাকায় তারা বৈদ্যুতিক যানবাহন শিল্পের জন্য একটি বড় সরবরাহ সংকট তৈরি করেছে এবং ইতিমধ্যে এই অবস্থানকে কৌশলগতভাবে কাজে লাগাতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান উত্তেজনা শুধু একটি উদাহরণ। আসলে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা শত্রুতায় রূপ নিয়েছে। ইউরোপেও রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর পাশাপাশি আমেরিকান পেমেন্ট সিস্টেম ও চীনা টেলিকম পরিষেবার বিকল্প খোঁজার প্রতিযোগিতা চলছে।
সমস্যাটি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা নীতিনির্ধারকদের জন্য সরাসরি যুদ্ধের চেয়ে সহজতর উপায়। তবে এই কৌশলের জন্যও মূল্য চুকাতে হয়। কারণ, দীর্ঘ মেয়াদে এর ফলে দেশগুলোর মধ্যে সন্দেহ বাড়ে এবং প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থার সম্ভাবনা তৈরি হয়। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশগুলো বাণিজ্যনীতি কঠোর করবে এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সীমিত করবে।
● কার্লা নরলফ টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ন টওয় র ক র জন ত ক ক শলগত আর থ ক র জন য র ওপর ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
ইরান যে তিন কারণে পারমাণবিক অস্ত্র বানাবে না
বিশ্বরাজনীতিতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি একটি বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ইস্যু। পশ্চিমা শক্তিগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল, বহু বছর ধরে অভিযোগ করে আসছে, ইরান নাকি গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বা যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আজ পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি, যা এ দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করে। অন্যদিকে ইরান শুরু থেকেই বলে আসছে যে তাদের পরমাণু কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ ও বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত।
প্রশ্ন হলো, যদি ইরান সত্যিই পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে চাইত, তাহলে গত দুই দশকে তা তৈরি করেনি কেন? আর যদি তা না-ই চায়, তাহলে উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ চালিয়ে যাচ্ছে কেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে ইরানের ধর্মীয় অবস্থান, কৌশলগত চিন্তা, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির দ্বিচারিতা একত্রে বিশ্লেষণ করতে হবে।
আরও পড়ুনইরান এবার বড় যুদ্ধের জন্য যেভাবে প্রস্তুত হবে০৬ জুলাই ২০২৫ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ও নৈতিক অবস্থান২০০৩ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি একটি ঐতিহাসিক ফতোয়া জারি করেন। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়, ‘পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি, মজুত কিংবা ব্যবহার ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম।’ এ সিদ্ধান্ত শুধুই ধর্মীয় নয়, বরং একটি নৈতিক অবস্থানও, যেখানে নিরীহ মানুষ হত্যাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। পারমাণবিক বোমা শুধু সামরিক লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করে না, বরং শহর, জনপদ ও লাখ লাখ নিরীহ মানুষের প্রাণ হরণ করে। ইসলামের যুদ্ধনীতিতে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
ইরান মনে করে, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার শুধু মানবতার বিরুদ্ধে নয়, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিরুদ্ধে চরম অন্যায়। হিরোশিমা-নাগাসাকির দৃষ্টান্ত এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ দেয়।
কৌশলগত ও সামরিক বাস্তবতাঅনেকের ধারণা, পারমাণবিক অস্ত্র থাকলেই একটি দেশ নিরাপদ থাকে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলেও ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানে অংশ নিতে বাধ্য হয়। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রধারী হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে। এমনকি রাশিয়া, যাদের বিশ্বের সর্বোচ্চ পারমাণবিক অস্ত্র মজুত রয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটোর সঙ্গে কৌশলগতভাবে চাপে পড়েছে। ইসরায়েলও অঘোষিত পারমাণবিক অস্ত্রধারী হওয়া সত্ত্বেও ইরানের ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ’-এ বড় ধরনের সামরিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে।
এ বাস্তবতা ইরানকে বুঝিয়ে দিয়েছে, পারমাণবিক অস্ত্র নয়, কার্যকর প্রতিরোধক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। তাই তারা শক্তিশালী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, চালকবিহীন বিমান বা ড্রোন এবং কৌশলগত অস্ত্র নির্মাণে জোর দিয়েছে।
সামরিক মহড়া চলাকালে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলের অজ্ঞাত স্থান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৯ জানুয়ারি ছবিটি প্রকাশ করে ইরান